দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন গঠিত হলেও স্বাস্থ্য খাত সংস্কারে কমিশন গঠন করা হয়নি। এর বদলে গঠিত হয়েছে স্বাস্থ্যব্যবস্থা সংস্কারের জন্য ১১ সদস্যের প্যানেল। তাহলে কি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছেও স্বাস্থ্য খাত তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়? এ কমিটি যে শুধু দায়সারা, তার প্রমাণ দেওয়া যায়। কমিটি থেকে কোনো ধরনের প্রতিবেদন পাওয়ার আগেই ‘স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন ২০২৪’ অধ্যাদেশ আকারে পাসের চেষ্টা করা হচ্ছে। এ তো ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়ার মতো অবস্থা।
এ অধ্যাদেশে সেবাগ্রহীতা ও সেবা প্রদানকারীর সুরক্ষার বিষয়ে বেশ কিছু নির্দেশনা আছে। তবে আইনটির নামসহ অনেক ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা, ভাষাগতা দুর্বোধ্যতা, আইনি ভাষা প্রয়োগের অভাব, সেবাগ্রহীতা ও সেবা প্রদানকারীর কার্যকর সুরক্ষার দিকনির্দেশনার অভাবসহ নানা ধরনের দুর্বলতা লক্ষণীয়।
উদাহরণ দেওয়া যাক। ‘ব্যক্তিগত চেম্বারে বেসরকারি চিকিৎসাসেবা’র ক্ষেত্রে রোগীর ব্যবস্থাপত্রে ‘সুস্পষ্টভাবে জেনেরিক ঔষধের নাম বড় অক্ষরে লিখিতে হইবে’ মর্মে একটি ধারা আছে। ধারায় বেসরকারি ও সরকারি হাসপাতালের কথা কিছু বলা হয়নি। কেন শুধু ‘ব্যক্তিগত চেম্বারে বেসরকারি চিকিৎসাসেবা’র ক্ষেত্রে এ ধারা প্রযোজ্য হবে? এ ধারা প্রয়োগের ক্ষেত্রেও বেশ জটিলতা দেখা দেবে। কেননা, এ ধারার প্রয়োগ তখনই সম্ভব হবে, যখন সব ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি সমমানের ওষুধ উৎপাদন করবে।
বিদেশি স্বাস্থ্যসেবাদানকারী ব্যক্তি কর্তৃক সেবা প্রদানসংক্রান্ত বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি সাপেক্ষে এই আইনের অধীন প্রণীত বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে বিনা মূল্যে বা অর্থের বিনিময়ে চিকিৎসাসেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে কোনো হাসপাতালে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে বিদেশি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ব্যক্তিকে নিয়োগ করা যাইবে।’ এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) থেকে লাইসেন্স প্রাপ্তির প্রয়োজন হবে কি না, তা উল্লেখ করা হয়নি। উল্লেখ্য, বিএমডিসির লাইসেন্স ছাড়া কোনো বিদেশি চিকিৎসক মেডিকেল এথিকস অনুযায়ী রোগীর সংস্পর্শে আসা সমীচীন নয়।
আবার বেশ কিছু ধারা ও উপধারার অন্তর্ভুক্তিতে অধ্যাদেশটি ভারবাহী হয়েছে। অন্যদিকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ পড়েছে। যেমন সুনির্দিষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়নি প্রেক্ষাপট, যৌক্তিকতা ও উদ্দেশ্য। স্বাস্থ্যকে ‘উন্নয়ন এজেন্ডা’ হিসেবে বিবেচনা করা এবং সে অনুযায়ী গুরুত্ব প্রদান করার বিষয় সংযোজন করা হয়নি। দেশের সব নাগরিকের জন্য বৈষম্যহীনভাবে ও স্বল্পমূল্যে গুণগত মানের সব ধরনের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে বর্তমান স্বাস্থ্যব্যবস্থা যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, তা মোকাবিলায় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও অর্থায়নের পদ্ধতির যে সংস্কার প্রয়োজন, তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি।
অধ্যাদেশে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় রেফারাল ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রবিধান তৈরি করার বিষয় উল্লেখ আছে। কিন্তু রেফারাল ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য কোনো সুস্পষ্ট ঘোষণা নেই। তা ছাড়া বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় রেফারাল ব্যবস্থা প্রবর্তনের কোনো ধারাও সংযোজন করা হয়নি।
এই অধ্যাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য, বয়োবৃদ্ধদের স্বাস্থ্যসেবা, নবোদ্ভূত রোগের (ইমার্জিং) প্রতিরোধ ও প্রতিকার বিষয়ে কোনো কিছু উল্লেখ নেই। নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবার জন্য গুণগত মানের স্বাস্থ্য–কর্মশক্তি তৈরির লক্ষ্যে বিএমডিসিকে শক্তিশালী করা দরকার। এর মাধ্যমে সব ধরনের ক্লিনিক্যাল হেলথ ওয়ার্কফোর্সের মেডিকেল প্র্যাকটিসের সনদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে লাইসেন্সিং পরীক্ষা চালু এবং তিন থেকে পাঁচ বছর পরপর লাইসেন্স নবায়নের পরীক্ষা চালুর বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। সংযোজিত হয়নি স্বাস্থ্য–কর্মশক্তি বাহিনীর ইন্টার্নশিপ ও প্রশিক্ষণ ভাতা যুগোপযোগী করার কোনো ধারা। স্বাস্থ্য–কর্মশক্তি বাহিনীকে অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্য কোনো বিশেষ ব্যবস্থার কথা উল্লেখ নেই।
স্বাস্থ্য–কর্মশক্তি বাহিনীর সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য নিরন্তর পেশাগত দক্ষতার ব্যবস্থা (কন্টিনিউয়াস প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সিস্টেম) তৈরির কোনো ধারা সংযোজিত হয়নি। সংযোজিত হয়নি স্বাস্থ্য ক্যাডারে নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা, মেডিকেল শিক্ষা, মেডিকেল প্রশাসন ও জনস্বাস্থ্যে পৃথক ধারা প্রবর্তনের বিষয়ে কোনো ধারা। তা ছাড়া বাংলাদেশে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মতো হেলথ সার্ভিস কমিশন গঠনের বিষয়টির উল্লেখ প্রয়োজন ছিল। বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স পরিচালনার নীতিমালা নির্ধারণ ও রেজিস্ট্রেশনের বিষয়ে কোনো ধারা নেই এতে। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দুটি বিভাগকে একত্রীকরণ অথবা পুনর্বিন্যাসের বিষয়ে নির্দিষ্ট ধারা প্রয়োজন ছিল। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন অধিদপ্তরের মধ্যে কীভাবে সমন্বয় হবে, বিষয়টি অমীমাংসিত থেকে গেছে।
নানাভাবে বিভাজিত ও বিক্ষিপ্ত ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) পরিবর্তে একটি শক্তিশালী ডিজিটাল হেলথ ইকোসিস্টেম তৈরি করার লক্ষ্যে সমন্বিত ও আন্তসংযুক্ত এমআইএস প্রবর্তনের বিষয়ে সুরাহার কোনো কথা নেই সেখানে।
স্বাস্থ্য কার্ড, সরকারি স্বাস্থ্য ইনস্যুরেন্স কাভারেজ ব্যবস্থা প্রবর্তনসহ পৃথক ব্যবস্থার ধারা থাকলেও তা বাস্তবায়ন নিয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু নেই। উল্লেখ করা হয়নি সেসব ব্যবস্থাপনার জন্য ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান গঠন, কার্যক্রম ও অর্থায়নের বিষয়ে কোনো কিছু। বেসরকারি হাসপাতালে নিয়মিত সেবা কার্যক্রম চালু রাখার জন্য ক্লিনিক্যাল কর্মী বাহিনী নিয়ে বলা নেই কিছু। উল্লেখ প্রয়োজন ছিল রোগীর সুরক্ষা নিশ্চিতে অপ্রয়োজনীয় অপারেশন ও অপ্রয়োজনীয় আইসিইউর ব্যবহার রহিত করার জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে শক্তিশালী করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণই–বা কীভাবে হবে? ওষুধের দাম নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য অন্যান্য দেশের মতো ‘ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল প্রাইসিং অথরিটি’ গঠন কি প্রয়োজন নেই? এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড এবং কেন্দ্রীয় ঔষধাগার শক্তিশালীকরণ তো অনুল্লেখিতই রয়ে গেছে। উল্লেখ করা হয়নি প্রেসক্রিপশন অডিট ব্যবস্থার কথা। সরকারি হাসপাতালে ওষুধের আধুনিক স্টোরেজ ফ্যাসিলিটিসহ সামগ্রিক সাপ্লাই চেইন ও ওষুধের গুণগত মান রক্ষা কীভাবে নিশ্চিত করা হবে?
প্রশিক্ষণ ও গবেষণার ক্ষেত্রে নিপোর্ট, হেলথ ইকোনমিকস ইউনিট ও বিএমআরসির মধ্যে সমন্বয় সাধন প্রয়োজন। দরকার গবেষণার ফলাফল ও সুপারিশগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন। দরকার জনস্বাস্থ্য শিক্ষার দ্বৈততা বিলোপ করতে নিপসম, আপিএইচ ও আইপিএসএনকে একই ছাতার নিচে আনা। এসব সেখানে অনুপস্থিত।
উল্লিখিত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে আইনটি পাস করে তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হলে দেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থার যুগান্তকারী পরিবর্তনের আশা করা যায়। আর আইনটি যদি যেমন আছে সেভাবেই পাস করা হয়, তাহলে দেশের দীর্ঘ আইনের তালিকায় আরেকটা আইন যুক্ত হবে শুধু; কাজের কাজ কিছু হবে না। বরং এই আইনের শিরোনামে ‘স্বাস্থ্যসেবা’ থাকায় বৈষম্যহীন, স্বল্পমূল্যে গুণগত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে ‘জাতীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন’ নামে আরেকটি আইন পাসের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
এ ক্ষেত্রে দুটি উপায় আছে। একটি হলো এই আইনে ওপরে বর্ণিত অসম্পূর্ণতা এবং যত দুর্বলতা ও অস্পষ্টতা আছে, তা বহাল বিশেষজ্ঞ প্যানেলের মাধ্যমে অথবা নতুন টাস্কফোর্স দিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে চূড়ান্ত করা। অন্যটি হলো এই আইন বিভিন্ন মহলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাপেক্ষে ‘স্বাস্থ্যসেবা গ্রহীতা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর সুরক্ষা আইন, ২০২৪’ নামে চূড়ান্ত করা। দ্বিতীয় পথটি গ্রহণ করা হলে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে ‘জাতীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন’ নামে আরেকটি আইন তৈরির উদ্যোগও নিতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার এসব পরামর্শ আমলে নিয়ে অগ্রসর হবে, এমনটাই বাঞ্ছনীয়।
● ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এবং আহ্বায়ক, অ্যালায়েন্স ফর হেলথ রিফর্মস বাংলাদেশ (এএইচআরবি)