ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারাবাহিকতায় এখন স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। এই লক্ষ্য পূরণের পথিকৃৎ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিরা হলেও এর মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করবে আজকের তরুণ প্রজন্ম। কারণ, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি আর নতুন প্রযুক্তিকে স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করার জন্য নবীনেরাই কান্ডারি।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট, ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি, অগমেন্টেড রিয়েলিটি, রোবোটিকস, বিগ ডেটা—এসব ডিজিটাল প্রযুক্তিতে তাঁরা সবার থেকে এগিয়ে। ফলে তাঁদের দৈনন্দিন লেনদেনে নগদ টাকার চেয়ে ডিজিটাল পদ্ধতিই বেশি মানানসই।
প্রযুক্তিবান্ধব নবীনদের ক্যাশবিহীন লেনদেনে অভ্যস্ত করতে হলে জানা দরকার কী কী সুযোগ–সুবিধা রয়েছে ডিজিটাল লেনদেনে। ক্যাশবিহীন লেনদেন যেমন সহজ, তেমনি দ্রুত ও নিরাপদ। নগদ টাকা বহনের খরচ ও সময় অপচয় দুটিই কমায়, লেনদেনে স্বচ্ছতা আনে। ভাংতি–ছেঁড়াফাটা-জাল ও জীবাণুযুক্ত টাকার ঝুঁকি কমায়।
এ ছাড়া নগদ টাকা ছাপানো, সংরক্ষণ, পরিবহন ও নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্রকে প্রচুর অর্থ ও ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হয়।
ডিজিটাল লেনদেনের অভ্যস্ততা বাড়লে এই খরচ ও ব্যবস্থাপনা উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব। পরিবেশবান্ধব অর্থনীতি ও কার্বন নিঃসরণ কমাতেও ক্যাশবিহীন লেনদেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সরকারের রাজস্ব সংগ্রহ, সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি, দুর্নীতি প্রতিরোধ, অপরাধ হ্রাস করে কল্যাণকর রাষ্ট্র বিনির্মাণে ডিজিটাল আর্থিক অন্তর্ভুক্তি জোরালো করা সময়ের দাবি।
ক্যাশবিহীন লেনদেনের ক্ষেত্রে বর্তমানে দেশে শুধু মোবাইল আর্থিক সেবা ও ব্যাংকের অনলাইনের মাধ্যমে লেনদেন হচ্ছে। এমএফএসে গত এক বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গড়ে প্রতি মাসে লেনদেন হচ্ছে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। ২০২৩ সালের নভেম্বরের লেনদেন পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় এমএফএস ব্যবহার করে লেনদেন হয়েছে ১ লাখ ১৯ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা আর অনলাইনে এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে অর্থ স্থানান্তরিত হয়েছে মোট ৮২ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা। অন্যদিকে এটিএম, পয়েন্ট অব সেলস, ক্যাশ রিসাইক্লিং মেশিন এবং ই-কমার্সে মোট লেনদেন হয়েছে ৪২ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা। (সূত্র: বাংলাদেশ ব্যাংক)
পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে, মানুষ ইতিমধ্যে ক্যাশবিহীন লেনদেনে কিছুটা হলেও অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০২৭ সালের মধ্যে দেশের ৭৫ শতাংশ লেনদেন ক্যাশবিহীন করার লক্ষ্য পূরণের সম্ভাবনা বাড়িয়েছে। তবে বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থে ক্যাশলেস হতে হলে নবীনদেরও ক্যাশবিহীন লেনদেনে অভ্যস্ত হতে হবে। এই লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের মোবাইল আর্থিক হিসাব খোলার সুযোগ করে দিয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই উদ্যোগ দেশের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কারণ, দেশের জনসংখ্যার অধিকাংশ শিশু ও তরুণ বয়সী, যারা এখনো ব্যাংক বা এমএফএসের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেনি। ২০২২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী দেখা যায় দেশের জনসংখ্যার অধিকাংশ শিশু ও তরুণ বয়সী (০-২৫ বছর বয়সীরা মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ)। আর এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে শুধু মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করলে দেখা যায় দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা কোটির ওপরে (বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী)। অথচ শুধু মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদেরই প্রতি মাসে বেতন, খাতা-কলম থেকে শুরু করে নানা ধরনের খরচ থাকে। জনগোষ্ঠীর এত বড় একটি অংশ এবার ডিজিটাল পেমেন্টের ইকোসিস্টেমের আওতায় আসবে।
বিকাশ নিজেও তার নিয়মিত মার্কেট-রিসার্চের অংশ হিসেবে ডিজিটাল-লিটারেসি সম্পন্ন প্রজন্ম তৈরির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে। এই প্রজন্মই ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হবে। ডিজিটাল লেনদেনে অভ্যস্ত জনগোষ্ঠী তৈরিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ ধরনের বিশেষ এমএফএস অ্যাকাউন্টের উদ্যোগকে বিকাশ সাধুবাদ জানায়।
অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে এই এমএফএস অ্যাকাউন্ট নতুন প্রজন্মকে ডিজিটাল পেমেন্টের ইকোসিস্টেমের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে এবং এটি তাদের আর্থিক লেনদেনের অভ্যাসে পরিবর্তন আনতে সাহায্য করবে। এ ছাড়া কর্মজীবনে তাঁরা আরও দক্ষতার সঙ্গে আর্থিক লেনদেন ও ব্যবস্থাপনা করতে পারবেন। নবীন গ্রাহকদের জন্য ব্যক্তিক অ্যাকাউন্ট খোলার এই সুযোগ বাংলাদেশের এমএফএস খাতের অগ্রযাত্রায় একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। এটি দেশের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে নিশ্চিতভাবে।
শেখ মো. মনিরুল ইসলাম অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এবং চিফ এক্সটার্নাল অ্যান্ড করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার, বিকাশ