শশী থারুরের বিশ্লেষণ

ভারতের কি এখনো পাকিস্তানকে নিয়ে ভাবার সময় আছে

ভারত ও পাকিস্তান দরজার ওপারের এমন দুই প্রতিবেশী, যাদের মধ্যে কথা বলা একরকম বন্ধই আছে। ভারতের আসন্ন নির্বাচন ঘিরে সরকারকে যতগুলো ইস্যু মোকাবিলা করতে হবে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ভারত তার প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে বিদ্যমান অস্থির সম্পর্কের বিষয়টিকে কীভাবে দেখবে। এই লেখায় সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন শশী থারুর

১৯ এপ্রিল থেকে আগামী ১ জুন ভারতে লোকসভা নির্বাচন। এই নির্বাচনকে ঘিরে সরকারকে যতগুলো ইস্যু মোকাবিলা করতে হবে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ভারত তার প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে বিদ্যমান অস্থির সম্পর্কের বিষয়টিকে কীভাবে দেখবে। জবাবটা সম্ভবত খুবই সোজা: এই সম্পর্কে খুব একটা হেরফের হবে না।

অল্প কিছুদিন আগেও অনেকে আশা করছিলেন, ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে অনুষ্ঠেয় উভয় দেশের জাতীয় নির্বাচন কূটনৈতিক সম্পর্কের একটি নতুন সূচনার সুযোগ তৈরি করতে পারে। কিন্তু পাকিস্তানে জনপ্রিয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে নির্বাচনের বাইরে রেখে গত ফেব্রুয়ারিতে যে বিতর্কিত নির্বাচন হয়ে গেল এবং দেশটির নতুন সরকারের বৈধতা যখন তীব্র চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ল, তখন দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কোন্নয়নের আশা চুপসে গেছে।

পাকিস্তানে সামরিক গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে যে দুর্বল জোট সরকার গঠিত হয়েছে, সেই সরকার ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে তেমন কোনো সাহসী উদ্যোগ নিতে পারবে বলে মনে হয় না। ইমরান খানের সমর্থকেরা মনে করেন, অন্যায়ভাবে তাঁদের ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে এবং সে কারণেই তাঁরা পাকিস্তানের বর্তমান সরকারের যেকোনো উল্লেখযোগ্য নীতি পরিবর্তনকে চ্যালেঞ্জ করবেন।

এই পরিস্থিতিতে ভারত সম্ভবত পাকিস্তানের প্রতি তার বিদ্যমান সচেতন ‘সৌম্য উদাসীনতার’ নীতিই বজায় রাখতে আগ্রহী হবে। বর্তমানে ভারত ও পাকিস্তান নিজেদের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ককে চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স পর্যায়ে (যেটি কি না রাষ্ট্রদূত পর্যায়ের নিচে) স্থিতিশীল রেখেছে। তবে উভয় দেশ এখনো নির্দিষ্ট কিছু ইস্যুতে নির্দিষ্ট কিছু ফোরামে অংশগ্রহণ করে থাকে এবং সেখানে উভয়েই কথা বলে থাকে।

এই দুই দেশের বৈরী সম্পর্কের কারণে সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজওনাল কো-অপারেশন (সার্ক) কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। মূলত এই দুই দেশের শীতল সম্পর্কের কারণে বহু বছর আঞ্চলিক সংস্থাটির কোনো সম্মেলন হয় না।

অধিকন্তু, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ন্যূনতম জায়গায় নেমে এসেছে। দুই দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বিনিময়ও সীমিত হয়ে গেছে। ভারতীয় নাগরিকদের পাকিস্তানে যাওয়ার জন্য ভিসা পেতে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়। পাকিস্তানের লোকদেরও ভারতে যাওয়ার ভিসা পেতে একই অবস্থার মুখে পড়তে হয়। এই বৈরী অবস্থা এমনকি ক্রীড়া ইভেন্টেও পড়েছে। দুই দেশ আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের বাইরে খুব কমই একে অপরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে।

সংক্ষেপে বলতে গেলে বলা যায়, ভারত ও পাকিস্তান দরজার ওপারের এমন দুই প্রতিবেশী, যাদের মধ্যে কথা বলা একরকম বন্ধই আছে এবং ভারতের দৃষ্টিতে এটিই ঠিক আছে। তবে যেহেতু দীর্ঘদিন থেকেই ভারতকে নিশানা করা সন্ত্রাসবাদীরা মূল ঘাঁটি হিসেবে পাকিস্তানের মাটিকে ব্যবহার করে আসছে, সেহেতু ভারত চাইলেও সব সময় পাকিস্তানকে উপেক্ষা করতে পারে না।

পাকিস্তানের মাটি থেকে ভারতে এ পর্যন্ত যতগুলো সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়েছে, তার মধ্যে ২০০৮ সালের নভেম্বরের হামলাটি সবচেয়ে কুখ্যাত। ওই সময় পাকিস্তানের সন্ত্রাসী সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বা মুম্বাইতে ঢুকে পড়ে চার দিন ধরে গুলি ও বোমা হামলা চালিয়েছিল। তাতে ১৭০ জনেরও বেশি লোক নিহত হয়েছিলেন।

ওই সময় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে যে ভাঙন ধরেছিল, তার আর পুনরুদ্ধার করা যায়নি। তবে এই সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের অনেক সুযোগ এসেছিল। যেমন ২০১৫ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের জন্মদিন উদ্‌যাপনের অনুষ্ঠানে পূর্বঘোষণা ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি লাহোরে গিয়েছিলেন। কিন্তু যখনও সম্পর্কের বরফ একটু গলতে শুরু করেছে, তখনই পাকিস্তানি সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসী হামলা সেই গতিকে থামিয়ে দিয়েছে।

পাকিস্তান তার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। বিশেষ করে বেলুচিস্তানের পশ্চিম সীমান্তে (ইরানের কাছে) এবং খাইবার পাখতুনখাওয়ায় (আফগানিস্তানের কাছে) পাকিস্তান সরকারকে সার্বক্ষণিকভাবে বাড়তি মনোযোগ দিতে হচ্ছে। ফলে প্রতিবেশীর ওপর কোনো ধরনের গুরুতর আক্রমণের ক্ষমতা এখন পাকিস্তানের খুবই কম।

ভারতের দিক থেকে নেওয়া নীতিগত সিদ্ধান্ত হলো, যতক্ষণ না পাকিস্তান তার সীমানার ভেতর থেকে ইসলামপন্থী সন্ত্রাস দমন করতে অক্ষম থাকবে কিংবা সন্ত্রাস দমনে অনিচ্ছুক থাকবে ততক্ষণ দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সুসম্পর্ক অধরা থেকে যাবে।

২০১৯ সালে কাশ্মীর নিয়ে ভারতীয় নীতির প্রতিবাদে পাকিস্তান যখন দিল্লি থেকে তার হাইকমিশনারকে প্রত্যাহার করে নেয়, ভারত তখন এটি না করার জন্য পাকিস্তানকে কোনো রকম খোশামোদ করেনি, বরং ভারতও একইভাবে ইসলামাবাদ থেকে তার হাইকমিশনারকে সরিয়ে এনেছিল। আর এখন তো পাকিস্তানকে ভারতের তোয়াজ করার কারণ আরও কমে গেছে।

পাকিস্তান তার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। বিশেষ করে বেলুচিস্তানের পশ্চিম সীমান্তে (ইরানের কাছে) এবং খাইবার পাখতুনখাওয়ায় (আফগানিস্তানের কাছে) পাকিস্তান সরকারকে সার্বক্ষণিকভাবে বাড়তি মনোযোগ দিতে হচ্ছে। ফলে প্রতিবেশীর ওপর কোনো ধরনের গুরুতর আক্রমণের ক্ষমতা এখন পাকিস্তানের খুবই কম।

এর বদলে জেনারেল আসিম মুনিরের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী সেই অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জগুলোকে রাষ্ট্রের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ সুসংহত করার অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করছে। মুনিরের পূর্বসূরি জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া ২০১৮ সালে ইমরান খানকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে গদিতে বসানোর ‘কারসাজির নির্বাচনের’ নকশা করেছিলেন।

ওই সময় সামরিক বাহিনী ১৯৭০-এর দশক থেকে বিভিন্ন সময় ক্ষমতায় থাকা পাকিস্তানের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) এবং পাকিস্তান মুসলিম লিগের (পিএমএল-এন)-এর একটি বিকল্প দল খুঁজছিল। (উভয় দলকেই বিভিন্ন সময় সামরিক নেতারা পর্দার আড়ালে থেকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন।)

কিন্তু বিকল্প শক্তি দাঁড় করাতে গিয়ে বাজওয়া ভুল লোককে বেছে নিয়েছিলেন। ক্যারিশমাটিক সাবেক ক্রিকেট তারকা ইমরান খান (যিনি একজন ইসলাম ধর্মের ব্যক্তিত্বকে বিয়ে করে নিজেকে একজন কট্টর ইসলামপন্থীতে রূপান্তরিত করেছেন) ক্ষমতায় বসে স্বমূর্তি ধারণ করেন এবং তিনি সেনাবাহিনীর বেঁধে দেওয়া নিয়ম মেনে খেলতে রাজি হচ্ছিলেন না।

ইমরান খুব দ্রুতই একটি উগ্র জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থী বার্তা জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেন এবং সেনাবাহিনীর কর্তৃত্বকে সরাসরি প্রশ্নবিদ্ধ করেন। এর মাধ্যমে ইমরান খান ক্রমবর্ধমানভাবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর নিজস্ব স্বাধীনতার ওপর জোর দিয়ে যাচ্ছিলেন এবং এর মধ্য দিয়ে তিনি একটি শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী চেতনার অনুসরণকে উসকে দেওয়া শুরু করেছেন।

এই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের এপ্রিলের মধ্যে সামরিক বাহিনী সিদ্ধান্ত আসে যে যথেষ্ট হয়েছে এবং খানকে সরিয়ে দিতে হবে। এটি পাকিস্তানের বাইরের দেশগুলোর কাছেও খুব একটা অজনপ্রিয় পদক্ষেপ ছিল না। কারণ, ইমরান খান কার্যত পাকিস্তানের সব ঐতিহ্যবাহী মিত্রদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলেন।

ইমরান আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতায় ফেরাকে উদ্‌যাপন করেছিলেন; তাঁকে উৎখাত করার চক্রান্তের জন্য প্রকাশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করেছেন এবং রাশিয়া ইউক্রেনে সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করার কয়েক ঘণ্টা পরে মস্কোতে গিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দেখা করেছেন।

এ ছাড়া চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর প্রকল্পকে নাকচ করে ইমরান চীনকেও বৈরী করে তুলেছেন এবং কিছু ইস্যুতে তুরস্ক এবং মালয়েশিয়ার সঙ্গে তিনি পাকিস্তানকে এক কাতারে দাঁড় করিয়েছেন। এটিকে ইসলামি বিশ্বের সৌদি নেতৃত্বকে অবমূল্যায়ন হিসেবে দেখা হচ্ছিল।

ইমরান খানকে অপসারণ করাকে সামরিক বাহিনীর পুরোনো পাকিস্তানকে পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, সেনাবাহিনী এমন একটি গণতান্ত্রিক চেহারার সরকার গড়তে চায় যে সরকার যুক্তরাষ্ট্র (যার ওপর সেনাবাহিনী সামরিক সহায়তার জন্য নির্ভর করে) এবং চীন (যারা বেশির ভাগ বেসামরিক সহায়তা দিয়ে থাকে) উভয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখবে। একই সঙ্গে সেনাবাহিনী যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে নিজেদের ফায়দা হাসিলেরও চেষ্টা করতে চায়।

সামরিক বাহিনী একটি মধ্যপন্থী সৌদিকেন্দ্রিক ইসলামিক বিশ্বে পাকিস্তানের পুরোনো ভূমিকাকে পুনরুজ্জীবিত করতে চায়। একই সঙ্গে তারা চরম ইসলামপন্থী দখলদারির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো একটি ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করতে চায়। কিন্তু পাকিস্তান সর্বশেষ এ ধরনের গেম খেলার পর থেকে বিশ্ব অনেকখানি বদলে গেছে। পাকিস্তানের দ্বৈত চরিত্রকে প্রশ্রয় দেওয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন আগের তুলনায় অনেক কম আগ্রহী।

যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা এখন আর আফগানিস্তানে নেই। সর্বোপরি, ক্রমবর্ধমানভাবে চীনের ‘দালাল’ হয়ে ওঠা পাকিস্তান এখন আর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে চীনকে দমনের হাতিয়ার হিসেবে ততটা বিবেচিত হয় না। বরং চীনের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যুক্তরাষ্ট্র এখন পাকিস্তানের চেয়ে ভারতকে বেশি কার্যকর অংশীদার মনে করে।

অন্যদিকে সৌদি আরব একটি চমকপ্রদ আধুনিকীকরণ কর্মসূচি শুরু করেছে। এর মধ্য দিয়ে দেশটি ইসলামি রক্ষণশীলতার ঘাঁটি হিসেবে তার আগের পরিচয়কে বদলে ফেলছে।

সুতরাং, এ কথা বলা যায়, ভারত এখন পাকিস্তানের বাইরে তাকানোর সামর্থ্য রাখে। প্রতিবেশী পাকিস্তানের চেয়ে ভারত এখন ১০ গুণ বড় অর্থনীতির দেশ। পাশাপাশি তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা এখন অনেক বিস্তৃত ও বৈশ্বিক। ফলে পাকিস্তান নীতি থেকে তার সরে আসার বা এ বিষয়ে নীতি পুনর্বিবেচনা করার সম্ভাবনা খুব কম।

  • স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

  • শশী থারুর ভারতের কংগ্রেস পার্টির এমপি, যিনি ইতিপূর্বে জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল এবং ভারতের পররাষ্ট্র ও মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

  • অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ