দেশে মেধাবী তরুণদের ধরে রাখার কি কোনো উপায় নেই

যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার্থী ভর্তিতে সম্প্রতি রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ
ছবি: ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষে অনেক লোক মারা যান। সে সময়ে খাদ্য উৎপাদনের জন্য অবকাঠামো, কৃষির সরঞ্জাম ইত্যাদি বলতে তেমন কিছুই ছিল না। আজ আমরা বিশ্বে ধান, মাছ ও শাকসবজি উৎপাদনে যথাক্রমে চতুর্থ ও তৃতীয়। প্রায় ১৭ কোটির জনবহুল এ দেশে আমরা খাদ্যে বলতে গেলে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমরা এখন কিছু কৃষিজাত পণ্য রপ্তানিও করছি। এসব অর্জন সম্ভব হয়েছে কৃষিতে সরকারের যথেষ্ট গুরুত্ব, ভালো বিনিয়োগ, প্রণোদনা, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যৌথ গবেষণার ফলে।

মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নয়নশীল, তারপর ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পরিণত করতে বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করছে সরকার। কর্মসংস্থান তৈরি করতে আরও ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করছে। গাড়ি নির্মাণের জন্য যৌথ কারখানা তৈরি করেছে। রেফ্রিজারেটর, এসি, মুঠোফোন, কম্পিউটার স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা হচ্ছে। উদ্ভাবনী, জ্ঞানভিত্তিক ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ উন্নত টেকসই রাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে কৃষির মতো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষায় দক্ষ যুবসমাজ, উচ্চশিক্ষা, গবেষণা, বাজেট বাড়ানো, প্রতিভাবানদের পৃষ্ঠপোষকসহ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে সরকারকে।

এখন অবশ্য আগের চেয়ে গবেষণায় বাজেট বৃদ্ধির সক্ষমতা বেড়েছে, উচ্চশিক্ষা গ্রহণে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ এবং শিক্ষক ও বিজ্ঞানীদের জন্য বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপের বন্দোবস্ত করেছে সরকার। আবার অনেক মেধাবী নিজ চেষ্টায় উন্নত দেশে বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে বিদেশে যান। প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপের মাধ্যমে যেসব সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষক ও বিজ্ঞানী উচ্চশিক্ষা গ্রহণে বিদেশে যান, তাঁদের বেশির ভাগই দেশে ফেরেন। কিন্তু যাঁরা নিজ উদ্যোগে যান, তাঁদের বেশির ভাগই দেশে ফেরেন না। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বাস্তবায়নে সব উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিনির্ভর ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান পুরোটাই নির্ভর করছে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক শিক্ষা ও গবেষণায় বিনিয়োগ, মেধাবীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ।

তরুণ মেধাবীরা, যাঁরা দেশে থাকতে চাচ্ছেন না, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে অন্যতম কারণগুলো জানার চেষ্টা করলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাকাজ চালিয়ে যাওয়ার মতো পিএইচডি ও পোস্ট ডক্টরাল পর্যায়ে ভালো ফেলোশিপসহ মানসম্মত শিক্ষার্থী না পাওয়া এবং গবেষণার অবকাঠামো ও প্রয়োজনীয় বরাদ্দ না থাকার কারণে তাঁরা গবেষণায় পিছিয়ে পড়েন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, জিডিপির আকারে গবেষণা ও উন্নয়নে ব্যয় বাংলাদেশে শূন্য, ভারতে প্রায় ১%, চীনে ২.৫%, যুক্তরাষ্ট্রে ৩.৫%।

দেশে বর্তমানে প্রায় ৩০ শতাংশ কর্মক্ষম তরুণ সমাজ রয়েছে। উন্নয়নকে টেকসই করতে যাদের মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে, তারা এ তরুণ সমাজ। তারুণ্য শক্তিকে কাজে লাগানোর এক উৎকৃষ্ট সময় পার করছে দেশ। অনেক দেশ যোগ্য লোকের অভাবে অর্থনীতির ভিত ধরে রাখতে পারছে না।

প্রতিটি উন্নত দেশই কোনো এক প্রজন্মের মেধা, ত্যাগ, কঠোর পরিশ্রম ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশকে উন্নত কাতারে নিয়েছে। তরুণদের মেধা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে না পারলে দেশের উন্নয়ন টেকসই হবে না, প্রযুক্তিতে পরনির্ভরশীলতা ঘুচবে না, ভালো নেতৃত্ব আসবে না। এতক্ষণ যা বললাম, আমরা সবাই তা জানি ও বিশ্বাসও করি বটে। তাহলে আমরা দিন দিন দেখতে পাচ্ছি, মেধাবী তরুণেরা দলে দলে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়ায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ শেষে আর দেশে ফিরছেন না।এমনকি অনেকে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া সম্পদও একসময় বিক্রি করে তাঁদের নতুন ঠিকানায় নিয়ে যাচ্ছেন। এই মেধাবী প্রকৌশলী, চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী বানাতে জনগণের ঘাম ঝরানো করের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা লগ্নির জবাবদিহি থাকা দরকার। তাঁদের ধরে রাখার বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এ বিষয়ে লেখালেখি ও আলোচনার কমতি হয়েছে বলে আমি মনে করি না, কিন্তু দৃশ্যমান কোনো সাফল্য লক্ষ করা যাচ্ছে না।

ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) শিক্ষকতা করার সুবাদে যাঁরা এখানে পড়েছেন কিংবা যাঁরা হার্ভার্ডে পড়ছেন এবং যাঁরা পড়ে গিয়েছেন, তাঁদের কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পেরেছি, তাঁদের সবার দেশে সম্মানজনক চাকরি থাকা সত্ত্বেও দেশে থাকতে চাচ্ছেন না। আবার অনেকে ভালো চাকরি, সুযোগ-সুবিধা, নিরাপত্তা ও সঠিক মূল্যায়নের অভাবে দেশে যেতে অপারগতা প্রকাশ করছেন। এ কথা অনস্বীকার্য, ১০ বছর আগে দেশ থেকে যে পরিমাণ মেধাবী বিদেশে স্থায়ী হয়েছেন, তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি মেধাবী আজ দেশ ছাড়ছেন, কিন্তু ফিরে আসার সংখ্যা খুবই কম। এ ব্যাপারে তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে সঠিক সংখ্যাটি বের করে তার কারণগুলো নিরূপণ করা উচিত বলে আমি মনে করি।

একটি হতে পারে, দিনে দিনে দেশে সুযোগ-সুবিধা কমে যাচ্ছে অথবা মেধাবী তরুণদের মনমানসিকতার আমূল পরিবর্তন হচ্ছে অবাধ সুযোগের কারণে। এখনই বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণাপ্রতিষ্ঠান কিংবা রাজনীতিতে মেধাবী লোকদের সংকট দেখা দিয়েছে, তাহলে ভবিষ্যতে আমরা কেমন বাংলাদেশ দেখতে চাচ্ছি? একটি স্মার্ট, নিরাপদ, জ্ঞানভিত্তিক, সমতা ও সাম্যপূর্ণ দেশ কি আমরা মেধাবী তরুণদের কাছে দিয়ে যেতে চাই না?

আগে দেখেছি, অনেকেই অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ ও হার্ভার্ড ইত্যাদিতে পড়ে, এমনকি সেখান থেকে শিক্ষকতা ছেড়েও দেশে গিয়েছেন। অনেকে হয়েছেন বিজ্ঞানী, উদ্যোক্তা, ব্যাংকের গভর্নর, মন্ত্রী, উপদেষ্টা। এখন আমরা কি বলতে পারব কয়েকজন চৌকস তরুণ মেধাবীর নাম, যাঁরা এমআইটি, অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ কিংবা হার্ভার্ডে পড়ে দেশে ফিরে শিক্ষা, গবেষণা কিংবা উদ্যোক্তা হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং দেশে স্থায়ী হতে বদ্ধপরিকর? যা দেখছি এবং ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করলে হতাশ হয়ে যাই।

তরুণ মেধাবীরা, যাঁরা দেশে থাকতে চাচ্ছেন না, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে অন্যতম কারণগুলো জানার চেষ্টা করলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাকাজ চালিয়ে যাওয়ার মতো পিএইচডি ও পোস্ট ডক্টরাল পর্যায়ে ভালো ফেলোশিপসহ মানসম্মত শিক্ষার্থী না পাওয়া এবং গবেষণার অবকাঠামো ও প্রয়োজনীয় বরাদ্দ না থাকার কারণে তাঁরা গবেষণায় পিছিয়ে পড়েন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, জিডিপির আকারে গবেষণা ও উন্নয়নে ব্যয় বাংলাদেশে শূন্য, ভারতে প্রায় ১%, চীনে ২.৫%, যুক্তরাষ্ট্রে ৩.৫%।

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বার্ষিক মোট বাজেটের ১%–এর নিচে গবেষণায় ব্যয় হয়।
প্রথমত, যোগ্যতা অনুযায়ী কাজের সুযোগ, যথাযথ মূল্যায়ন, যানজট, বায়ুদূষণ ও সামাজিক নিরাপত্তার প্রভূত অভাবের কারণে মেধাবীরা দেশে থাকতে চান না। দ্বিতীয়ত, সাধারণত মেধাবীদের মধ্যে অনেকের স্বামী–স্ত্রী উভয়েই চাকরি করেন। তাঁদের সন্তানদের জন্য দেশে স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ ডে–কেয়ার সেন্টার নেই। আবার থাকলেও পর্যাপ্ত সময় পর্যন্ত তাঁদের সন্তানদের ডে-কেয়ারে রাখার ব্যবস্থা নেই। তারা দাদা-দাদি, নানা-নানি কিংবা কাজের লোকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠুক, তাঁরা তা চান না।

এসব সমস্যার সমাধান আমরা প্রতিবেশী ভারত কিংবা চীনের দিকে তাকালেই দেখতে পাই।

এক. বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভারতের রামানুজন ও চীনের ইয়ং থাউজেন্ডস্ ট্যালেন্ট ফেলোশিপের অনুরূপে দেশে চালু করা। এর মাধ্যমে প্রতিভাবানদের উচ্চ বেতন প্রদান, পিএইচডি ও পোস্ট ডক্টরাল পর্যায়ে গবেষণা করার জন্য উন্নতমানের ফেলোশিপ দেওয়া। শর্ত থাকবে, বছরে নির্দিষ্টসংখ্যক পেটেন্ট, উন্নতমানের প্রবন্ধ প্রকাশ করতে হবে এবং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণা করতে হবে। পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের জন্য ভারত ও চীনের মতো বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে দেশে এনে গবেষণামূলক কাজের অবাধ সুযোগ তৈরি করে দেওয়া। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি কোম্পানি, এনজিও কিংবা ব্যক্তিপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রায়োগিক গবেষণা করার জন্য পর্যাপ্ত অনুদান প্রদানে এগিয়ে আসা। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে হার্ভার্ড ও এমআইটিতে বর্তমানে অনুদানের পরিমাণ হচ্ছে যথাক্রমে ৪০ ও ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

দুই. সর্বোপরি মেধাবীরা একটি নির্ঝঞ্ঝাট জীবন চান। যেখানে থাকবে না বাড়ি-গাড়ি করতে ঝামেলা, দখলদারি আর প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বিশেষ প্রটোকল ও সামাজিক মর্যাদার বিশেষ রকমসকম।

তিন. শিশুদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপত্তামূলক দক্ষ পেশাদারি জনবল দিয়ে ডে-কেয়ার সেন্টার সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত চালু রাখার ব্যবস্থা।
তাহলেই মেধা অবচয় থেকে মেধা ধরে রাখা কিছুটা সম্ভব হবে। তা না হলে দেশ একদিন মেধাশূন্য হয়ে উদ্ভাবনী, জ্ঞানভিত্তিক ও টেকসই উন্নত দেশ নির্মাণে পিছিয়ে থাকবে।

  • ড. মো: শফিকুল ইসলাম ভিজিটিং অধ্যাপক ও ফুলব্রাইট স্কলার, নিউক্লিয়ার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি), যুক্তরাষ্ট্র ও অধ্যাপক, নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
    ই–মেইল: msislam@mit.edu; msislam@du.ac.bd