আওয়ামী লীগের ‘স্মার্ট’ কূটনীতি কতটা কাজে দেবে?

এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এর বিখ্যাত চরণ। নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে ইষ্টদেবতার আরাধনা করছিলেন রাবণপুত্র ইন্দ্রজিৎ। ওই সময় যজ্ঞপুরীতে শত্রুপক্ষের লক্ষ্মণের অপ্রত্যাশিত আগমনে বিব্রত হন ইন্দ্রজিৎ। লক্ষ্মণের গোপন পথ আবিষ্কারের হেতু উদ্ধার করে চাচা বিভীষণের উদ্দেশে অরি বা শত্রুকে দমনকারী ইন্দ্রজিৎ বিষাদমাখা কণ্ঠে বলেছিলেন, উচ্চ রাজবংশের সন্তান হয়ে এমন হীন কাজ করা বিভীষণের ঠিক হয়নি। ইন্দ্রজিতের বিষাদমাখা কণ্ঠে নিরাপত্তার দুর্বলতা বিধৃত করেছিলেন মধু কবি তাঁর অমর মহাকাব্যে।

শেষ পর্যন্ত আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বিষাদমাখা কণ্ঠে বললেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র আমাদের দুর্বলতার কথা জানালে, আমরা ঠিক করে নেব।’ দিন কয়েকের মধ্যেই মার্কিন প্রশাসনের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ঢাকা সফরে আসবেন। তাঁর সফরের আগে কণ্ঠ অনেকটা নরম করল ঢাকা। এর আগে অবশ্য দল বেঁধে সরকারের লোকজন যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর সমালোচনা করেছেন। মূলত অব্যাহত গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা জারির পর সরকারের লোকজন যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেন। যুক্তরাষ্ট্রে কত মানুষ গুম হয়, পুলিশ কত মানুষকে গুলি করে হত্যা করে, এসবের ফিরিস্তি তুলে ধরতে শুরু করেছিলেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের নানা ভাষায় সমালোচনা করেছেন আওয়ামী লীগ নেতা তথা সরকারের মন্ত্রীরা।

শুধু মার্কিনদের সমালোচনাই নয়, গুম হওয়া বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলামের বাড়িতে গেলে নাজেহাল হন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। অনেকেই সন্দেহ করেন, ‘মায়ের কান্না’ নামের সংগঠনের আড়ালে সেখানে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই পিটার হাসকে নাজেহাল করেছেন।

কূটনৈতিক চাপকে কূটনৈতিক ভাষা ও কৌশল দিয়ে মোকাবিলা করতে হয়। কোনো দেশের রাষ্ট্রদূতকে নাজেহাল করে, সমালোচনা, আজেবাজে ভাষা ও মিথ্যা কথা বলে কূটনীতিতে সফল হওয়া মুশকিল। আওয়ামী লীগ কি বুঝবে, ৯/১১-পরবর্তী সময়ে পরিবর্তিত বিশ্বরাজনীতির সুবিধা পেয়েছিল? কিন্তু এখন বিশ্বরাজনীতি বিশেষ করে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকার তালিকায় পরিবর্তন এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও পরিবেশ রক্ষার কথা বলে নিজেদের প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ নীতিতেই নতুন পররাষ্ট্রনীতি অনেকটা প্রতিফলিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ক্রমাগত বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ও স্বচ্ছ নির্বাচন নিয়ে কথা বলছে। আর ধারাবাহিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা ঢাকা সফর করছেন। ঊর্ধ্বতন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা এইলিন লুবাখার ঢাকা সফর করছেন। নভেম্বরে এসেছিলেন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক উপসহকারী সেক্রেটারি আফরিন আখতার। এর আগে আগেই অক্টোবরে ঢাকা ঘুরে গেছেন আরেক সহকারী সেক্রেটারি অরুণ ভেংকটারামান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা ঢাকা সফরকালে কমবেশি একই ধরনের কথা বলেছেন। সবাই মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও স্বচ্ছ নির্বাচনের বিষয়ে কথা বলেছেন।

শুধু মার্কিনরাই নন, তাঁদের সঙ্গে যুক্তরাজ্য, জাপান, জার্মানির রাষ্ট্রদূতেরাও এসব কথায় যোগ দিয়েছেন। বিশেষ করে জাপানের রাষ্ট্রদূত রীতিমতো বোমা ফাটানো মন্তব্য করেছেন ২০১৮ সালের রাতের নির্বাচন নিয়ে। যদিও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী দাবি করেছিলেন জাপানি রাষ্ট্রদূতকে ডেকে বকে দিয়েছে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিন্তু জাপানি রাষ্ট্রদূত পরে জানিয়েছিলেন, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর দেখাই হয়নি।

বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের বিগত কয়েক মাসে দেশের মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও স্বচ্ছ নির্বাচন নিয়ে সরব হওয়া তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। এর নানা ধরনের প্রভাব রয়েছে।

রাষ্ট্রদূতেরা অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে মন্তব্য ও কথাবার্তা সব সময় বলেন না। বিশ্বরাজনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তাঁরা কূটনীতি পরিচালনা করেন। রাষ্ট্রদূতেরা মূলত তাঁদের দেশের অবস্থানই এখানে তুলে ধরেন। তাই তাঁদের কথাবার্তাকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে সরকারকে। পাড়ার মুখর ঝগড়াটে মানুষের মতো আচরণ না করে কথার ওজন অনুসারে রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার নিরিখে যথাযথ উত্তর দিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব মোড়ল। তারা চাইলেই যে কারও ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ চাইলেই যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে না। বাংলাদেশ বলতে পারে না নিষেধাজ্ঞার পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে মার্কিন বাজারে আমাদের তৈরি পোশাক পাঠাব না।

আওয়ামী লীগ হয়তো ভেবেছিল, সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের কৌশলগত মিত্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে থাকবে। আর চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করবে। এতে করে শ্যাম  ও কুল উভয়েরই রক্ষা হবে। কিন্তু তালেবানের হাতে কাবুলের পতনের পর সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের কোনো গুরুত্ব আপাতত নেই, যে কারণে আওয়ামী লীগের ‘স্মার্ট ডিপ্লোমেসি’ উপযোগিতা হারিয়েছে।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে রাষ্ট্রগুলোর প্রতিটি পদক্ষেপ হয় নিজস্ব স্বার্থ অনুসারে। ২০০৮ সালে বা ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে আন্তর্জাতিক সমাজ তথা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নীরবতা ছিল তাদের নিজস্ব স্বার্থের কারণে। এমন নয় যে হুট করে দেশের মানুষ গুম হয়ে যাচ্ছে। এক দশক ধরেই জনসাধারণ গুম হচ্ছে। তখন তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা শক্তি গুমের বিষয়ে বাধা দেয়নি। তাহলে এখন তারা কথা বলছে কেন? এখানেও তাদের স্বার্থ রয়েছে। সম্ভবত বিনিয়োগের নামে বাংলাদেশে ক্রমাগত চীনের উপস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রকে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা ও আধিপত্য নিয়ে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। এ কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যরা মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের ইস্যুতে চাপ দিয়ে নিজেদের স্বার্থ আদায় করতে চাইছে।

এই চাপ থেকে আওয়ামী লীগ তথা সরকারের বেরিয়ে আসা মুশকিল হবে। কারণ, চীনের উপস্থিতি আওয়ামী লীগের পক্ষে কমানো বা বিনিয়োগ বাতিল করা সম্ভব নয়। অর্থনৈতিক নানা অনিয়ম, লুটপাট, পাচার, ডলার-সংকটের এই সময়ে চীনা বিনিয়োগ বাতিল সরকারের জন্য মহাবিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। চীনও নিজের অবস্থান দুর্বল করতে চাইবে না। চীন অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের নামে গুটি গুটি পায়ে নিজের অবস্থান শক্ত করছে বাংলাদেশে। পদ্মা সেতু নির্মাণ করে চীন তার পদচিহ্ন রেখেছে। এখন তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে ভারত সীমান্তে পৌঁছে যেতে চায়। চীনের রাষ্ট্রদূত তিস্তা এলাকা সফর করে প্রকল্প বাস্তবায়নের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিন গ্যাং এক ঘণ্টার ঝটিকা সফর করেছেন সোমবার। ছিন গ্যাং ঠিক ডোনাল্ড লুর পাঁচ দিন আগে ঢাকায় এক ঘণ্টার জন্য এসেছিলেন। বলা হচ্ছে, তিনি যাত্রাবিরতি করেছিলেন। সরকারের পক্ষ থেকে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার বিষয় নিয়ে আলোচনার কথা বলা হলেও এই সফরের বহুমাত্রিক তাৎপর্য রয়েছে।

চীনের দিক থেকে আশ্বাস থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত চাপের মুখে মানবাধিকার বিষয়ে সরকার নিজেদের শুধরে নেওয়ার কথা বলছে। কিন্তু সুর নরম করে শেষ রক্ষা করা কতটা সম্ভব হবে তা বলা মুশকিল। পররাষ্ট্রনীতিতে ‘স্মার্ট ডিপ্লোমেসি’ বলে একটা অতি প্রাচীন কৌশল আছে। কৌটিল্য এই নীতির জনক বলে পরিচিত। বিভিন্ন পরস্পর বিবদমান দেশের কোনো পক্ষেই না গিয়ে সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখাই হচ্ছে স্মার্ট ডিপ্লোমেসির মূল ভরকেন্দ্র। আওয়ামী লীগের এই স্মার্ট ডিপ্লোমেসি বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় আদৌ কাজে দেবে কিনা সেই প্রশ্ন খুবই সংগত। আওয়ামী লীগ হয়তো ভেবেছিল, সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের কৌশলগত মিত্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে থাকবে। আর চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করবে। এতে করে শ্যাম  ও কুল উভয়েরই রক্ষা হবে। কিন্তু তালেবানের হাতে কাবুলের পতনের পর সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের কোনো গুরুত্ব আপাতত নেই, যে কারণে আওয়ামী লীগের ‘স্মার্ট ডিপ্লোমেসি’ উপযোগিতা হারিয়েছে।

মানবাধিকার ইস্যুকে যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য কাজে লাগাবে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়ার মাধ্যমেই কেবল বাংলাদেশ এই পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে। আমরা জানি, আর্জেন্টিনার সামরিক শাসক হোর্হে ভিদাল বা চিলির পিনোশেটকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। মনে রাখতে হবে, ভিদাল বা পিনোশেটকে উসকানি এবং তাঁদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রশিক্ষণ কিন্তু পশ্চিমারাই দিয়েছিল। আবার বিচারের ব্যবস্থাও তারাই করেছিল। র‌্যাবকে মার্কিনরাই প্রশিক্ষণ দিয়েছে। নিষেধাজ্ঞাও তারাই দিয়েছে।

  • ড. মারুফ মল্লিক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক