বিপুল খাদ্যশস্য ভান্ডারের দেশ ইউক্রেন যুদ্ধের মুখে পড়ে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে
বিপুল খাদ্যশস্য ভান্ডারের দেশ ইউক্রেন যুদ্ধের মুখে পড়ে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে

মতামত

যে কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে বিশ্বব্যবস্থা

২০২৪ সালটা এমন বাজেভাবে শুরু হবে, তা কল্পনাও করা যায়নি।

প্রথমত, গাজায় তিন মাসের বেশি সময় ধরে ইসরায়েল প্রতিদিন গণহত্যা চালাচ্ছে। সেখানে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে ইসরায়েল–সংশ্লিষ্ট জাহাজে আক্রমণ করায় যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশ তাদের নৌবাহিনীকে সেখানে একত্র করতে বাধ্য হচ্ছে। অন্যদিকে লেবানন ও সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলা সমগ্র অঞ্চলকে সংঘাতের ঝুঁকিতে ঢেকে ফেলছে।

দ্বিতীয়ত, বিস্তীর্ণ উর্বর ভূমি ও বিপুল খাদ্যশস্য ভান্ডারের দেশ ইউক্রেন যুদ্ধের মুখে পড়ে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। লাখ লাখ ইউক্রেনীয় নাগরিক বাস্তুচ্যুত হয়ে একেবারে উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছেন। খাবার, পানি, বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।

ইউক্রেনে হামলাকারী দেশ রাশিয়ারও বিপুল ক্ষতি হয়েছে। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমারা অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা এবং ন্যাটোর পূর্বাঞ্চলকে সম্প্রসারিত করার চেষ্টা অব্যাহত রাখা সত্ত্বেও মস্কো লড়াই চালিয়ে যেতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ রয়েছে। ফিনল্যান্ড ৩১তম সদস্য হিসেবে ন্যাটোয় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর রাশিয়ার সঙ্গে ন্যাটোর সীমান্ত দ্বিগুণের বেশি হয়ে গেছে। সুইডেনও ন্যাটোয় নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা জোরদার করেছে। ফলে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের আশু সমাপ্তি দেখা যাচ্ছে না।

পাকিস্তানের জন্য ২০২৪ সাল হবে একটি দমবন্ধ করার মতো সময়কাল। দেশটি বছরের পর বছর ধরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসবাদের কবলে রয়েছে। এখানে নির্বাচনের আগের পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে আছে। দোষারোপের খেলা চরম পর্যায়ে চলে এসেছে। বিনিয়োগকারীরা দেশটির অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত।

তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র-চীনের কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা ইতিমধ্যেই নড়বড়ে হয়ে যাওয়া বিশ্বব্যবস্থাকে আরও বেশি নাজুক ও নড়বড়ে করে তুলেছে। এই দুটি দেশ প্রযুক্তিযুদ্ধে জড়িয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শ্রেষ্ঠত্ব নিজের কবজায় রাখা এবং উন্নত সেমিকন্ডাক্টর চিপ উৎপাদন নিয়ে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে।

সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহ শৃঙ্খলে অগ্রগামী যুক্তরাষ্ট্র চীনের রপ্তানিকে নিয়ন্ত্রণ এবং চীনে বিনিয়োগ রোধের মাধ্যমে বেইজিংয়ের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। তবে চীন এখন পর্যন্ত খনিজ পদার্থ; বিশেষ করে ইভি, ব্যাটারি ও সৌর প্যানেল তৈরিতে ব্যবহার্য কোবাল্ট ও লিথিয়ামের সরবরাহ শৃঙ্খলে নিজের আধিপত্য ধরে রাখতে পেরেছে। চীনের এই সুবিধাকে খর্ব করতে যুক্তরাষ্ট্র চীনের গাড়ি ও অন্যান্য পণ্যের ওপর উচ্চ হারে শুল্ক বসিয়েছে। এই দুই পরাশক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিশ্বকে শিবিরভিত্তিক রাজনীতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

চতুর্থত, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার পরিবেশ মারাত্মকভাবে হুমকিতে পড়ে গেছে। পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার দৌড়ে এগিয়ে থাকতে বড় বড় দেশ তাদের পারমাণবিক চুল্লিগুলোকে আধুনিক থেকে আধুনিকতর করছে। পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা নিষিদ্ধ করাবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি দ্য কম্প্রিহেন্সিভ নিউক্লিয়ার টেস্ট ব্যান ট্রিটি বা সিটিবিটিতে অনুস্বাক্ষর করা দেশ রাশিয়া গত নভেম্বরে এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেছে। এর ফলে রাশিয়ার সামনে পারমাণবিক অস্ত্রের নতুন কোনো পরীক্ষার দুয়ার খুলে গেছে।

কৌশলগত পারমাণবিক ওয়ারহেড মোতায়েনকে সীমিত অবস্থায় রাখতে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে ‘নিউ স্টার্ট’ নামে যে চুক্তি হয়েছিল, সেটিও রাশিয়া গত বছর স্থগিত করেছে। ইউরোপীয় নিরাপত্তার জন্য মাঝারি পাল্লার পারমাণবিক শক্তিগুলোকে নির্মূল করতে যে আইএনএফ চুক্তি হয়েছিল, সেটি ২০১৯ সালে বাতিল করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

এর মধ্য দিয়ে ২০২৪ সালে কয়েক ডজন দেশে নির্বাচন হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, উদ্বেগ তত বাড়ছে। ৮১ বছর বয়সী জো বাইডেন এবং ৭৭ বছর বয়সী ডোনাল্ড ট্রাম্প ভোটের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। এই ভোটের ফলাফল ভূরাজনীতিতে; বিশেষ করে ট্রান্সআটলান্টিক সমীকরণে গভীর প্রভাব ফেলবে।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন মার্চে পঞ্চম মেয়াদের জন্য পুনর্নির্বাচিত হতে চাইছেন। ইন্দোনেশিয়ায় ফেব্রুয়ারিতে এবং ভারতে মে মাসে নির্বাচন হতে চলেছে। যুক্তরাজ্যে বছরের দ্বিতীয়ার্ধে নির্বাচন হবে। নির্বাচন ঘিরে বিভিন্ন দেশে জনতুষ্টিবাদী হাঁকডাক সামাজিক মেরুকরণকে তীক্ষ্ণ ও তীব্র করে তুলছে।

পাকিস্তানের জন্য ২০২৪ সাল হবে একটি দমবন্ধ করার মতো সময়কাল। দেশটি বছরের পর বছর ধরে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসবাদের কবলে রয়েছে। এখানে নির্বাচনের আগের পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে আছে। দোষারোপের খেলা চরম পর্যায়ে চলে এসেছে। বিনিয়োগকারীরা দেশটির অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। পাকিস্তানের ঋণের কিস্তি পরিশোধ নিয়ে সৃষ্ট সংকটের সমাধান হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আইজাজ আহমেদ চৌধুরী পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব এবং ইসলামাবাদের সানোবার ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান

ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত