ত্বকী হত্যা: সরকার কেন খুনিদের রক্ষায় দাঁড়ায়

ক্রমাগত নির্যাতনে একসময়ে ছেলেটি নিহত হলে তাকে ভাসিয়ে দিয়েছে শীতলক্ষ্যা নদীতে। এই উজ্জ্বল প্রাণবন্ত কিশোরের নাম তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী।
ফাইল ছবি

একজন কিশোর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গল্প লেখে, কবিতা লেখে, ছবি আঁকে আর প্রচুর পড়তে ভালোবাসে। ঘরে মা-বাবার বইপত্র পড়ার পরও তার সাধ মেটে না, পড়ার জন্য নিয়মিত পাঠাগারে যায়। এত আগ্রহের মধ্যে থেকেও পরীক্ষার ফলও সবার চেয়ে ভালো করে। এই ছেলে নারায়ণগঞ্জের সুধীজন পাঠাগারে প্রতিদিনের মতো সেদিনও যাচ্ছিল, ২০১৩ সালের ৬ মার্চ। পথ থেকে তাকে তুলে নিয়ে গেল এ অঞ্চলের খুনি–মাফিয়া হিসেবে পরিচিত পরিবারের ছেলের নেতৃত্বে খুনি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। নিয়ে গেল তাদের টর্চার সেলে। তাদের সঙ্গে এই ছেলের বিবাদ হবে কীভাবে? দেখা হওয়ারই তো সুযোগ নেই। জগৎই তো আলাদা। বহুজন মিলে এই কিশোরের ওপর কতভাবে যে নির্যাতন করেছে, যার বর্ণনাও সহ্য করা কঠিন, সেগুলোই তারা করেছে। ক্রমাগত নির্যাতনে একসময়ে ছেলেটি নিহত হলে তাকে ভাসিয়ে দিয়েছে শীতলক্ষ্যা নদীতে। এই উজ্জ্বল প্রাণবন্ত কিশোরের নাম তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী।

ত্বকীর আগে-পরে এ নদীতে এসব খুনির হাতে নিহত আরও বেশ কয়েকজনের লাশ পড়েছে। এই দুর্বৃত্তদের অবিরাম নৃশংস অপরাধ দেখে মনে হয়, জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মূল কাজ হলো এ রকম খুনি-চাঁদাবাজ-লুটেরাদের রক্ষা করা। কেন এই খুনিরা ত্বকী নামের কিশোরকে এভাবে নির্যাতন করে হত্যা করেছিল? আমরা জানতে পারি, করেছিল তার বাবা শিল্পী-সংগঠক রফিউর রাব্বিকে ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়ার জন্য। কেননা, তিনি তাদের চাঁদাবাজি, জুলুম, গুম-খুনের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করছিলেন।

ত্বকী হত্যার ১০ বছর পার হয়েছে। এর আগে-পরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আরও অনেক খুন হয়েছে, যার কোনো বিচার হয়নি। দুটি ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করতে পারি—সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার পর ১১ বছর পার হয়েছে; সোহাগী জাহান তনু ধর্ষণ ও হত্যার পরও সাত বছর পার হয়েছে। এগুলোর সাধারণ তদন্তও এখনো শেষ হয়নি। ত্বকী হত্যার পর প্রবল আন্দোলনের কারণে এ ক্ষেত্রে একটু ভিন্নতা তৈরি হয়েছিল। খুনের এক বছরের মাথায় মামলার তদন্তকারী সংস্থা কেন, কখন, কোথায়, কারা এবং কীভাবে ত্বকীকে হত্যা করেছে, তা বিস্তারিত বের করে তা সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশ করেছিল। কিন্তু খুনি শনাক্ত হওয়ার পরপরই সবকিছু আটকে যায়, এ হত্যার অভিযোগপত্র আর আদালতে পেশ করা হয়নি। সরকারের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপেই যে বিচার আটকে যায়, তা এখন সবার কাছেই স্পষ্ট।

বহু বছর ধরে কোনো দেশের সরকার যদি কোনো রকম জবাবদিহির মধ্যে না থাকে, নির্বাচনসহ গণতান্ত্রিক সব প্রতিষ্ঠান খেয়ে ফেলে একক কর্তৃত্ব বজায় রাখতে চায়, তখন তার নানা রকম লাঠিয়াল বাহিনী লাগে। এসব বাহিনীই এখন নানা নামে বিভিন্ন স্থানে দাপট চালাচ্ছে। বর্তমান সরকার চায় সমাজে নতুন জ্ঞান, চিন্তা, সৃজনশীলতা নয়, শুধু হবে তার প্রশস্তি, তার বয়ানের সঙ্গে ঠোঁট মেলানো, স্বাধীন সৃজনশীল মানুষের বদলে এখানে থাকবে তার নির্দেশে ওঠবস করা কিছু প্রাণী বা রোবট!

যে সরকার সব সময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে, তারা কেন একের পর এক চেতনাবিরোধী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়, তারা কেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষদের যারা হত্যা করে, বিনাশ করতে চায় তাদের রক্ষায় সর্বশক্তি নিয়োগ করে—এ প্রশ্ন বারবার ঘুরে ঘুরে আসে। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে বর্তমান ক্ষমতার ব্যাকরণ আমাদের সামনে হাজির হবে।

বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছিল পাকিস্তান থেকে গুণগতভাবে ভিন্ন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু বাংলাদেশ এখন কার্যত চলছে পাকিস্তান মডেলে। পাকিস্তান আমলে ২২ পরিবার নামক ক্ষুদ্র গোষ্ঠী দেশ শাসন করেছে। বর্তমান বাংলাদেশে তা আরও পোক্ত হয়েছে। অদৃশ্য ক্ষমতা দিয়ে গণতান্ত্রিক সব ব্যবস্থাকে অচল করে দেশ পরিচালনায় বাংলাদেশ এখন বহু দেশের ওপরে। উপরন্তু, সব প্রতিষ্ঠান দুমড়েমুচড়ে ফেলা হয়েছে, কোনো প্রতিষ্ঠান স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না, ওপরের নির্দেশেই সব সিদ্ধান্ত হয়। রাজতন্ত্রের কাঠামো ভর করেছে দেশের ক্ষমতাকাঠামোর ওপর।
দেশে এ রকম ব্যবস্থা স্থায়ী না হলে কি ক্ষমতা আর সম্পদের কেন্দ্রীভবন সম্ভব? একের পর এক ব্যাংক লোপাটের মাধ্যমে সর্বজনের সম্পদ কতিপয় ব্যক্তি বা গোষ্ঠী লুট করে পাচার করছে। উন্নয়নের নামে সুন্দরবন থেকে কক্সবাজার-বিনাশী নানা প্রকল্প হচ্ছে, আদানিসহ বিভিন্ন চুক্তি হচ্ছে, যা দেশকে দীর্ঘদিনের জন্য পঙ্গু করার আয়োজন ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। নদী নর্দমায় পরিণত হচ্ছে বা উধাও হয়ে যাচ্ছে কিছু

দখলদারের জন্য বা তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য। বায়ুদূষণে মানুষ দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থ জাতিতে পরিণত হচ্ছে। খেলার মাঠ ও পার্কগুলো চলে যাচ্ছে মুনাফাখোরদের হাতে। সড়ক অব্যবস্থাপনায় প্রতিদিন মানুষ খুন হচ্ছে। অনেক ভালো বিকল্প থাকা সত্ত্বেও একের পর এক গ্যাস-তেল-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে মানুষের জীবন দুঃসহ করে তোলা হয়েছে। করোনা মহামারি আর সাম্প্রতিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে দারিদ্র্যের অনুপাত দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সময়ে কিছু ধনিক গোষ্ঠীর হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভবনও বেড়েছে, আর এরাই দেশের পরিচালক।

এসব কাণ্ডে দেশের মানুষের কী হাল হলো, মরল না বাঁচল, তারা কী মনে করছে, তা নিয়ে সরকারের কিছু আসে-যায় না। কারণ, তারা তাদের ক্ষমতার জন্য জনগণের ওপর নির্ভর করে না, নির্ভরতা তাই দেশের বিভিন্ন কেন্দ্রের সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, মাফিয়া, দখলবাজদের ওপর। সেই সঙ্গে নির্ভরতা ক্ষমতাবান বিদেশি রাষ্ট্র ও গোষ্ঠীর ওপর। এদের খুশি রাখাই বর্তমান রাষ্ট্রনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য।

বহু বছর ধরে কোনো দেশের সরকার যদি কোনো রকম জবাবদিহির মধ্যে না থাকে, নির্বাচনসহ গণতান্ত্রিক সব প্রতিষ্ঠান খেয়ে ফেলে একক কর্তৃত্ব বজায় রাখতে চায়, তখন তার নানা রকম লাঠিয়াল বাহিনী লাগে। এসব বাহিনীই এখন নানা নামে বিভিন্ন স্থানে দাপট চালাচ্ছে। বর্তমান সরকার চায় সমাজে নতুন জ্ঞান, চিন্তা, সৃজনশীলতা নয়, শুধু হবে তার প্রশস্তি, তার বয়ানের সঙ্গে ঠোঁট মেলানো, স্বাধীন সৃজনশীল মানুষের বদলে এখানে থাকবে তার নির্দেশে ওঠবস করা কিছু প্রাণী বা রোবট! এগুলো তো এমনি এমনি হবে না, তার জন্য লাগবে মাস্তান ও মেরুদণ্ডহীন কিছু লোক।

তাদের দাপট যতই থাকুক, ইতিহাস বলে, একদিন অবশ্যই ত্বকী, সাগর-রুনি, তনুসহ অসংখ্য নিহত মানুষের খুনিদের বিচার হবে। খুনিদের যারা বছরের পর বছর রক্ষা করছে, তাদেরও বিচার হবে। বছরের পর বছর দেশে অনেক গুম-খুন হয়েছে। যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণের পর খুন হওয়া নারীর সংখ্যা অগণন। এগুলোর বিরুদ্ধে অনেক জায়গায় প্রতিবাদ হলেও বিভিন্ন কারণে তা ধরে রাখা যায়নি। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ, রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন যে ঐক্য ও দৃঢ়তা নিয়ে এক দশক ধরে ত্বকীর খুনিদের বিচার আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন, তা সারা দেশের জন্যই অনুপ্রেরণা ও শক্তির উৎস। খুনি গোষ্ঠী এখনো ক্ষমতার দাপট দেখাচ্ছে, ভয়ভীতি দেখানোর চেষ্টা অব্যাহত আছে। এসব দাপট সত্ত্বেও অপরাধীরা জানে, তাদের ভেতরের আতঙ্ক জানায় যে আজ, কাল বা পরশু তাদের বিচারের সম্মুখীন হতেই হবে।

  • আনু মুহাম্মদ অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সর্বজনকথা পত্রিকার সম্পাদক