বিশ্লেষণ

বিদ্যালয়ে বেতন–ফিতে বিস্তর ফারাক

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বেতন-ফি বৈষম্য দূর করতে সমন্বিত ব্যবস্থা চালুর পরামর্শ।

রাজধানীর মতিঝিলের আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রথম শ্রেণিতে একজন শিক্ষার্থীর মাসে বেতন ১ হাজার ৪৫০ টাকা। এই বিদ্যালয় থেকে হাঁটা দূরত্বে অবস্থিত মতিঝিল কলোনি উচ্চবিদ্যালয়ে একই শ্রেণিতে বেতন ৪০০ টাকা। দুটি বিদ্যালয়ই এমপিওভুক্ত। শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকার থেকে মূল বেতন ও কিছু ভাতা পান। অবশ্য দুটি বিদ্যালয়ের সব শিক্ষক এমপিওভুক্ত নন। অনেক শিক্ষক বিদ্যালয়ের আয়ে বেতন পান।

আবার কাছাকাছি দূরত্বের মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থীর মাসে বেতন মাত্র ৪ টাকা। আবার কাছের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনন্যা কিন্ডারগার্টেনে কেজি শ্রেণিতে একজন শিক্ষার্থীর মাসে বেতন দেড় হাজার টাকা।

বেতনের বাইরেও নানা অজুহাতে ‘ফি’ নেওয়া হয়। তবে শুধু এই চারটি বিদ্যালয় নয়, সারা দেশেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর বেতনসহ নানা ফিতে বিস্তর ফারাক দেখা যায়। সমন্বিত কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বিভিন্ন বিদ্যালয় বিশেষ করে বেসরকারি বিদ্যালয়গুলো নিজেদের মতো করে বেতন-ফি ঠিক করে। আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঠিকমতো পড়াশোনা না হওয়ায় কোচিং-প্রাইভেটেও খরচ করতে হয় অভিভাবকদের।

জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে ব্যয়ের ৭১ শতাংশই পরিবারকে বহন করতে হয়। এর মধ্যে কোচিং-প্রাইভেটের খরচও দিন দিন বাড়ছে। এনজিও বিদ্যালয়ে ফি সরকারি প্রতিষ্ঠানের তুলনায় তিন গুণ আর বেসরকারি কিন্ডারগার্টেনে ৯ গুণ বেশি।

শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বেতন ও ফির বিষয়ে একটি সমন্বিত ব্যবস্থা দরকার। এ ছাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো মাধ্যমিক পর্যন্ত স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ও এমপিওভুক্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করা গেলে এই বৈষম্য দূর করা যেত।

বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য বলছে, দেশে মাধ্যমিক স্তরে পড়ানো হয় ২০ হাজার ৯৬০ বিদ্যালয়ে। এগুলোতে মোট শিক্ষার্থী ১ কোটি ১ লাখের বেশি। অন্যদিকে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে প্রাথমিক স্তরের ১ লাখ ১৮ হাজার ৮৯১ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। এগুলোতে মোট শিক্ষার্থী ২ কোটি ১ লাখের বেশি।

 ফি ও খরচের যত পার্থক্য

আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে গত ১০ মে গিয়ে জানা গেল, ভর্তির সময় প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে আট হাজার টাকা নেওয়া হয়। মাসিক বেতন ছাড়াও প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে পরীক্ষা ফি ৬০০ টাকা, তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণিতে ৭৫০ টাকা এবং ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ৯০০ টাকা নেওয়া হয়। আর একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে নেওয়া হয় ৭০০ টাকা। এসএসসি পরীক্ষার্থীদের প্রস্তুতিকালীন পরীক্ষার জন্য নেওয়া হয় ১ হাজার ২০০ টাকা।

এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তিন ক্যাম্পাসে (মতিঝিল মূল, বনশ্রী ও মুগদা ক্যাম্পাস) মোট শিক্ষার্থী প্রায় ২৯ হাজার ৫০০।

আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী প্রধান শিক্ষক মনিরুল হাসানের দাবি, তাঁদের মোট শিক্ষক প্রায় ৭০০। এর মধ্যে এমপিওভুক্ত শিক্ষক ১১৪ জন। ফলে শিক্ষকদের বেতন দিতে কিছু ঘাটতি হয়।

ঢাকার মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ে গিয়ে জানা গেল, প্রতিষ্ঠানটি প্রতি তিন মাস পরপর ফি আদায় করে। জানুয়ারি-মার্চে ফি আদায়ের তথ্য থেকে জানা যায়, চলতি বছর প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে মোট ১ হাজার ৫০৮ টাকা দিতে হয়। এর মধ্যে ১ হাজার ১৫১ টাকা সেশন ফি। বাকি টাকার মধ্যে শিক্ষার্থীর বেতন ১২ টাকা (মাসে ৪ টাকা), কম্পিউটার ফি ৬০ টাকা, নিরাপত্তা ফি ৬০ টাকা ও টিফিন ফি ২২৫ টাকা (মাসে ৭৫ টাকা)।

সেশন ফি বছরে একবারই নেওয়া হয়। এ কারণে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তিন মাসের মোট ফি কম। এই তিন মাসে প্রথম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীর মোট ফি (বেতন, কম্পিউটার, নিরাপত্তা ও টিফিন ফি) ৩৫৭ টাকা। অবশ্য শ্রেণিভেদে শিক্ষার্থী বেতন সামান্য কমবেশি আছে।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দেওয়ান তাহেরা আক্তার বলেন, সরকার যে ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে, তাঁরা সেটিই নিচ্ছেন। অন্যান্য সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও ফি একই।

একটু দূরে অবস্থিত এমপিওভুক্ত মতিঝিল কলোনি উচ্চবিদ্যালয়ে প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী সাড়ে ছয় শর মতো। মোট শিক্ষক আছেন ৩৩ জন, এঁদের মধ্যে ১৮ জন এমপিওভুক্ত। এখানে প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মাসে বেতন ৪০০ টাকা, ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ৫০০ টাকা এবং নবম ও দশম শ্রেণিতে ৬০০ টাকা। ভর্তি ফিও শ্রেণিভেদে বেতনের মতো একই। আর বছরে সেশন ফি প্রাথমিক স্তরে আড়াই হাজার ও মাধ্যমিক স্তরে তিন হাজার টাকা। কোচিং-প্রাইভেটের জন্য আলাদা খরচ তো আছেই।

একেবারেই বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খরচ কেমন সেটি জানতে একটি কিন্ডারগার্টেনে যান এই প্রতিবেদক। সেখানে বেতন আরও বেশি। মতিঝিল এজিবি কলোনি এলাকার অনন্যা কিন্ডারগার্টেনে কথা হয় ব্যবস্থাপক (ম্যানেজার) মুশফিকুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, তাঁদের এখানে ‘হাতেখড়ি থেকে কেজি শ্রেণি পর্যন্ত স্কুল হিসেবে পড়ানো হয়। হাতেখড়ি থেকে কেজি শ্রেণি পর্যন্ত মাসে বেতন দেড় হাজার টাকা এবং ভর্তি ফি সাড়ে ৩ হাজার টাকা।

তাহলে পুরোপুরি সরকারি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বেতন কত? আইডিয়াল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, এখানে শিক্ষার্থীদের বেতন নেই। তবে ভর্তির সময় ‘অনুদান’ হিসেবে অভিভাবকেরা ‘সামর্থ্য’ অনুযায়ী টাকা দেন।

দেশের ছয় শতাধিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক স্তরের পাশাপাশি ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতেও পড়ানো হয়। এই প্রাথমিক বিদ্যালয়টিও তেমনই। বিদ্যালয়ের সামনে এক অভিভাবক বলেন, তাঁর এক সন্তান এই বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। ভর্তির সময় তিনি দুই হাজার টাকা দিয়েছিলেন। তবে বিদ্যালয়ে মাসিক বেতন বা অন্য কোনো ফি দিতে হয় না। বিদ্যালয়ের বাইরে তাঁর সন্তান সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় কোচিংয়ে পড়ে।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আফরোজা খানম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের বিদ্যালয়ে মোট ২ হাজার ৬ শিক্ষার্থী আছে। শিক্ষক আছেন ৩৯ জন। পরিচালনা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ছয়জন কর্মচারী রাখা হয়েছে। তাঁদের বেতন দিতেই সামর্থ্য অনুযায়ী ‘অনুদান’ দেন অভিভাবকেরা।

বৈষম্য দূর করা উচিত

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক এস এম ওয়াহিদুজ্জামান সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেন, একেক ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একেক ধরনের বেতন ও ফি আদায় করে।

আবার এলাকা এবং বিদ্যালয় ভেদে এই ফিতে পার্থক্য আছে। ঢাকা শহর ও মফস্‌সলের বিদ্যালয়ে বেতন ভিন্ন। আবার একই এলাকার বিদ্যালয়েও ভিন্নতা আছে। এসব বৈষম্য দূর করা উচিত। যেকোনোভাবেই হোক বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য আনা দরকার।