এ বছরের শুরুতে (৭ জানুয়ারি) বহুল আলোচিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর কয়েক মাস পার হতে না হতেই এবার দেশব্যাপী স্থানীয় সরকার অর্থাৎ উপজেলা নির্বাচন নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। আগামী মে-জুন মাসে চার ধাপে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে। এরই মধ্যে প্রথম দুই ধাপের নির্বাচনের তফসিলও ঘোষণা করা হয়েছে। উপজেলা নির্বাচনকে উপলক্ষ করে রাজনীতিতে যেমন নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে, তেমনি কিছু পুরোনো প্রবণতাও লক্ষ করা যাচ্ছে।
এবার উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের মাত্র চার থেকে পাঁচ মাসের মধ্যে। সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় নির্বাচনের এত কাছাকাছি সময়ে উপজেলা নির্বাচন হয়নি। এর ফলে গত জাতীয় নির্বাচনের নানা প্রভাব-প্রতিক্রিয়া উপজেলা নির্বাচনেও থাকবে, সেটা খুব সহজেই অনুমেয়।
গত সংসদ নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ছিল অনুপস্থিত। এ নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ‘ডামি প্রার্থী’ কৌশল অবলম্বন করেছিল। কিন্তু এই কৌশলের ফলাফল হিসেবে নৌকা ও দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে ব্যাপক বিরোধ-কোন্দল দেখা দেয়। নির্বাচনের পরও যা অব্যাহত থাকে। বিরোধের বিষয়টি নিয়ে দলটির নীতিনির্ধারকদের মধ্যে উদ্বেগ-আশঙ্কার কথা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সে রকম একটি খবরে বলা হয়েছিল, ‘...ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী এক সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ ও বিবাদের ঘটনা দেখে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন দলটির নীতিনির্ধারকেরা।’ (আওয়ামী লীগের কোন্দল ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে, যুগান্তর, ১৫ জানুয়ারি ২০২৪)
নৌকা আর স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এই বিরোধের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে আওয়ামী লীগ স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভাবে না করার সিদ্ধান্ত নেয়। দলটির আশঙ্কা, দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করলে এই বিরোধ বা বিভক্তি আরও বাড়বে। বিভক্তি ঠেকাতে সামনের উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি। (দলীয় কোন্দল মেটাতে আওয়ামী লীগের উদ্যোগ কতটা সফল হবে, বিবিসি বাংলা, ২৪ জানুয়ারি ২০২৪)
উপজেলা নির্বাচন দলীয়ভাবে না করার আরও কয়েকটি কারণ দৃশ্যমান হয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো, এ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখানো। দলীয়ভাবে নির্বাচন করলে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর তাতে অংশগ্রহণের কোনো সম্ভাবনা নেই—এটা ক্ষমতাসীনদের অজানা নয়।
কিন্তু দলীয়ভাবে নির্বাচন না করলে, বিএনপি বা অন্য বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিলেও নিতে পারে, এমন ধারণা আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের। এ রকম অবস্থায় আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণ প্রত্যাশা করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। (উপজেলা নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক দেখাতে চায় আওয়ামী লীগ, ভোটে আনতে চায় বিএনপিসহ অন্য দলগুলোকে, প্রথম আলো অনলাইন, ২৩ মার্চ ২০২৪)
এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে মাঠের ও ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি। এ কারণে বিএনপিকে ছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো অংশগ্রহণমূলক হবে না, ক্ষমতাসীনদের অবস্থান থেকেই সেটা স্পষ্ট। একই কারণে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও অংশগ্রহণমূলক হয়নি।
নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে ভোট প্রদানের হার ৪১ দশমিক ৮০ ভাগ বলা হলেও বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন ও সন্দেহ তৈরি হয়। সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের সম্প্রতি লিখেছেন, ‘ফলে ৪২ শতাংশ ভোট পড়ার দাবি বাস্তবসম্মত নয় মনে করি। বরং ৫ থেকে ১০ শতাংশ ভোটার উপস্থিত হয়ে ভোট দিয়েছেন। কিছু কিছু এলাকায় ২০ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে অনেক প্রত্যক্ষদর্শীর ধারণা।
স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, কীভাবে গড়ে ৪২ শতাংশ ভোট হিসাবে গণনায় এল? এটা সম্ভব শুধু যদি বেশ কিছু ব্যালট পেপারে অবৈধভাবে সিল মেরে প্রার্থীদের পক্ষে দেখানো হয়। অথবা ব্যালট গণনা বাদেই নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নিজেদের পছন্দমতো ফলাফল তৈরি ও ঘোষণা করেন।
যুক্তিসংগতভাবে আশঙ্কা করার কারণ আছে যে প্রচুর অতিরিক্ত ভোট, যা ভোটাররা দেননি, সেগুলো যেকোনো প্রকারে ফলাফলে দেখানো হয়েছে। যার পক্ষে দেখানো হয়েছে, তিনি জয়ী হয়েছেন। ফলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বাস্তবতার আলোকে অংশগ্রহণমূলক হয়েছে বলা যায় না।’ (দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আসলে কেমন হলো, প্রথম আলো, ২৭ মার্চ ২০২৪)
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে প্রশ্ন ও বিতর্ক তৈরি হয়েছে, সেটা এখনো জনপরিসরে বহাল রয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে এটা স্পষ্ট, ক্ষমতাসীনেরা তা থেকে মানুষের মনোযোগ সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। সেই চেষ্টারই একটি অংশ হলো উপজেলাসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখানো। কিন্তু নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখানো আর সত্যিকার অর্থে অংশগ্রহণমূলক হওয়া এক বিষয় নয়।
ঘটনাক্রম থেকে স্পষ্ট, বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণ ‘প্রত্যাশা’ করলেও দলীয় প্রতীক ছাড়া উপজেলা নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের আরও কিছু পরিকল্পনা আছে। এ নিয়ে প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘এবার উপজেলাসহ স্থানীয় সরকারব্যবস্থার নির্বাচনে নৌকা প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে অনেক লক্ষ্য অর্জন করতে চাইছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীন দলটি তাদের দলীয় কোন্দল ঠেকানোর চিন্তার কথা প্রকাশ্যে বলছে। তবে এর মাধ্যমে সংসদ নির্বাচন বর্জন করা বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে কিছুটা বেকায়দায় বা ‘‘ট্র্যাপে’’ ফেলার পরিকল্পনাও আছে ক্ষমতাসীনদের।’ (উপজেলা নির্বাচনে বিএনপিকে বেকায়দায় ফেলতে চায় আওয়ামী লীগ, প্রথম আলো, ২৫ জানুয়ারি ২০২৪)
স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কোনো পরিবর্তন হয় না। এরপরও কেন এই নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীনদের এ রকম পরিকল্পনা এবং বিরোধীদের বেকায়দায় বা ‘ফাঁদে’ ফেলার চেষ্টা? বিএনপি নেতারা মনে করছেন, বিএনপি এ নির্বাচনে গেলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে বিতর্ক ও প্রশ্ন, সেটা কিছুটা হলেও কমাতে পারবে সরকার। একই সঙ্গে এই প্রচারও শুরু করবে যে সংসদ নির্বাচন না করে বিএনপি ভুল করেছে। (উপজেলা নির্বাচনকে ‘ফাঁদ’ মনে করছে বিএনপি, প্রথম আলো, ২৩ মার্চ ২০২৪)
পাকিস্তান আমলে সেনাশাসক আইয়ুব খান বিডি (বেসিক ডেমোক্রেসি) মেম্বার নির্বাচনের নামে এবং পরবর্তী সময়ে উপজেলা নির্বাচন দিয়ে স্বৈরশাসক এরশাদও বিরোধীদের ‘ফাঁদে’ ফেলার চেষ্টা করেছিলেন। ‘অনির্বাচিত’ এই দুই সামরিক শাসকের ক্ষমতার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে ব্যবহার করে তাঁরা সেই প্রশ্নকে ধামাচাপা দেওয়া এবং রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ করার চেষ্টা করেছিলেন। আইয়ুব ও এরশাদ এখন নেই, কিন্তু তাঁদের কৌশলগুলো কি নতুন রূপে ব্যবহৃত হচ্ছে?
মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জেষ্ঠ্য সহসম্পাদক