বেঁচে থাকার বিকল্প রেসিপি কী

‘ডেঙ্গুতে এক সপ্তাহের মধ্যে দুই ছেলে-মেয়েকেই হারালেন বাবা-মা’ এই প্রতিবেদনের প্রকাশের পর সহকর্মী মানসুরা হোসাইনকে একটি সন্তান হারানো এক বাবা ফোন করেন। উদ্দেশ্য নিঃস্ব এই মা-বাবার প্রতি সহানুভূতি জানানো। কারণ, তাঁর অন্তত একটি সন্তান এখনো বেঁচে আছে।

ঢাকা যখন ডেঙ্গুতে সন্তান হারানো মা-বাবার আর্তনাদে ছিঁড়ে-খুঁড়ে যাচ্ছে, চট্টগ্রামে নর্দমায় তখন তলিয়ে গেছে দেড় বছরের শিশু। একই সময়ে নরসিংদীর শিবপুরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ট্রাক ও মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে সাতজনের প্রাণ গেছে। ঢাকার রাস্তায় ছিনতাইকারীর হ্যাঁচকা টানে প্রাণ হারিয়েছেন নারী উদ্যোক্তা আমিনা হক। বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারদলীয় ছাত্রদের সংগঠন ছাত্রলীগের সম্মেলনে যোগ দিতে  ছাত্রদের বাধ্য করা হয়েছে এমন অভিযোগ উঠেছে। লালমনিরহাটে মন্ত্রীপুত্রের নির্দেশে মারধরের শিকার হয়েছেন প্রকৌশলী।

ইদানীং আমরা দেশের নানা সমস্যার সমাধানে রেসিপি পাই। কিন্তু এই দেশের মানুষের জন্য বেঁচে থাকার বিকল্প ‘রেসিপি’ কী হতে পারে? আমরা ডেঙ্গু মোকাবিলার রেসিপি পেয়েছি। গত ১০ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজের ৭৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হয়েছে, ‘আমাদের দেশের একটা সমস্যা হচ্ছে, যা কিছুই হোক, সব দোষ সরকারের। মশা মারে না কেন? কত মশা মারবে? মশার তো প্রজননের হার অনেক বেশি। কিন্তু মশার যেন সেই প্রজনন না হতে পারে, সে জন্য যার যার বাড়িঘর সাফ রাখতে হবে। নিজের বাড়িঘর পরিষ্কার রাখতে হবে।’

এর আগে ২০১৯ সালে বলা হয়েছিল, সংবাদমাধ্যমে ডেঙ্গুবিষয়ক খবর অনেক বেশি প্রকাশিত হচ্ছে এবং এর ফলে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে আর সেটাই সমস্যার সৃষ্টি করছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের রেসিপি অনুসরণ করে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ফজলে নূর তাপস বলেছেন, তিনি ডেঙ্গু মোকাবিলায় সফল। যদিও এর মধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন,মারা গেছেন প্রায় ৬শ।  আমরা মশা নিধনে মেয়র সাহেবকে সবুজ ঘাসে লোকজন নিয়ে মশার ওষুধ ছিটাতে দেখি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে।

যার অর্থ দাঁড়ায়, ইতিহাস বলে কবরের এই পাশে দাঁড়িয়ে আশা করতে নেই। তবে একবার না একবার প্রত্যাশিত ন্যায় বিচারের যে ঢেউ তা জেগে উঠতে পারে। তখনই আশা আর ইতিহাস এক সুরে গাইবে। তাই নিরাশ হবেন না। এই বঙ্গভূমে শ্বাস নেওয়ার জন্য যে নাগরিকদের আমৃত্যু খোঁটা শুনতে হয় তাঁরা রেসিপি খুঁজতে থাকুন।  

কথা হচ্ছে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই সিটিতে সবচেয়ে বেশি প্রায় ১৬ শতাংশ ক্ষেত্রে লার্ভা পাওয়া গেছে বসতবাড়ির মেঝেতে। সরকারি জরিপই বলেছে, জনবহুল ও নিচু এলাকায় ডেঙ্গু বেশি। এ নিয়ে গত ২৮ আগস্ট প্রথম আলো প্রতিবেদনও ছাপে। প্রথম আলোকে নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, যাত্রাবাড়ী থেকে শুরু করে মিরপুর পর্যন্ত কাজী নজরুল ইসলাম সরণি, মিরপুর সড়ক এবং শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সরণির দুই পাশ অর্থাৎ পূর্ব ও পশ্চিম দিকের এলাকাগুলো মূলত নিম্নাঞ্চল। রাস্তা উঁচু এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা নিচু হওয়ায় অনেকটা কচ্ছপের পিঠের মতো ঢালু অবস্থা তৈরি হয়েছে।

সন্তানদের ডেঙ্গুতে হারানোর দায় তো বাবা-মাকেই নিতে হবে, কারণ তাঁরা কেন যেখানে পরিকল্পিত নগরায়ণ হয়নি সেখানে বাসা নিয়েছেন? জবাবদিহি বাবা-মাকেই করতে হবে। নগর ঠিক রাখার দায়িত্ব যে যে সরকারি প্রতিষ্ঠানের, তাদের তো দোষ ধরা যাবে না! তাঁরা শিশুর মতো নিষ্পাপ, ফুলের মতো পবিত্র। তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনার দরকার নেই।

নালায় ভেসে যাওয়ার দায়ও জনগণের। কাজেই কেন চট্টগ্রামে উত্তর আগ্রাবাদের রঙ্গিপাড়া এলাকার নালায় ভেসে যেতে হয়েছে শিশু ইয়াছিন আরাফাতকে? আর ফতেহপুরের বাদামতলা এলাকার নালায় কলেজছাত্রী নিপা পালিতকে? গত বছর অটোরিকশাচালক ও তার যাত্রী, বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রী শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়া এবং সবজি বিক্রেতা ছালেহ আহমেদের মৃত্যুর দায় কার? চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন না চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের? এসব প্রশ্ন করা যাবে না। যতই বলুন, সামান্য বৃষ্টিতে নালাগুলো উপচে ওঠে, কোনটা পথ আর কোনটা নালা, তা বোঝা যায় না। এই দায় তো অবশ্যই চট্টগ্রামবাসীর। এ তাদের কপালের ফের।

সড়ক দুর্ঘটনার দায়ও অবশ্যই আমাদের নিতে হবে। কারণ, সড়কে অব্যবস্থাপনা নিয়ে গত মার্চে একটি সংবাদ প্রকাশের পরপরই সেতু বিভাগের সচিব মনজুর হোসেন এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিনউল্লাহ নুরি জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে এ কথা বলে দিয়েছেন। তাঁরা বলেন, মানুষ সচেতন নন। তাঁরা নিয়ম মানেন না। উল্টো পথে চলেন। পদচারী সেতু ব্যবহার না করে সড়ক দিয়ে পার হন। অথচ প্রতিবেদনটি ছাপা হয়েছিল মাদারীপুরের শিবচরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক্সপ্রেসওয়েতে ১৯ জনের মৃত্যুর পরপর। সেখানে উল্টো পথে চলা, পদচারী সড়ক ব্যবহার না করার কোনো বিষয় ছিল না। জানা গিয়েছিল, চালক টানা ৩০ ঘণ্টা ধরে বাস চালিয়েছিলেন এবং যে বাস তিনি চালাচ্ছিলেন, তার ফিটনেস ছিল না।

বলছিলাম, এ দেশে বেঁচে থাকার বিকল্প রেসিপি কী হতে পারে? চলুন আর কেউ রেসিপি দেওয়ার আগে আমরা ব্রেইনস্টর্মিং করি। প্রতিটি ঘটনাকে আমরা সৃজনশীল প্রশ্ন বলে ধরে নিই। প্রশ্ন ১. গত ২৫ আগস্ট সকালে ধানমন্ডিতে স্বামীর সঙ্গে রিকশায় থাকা অবস্থায় মোটরসাইকেল আরোহী ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে নারী উদ্যোক্তা সৈয়দ আমিনা হক (৫৮) মারা যান।  কী করলে তিনি বেঁচে থাকতে পারতেন? উত্তর ১. বাসায় বসে থাকলে। ২. অস্ত্র নিয়ে বাসা থেকে বের হলে। ৩. মন্তব্য নেই।

প্রশ্ন ২. ঢাকায় ছাত্রলীগের সমাবেশ উপলক্ষে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে নরকবাস করা শিক্ষার্থীদের ওপর এলান জারি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের ভয়েস ক্লিপ ঘুরছে। তাঁকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘...সমাবেশ শুক্রবারে। যারা যাবা না, তারা নিজ দায়িত্বে হলগুলো ছেড়ে দিয়ে বাইরে চলে যাও।’  কী করলে এই নির্দেশ এড়ানো যেত? উত্তর ১. বাবার টাকা থাকলে ২.অসুস্থতার অজুহাতে হল থেকে বহুদূরে চলে গেলে ৩. মন্তব্য নেই

প্রশ্ন ৩. লালমনিরহাট-২ (আদিতমারী-কালীগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের ছেলে রাকিবুজ্জামান আহমেদের ডাকে নির্বাহী প্রকৌশলী রকি চন্দ্র রায় ছুটে যাননি। সেই অভিযোগে ছাত্রলীগের সভাপতি শরিফুল ইসলামের নেতৃত্বে নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়। তাঁরা রকিকে লাঞ্ছিত করার সময় বলেন, ‘তুই জানিস রাকিব কে? তোকে এখানে মার্ডার করলে তোর কোন বাপ বাঁচাতে আসবে, তুই কাউকে পাত্তা দিস না?’ বিধি বহির্ভূতভাবে সংবাদমাধ্যমে কথা বলার জন্য তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। কী করলে এই ঝামেলা তিনি এড়াতে পারতেন? উত্তর ১. প্রকৌশলী না হলে ২. ছাত্রলীগ করলে ৩. বিদেশে গেলে (বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করলে মানবপাচারকারীদের পাল্লায় পড়ার আশঙ্কা আছে। এই দায়ে সরকারদলীয় এক সাংসদ সাজা খাটছেন বিদেশে)  

ডিমের দাম বাড়লে সেদ্ধ করে ফ্রিজে রাখার রেসিপি পেয়ে গেছি আমরা। চিন্তা ছিল আমরা যারা সকালে ডিম পোচ খাই তারা কি করব। আল্লাহর রহমতে ফেসবুকে তারও একটা নিদান পাওয়া গেছে। ডিম পোচ করে রোদে শুকিয়ে শুঁটকি করার পরামর্শ এসেছে সেখানে। আইরিশ কবি শেইমাস হিনি দ্য কিওর অ্যাট ট্রয় তে লিখেছিলেন, ‘হিস্ট্রি সেইস, ডোন্ট হোপ/ অন দিস সাইড অফ দি গ্রেভ/ বাট দেন ওয়ান্স ইন এ লাইফটাইম/ দ্য লংড ফর টাইডাল ওয়েভ অফ জাস্টিস ক্যান রাইজ আপ/ অ্যান্ড হোপ অ্যান্ড হিস্ট্রি রাইম’। যার অর্থ দাঁড়ায়, ইতিহাস বলে কবরের এই পাশে দাঁড়িয়ে আশা করতে নেই। তবে একবার না একবার প্রত্যাশিত ন্যায় বিচারের যে ঢেউ তা জেগে উঠতে পারে। তখনই আশা আর ইতিহাস এক সুরে গাইবে। তাই নিরাশ হবেন না। এই বঙ্গভূমে শ্বাস নেওয়ার জন্য যে নাগরিকদের আমৃত্যু খোঁটা শুনতে হয় তাঁরা রেসিপি খুঁজতে থাকুন।  

  • শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
    ই-মেইল: sabiha.alam@prothomalo.com