মতামত

খেলার স্বাধীনতায় শিশুদের জয়

আমার শৈশবের আনন্দের স্মৃতি মনে করার চেষ্টা করলে প্রথমেই মনে পড়ে, আমরা যে বাড়িতে থাকতাম, সেখানে একটা বিশাল জামগাছ, পাশে অর্ধেক ভাঙা পাঁচিল আর তার আরেক পাশে স্তূপ করে রাখা বালু ও ইটের গাদার মধ্যে আমার ছোটবেলার বান্ধবী নীরার সঙ্গে খেলার কথা।

এই ভাঙা পাঁচিল ছিল আমাদের জন্য অপরিহার্য খেলার উপাদান। কখনো মনে হতো, দুর্গম কোনো পথ পার হতে হবে এবং এই ভাঙা পাঁচিলই একমাত্র ভরসা, আবার এই পাঁচিল কখনো রূপকথার পঙ্খিরাজ ঘোড়া আবার মাঝেমধ্যে আমাদের ব্যালান্স করে হাঁটা শেখার স্থান; কারণ, তখন আমরা টেলিভিশনে দেখতে পেতাম, জিমন্যাস্টরা এর চেয়েও সরু পোল ব্যবহার করে নানা কায়দা করতে জানে। এভাবেই খেলার মাধ্যমে আমাদের কল্পনার জগৎ সহজ বাস্তবে রূপ পেত।

আমরা যারা প্রকৃতির মাঝে খেলতে খেলতে বেড়ে উঠেছি, তাদের মধ্যে অনেকেই একটা সময় পর ভিডিও গেমস, কম্পিউটার বা মুঠোফোনে খেলার ফাঁদে আটকে গেছি। তবে মাধ্যম যা–ই হোক না কেন, এরও সারবস্তু খেলা।

শহরে বেড়ে ওঠা শিশুদের হাতে হাতে এখন টেকনোলজি থাকলেও প্রকৃতির মাঝে খেলার প্রয়োজনীয়তা ফুরায়নি মোটেও। চার দেয়ালে বেড়ে ওঠা শিশুরা বৃষ্টি দেখলে এখনো জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয়, হাঁটার পথে পানি দেখলে পা ডুবিয়ে দিতে চায়। ভেবে দেখুন তো, যে শিশু পিঁপড়ার সারিবদ্ধ হেঁটে যাওয়া দেখতে দেখতে পিঁপড়ার কলোনি আবিষ্কার করে ফেলে, তার আনন্দ কতখানি হয়!

কিংবা গাছের পাতার আলোছায়ায় ফড়িংয়ের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে বড় হওয়া শিশুটির প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা কতখানি গভীর। এভাবেই প্রকৃতি শিশুদের দেখতে শেখায়, চারপাশের সূক্ষ্ম পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করতে শেখায়।

এখানে উল্লেখ্য, আমার বর্তমান কর্মক্ষেত্র ব্র্যাক আইইডিতে গবেষণার একটি বড় অংশজুড়ে আছে ‘খেলার মাধ্যমে শিশুদের বিকাশ’। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেকোনো কিছু শেখার জন্য শিশুদের সবচেয়ে প্রিয় মাধ্যম হলো খেলা। প্রকৃতির মাঝে খেলার যে উদাহরণের কথা বললাম, এ ধরনের খেলায় শিশুরা নিজেদের কৌতূহল থেকেই অংশগ্রহণ করে। বাবা-মায়েরা খুব সহজেই কাছাকাছি কোনো পার্কে, খেলার মাঠে বা প্রকৃতির মাঝে নিয়ে যেতে পারেন যেন শিশুরা নিরাপদ, মুক্ত ও স্বাধীন পরিবেশে মনের আনন্দে খেলতে পারে।

এ ধরনের খেলার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এতে কোনো খেলনার প্রয়োজন হয় না। শিশুরা প্রকৃতিতে পাওয়া গাছের পাতা, নুড়ি, ফুল ইত্যাদি দিয়ে নিজেরাই অনেক কিছু তৈরি করে খেলতে থাকে, যা তাদের সৃজনশীলতা বিকাশে দারুণভাবে কাজে দেয়।

নানা গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুরা সৃজনশীল চিন্তা থেকে শুরু করে মনের ভাব প্রকাশ করা, বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের উপায় খেলার মাধ্যমেই করে থাকে। খেলার মাধ্যমে তারা তাদের আবেগ প্রকাশ করে, পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরি করে, এমনকি মা–বাবা বা পরিবারের বড় যাঁরা আছেন, তাঁদের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্কও স্থাপন করে।

যে শিশুর বয়স এক বছরের কম, কথা বলতে শেখেনি, তার দিকে বল ছুড়ে দিয়ে, পুতুল দেখিয়ে বা মজার মজার গল্প ও ছড়া বলে খেলা করা যায়। দুই থেকে ছয় বছর বয়সী শিশুদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে, কাগজ দিয়ে মজার কিছু বানিয়ে বা ছবি এঁকে খেলা যায়। আমরা ঘরে বসে অনেক সময় লুডো, ক্যারম বা দাবা খেলি, কখনো চোর-পুলিশ-ডাকাত খেলাটি করেও মজার সময় কাটাই। এভাবেই খেলা পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করতে সাহায্য করে।

খেলার মাধ্যমেই শিশুরা নিজেদের আবিষ্কার করে, চিন্তা করতে শেখে ও বুঝতে পারে তাদের ক্ষমতা। অভিভাবক, শিক্ষক বা নীতিনির্ধারকদের যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় লক্ষ রাখা প্রয়োজন, খেলা শিশুদের জীবনে অপরিহার্য এবং খেলার স্বাধীনতাই দিতে পারে শিশুদের জয়ের আনন্দ!

শিশুদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার অন্যতম মাধ্যম খেলা। প্রাক্‌–প্রাথমিক বিকাশ বা ইসিডি (আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট) বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের একটি খেলার মধ্যে সম্পূর্ণভাবে নিমজ্জিত হতে ন্যূনতম আধঘণ্টা থেকে ৪০ মিনিট সময় লাগে। বয়সভেদে এই সময়কালের তারতম্য ঘটলেও এ রকম নির্দিষ্ট সময়ের পরই শিশুরা খেলার মাধ্যমে শেখার মূল উপকারিতা পাবে। কয়েকটি শিশু একসঙ্গে যখন ব্লক, নুড়িপাথর বা মাটি দিয়ে জিনিস বানিয়ে খেলা করে, লক্ষ করবেন, শুরুতে তারা খুব সাধারণ ছোট কিছু তৈরি করে।

এ কাজে শিশুটি যত সময় দেবে, তত নতুন নতুন উপাদান যুক্ত করতে থাকবে। যেমন শুরুতে হয়তো লম্বা বা চওড়া কোনো স্ট্রাকচার তৈরি করল, কিছু সময় পর দেখবেন সেখানে রাস্তা যোগ হচ্ছে, বাড়ি তৈরি হচ্ছে, গাছ, ছোট পুকুর, মানুষ, এমনকি চারপাশে দেখা প্রাণী, পাখি বা দোকানপাট গড়ে উঠছে। সহজ ছোট একটি জিনিস থেকে একটি শহর বা শিশুটি যেখানে থাকে তার পরিবেশ তৈরি করে ফেলছে। এভাবেই তার বুদ্ধি ও যৌক্তিক চিন্তা খাটানোর পাশাপাশি মনের ভাব প্রকাশ করতে পারছে।

যখন কয়েকটি শিশু একসঙ্গে খেলা করে, তখন তারা পরস্পরের সঙ্গে নানাভাবে ভাবের আদান–প্রদান করে, কথা বলে বা মতের অমিল হলে সমঝোতা করার চেষ্টা করে। এ কারণে বড়দের উচিত শিশুদের স্বাধীনভাবে খেলতে দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। শিশুরা পরস্পরের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করলেও নিজেরা আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে আসার চেষ্টা করবে। এর ফলে পরবর্তী সময়ে শিশুদের ভাষাদক্ষতা, যুক্তি দিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা ও আবেগ প্রকাশ করার মতো গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা গড়ে ওঠে।
আজকাল উন্নত বিশ্বসহ বাংলাদেশেও শিশুদের খেলা নিয়ে নানা ধরনের কাজ হচ্ছে।

শিক্ষাবিদেরা আরও দেখছেন প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে শুরু করে প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে কোন কোন খেলার মাধ্যমে শিশুদের কোন ধরনের বিকাশ হয়। এগুলো নির্ধারণ করে শিক্ষাবিদ ও প্রাক্‌–প্রাথমিক বিকাশ বিশেষজ্ঞরা পাঠক্রমেও খেলা অন্তর্ভুক্ত করছেন। ব্র্যাক তাদের প্লে-ল্যাব কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রাক্‌-প্রাথমিক পর্যায়ে খেলানির্ভর পাঠ্যক্রম তৈরি করেছে, যা বর্তমানে বাংলাদেশ ছাড়াও আফ্রিকার কয়েকটি দেশে ও ফিলিপাইনে সফলভাবে পরিচালিত হচ্ছে।

এ ধরনের খেলানির্ভর পাঠ্যক্রমের সবচেয়ে সুন্দর ও শক্তিশালী দিক হচ্ছে, শিশুদের নিজস্ব সংস্কৃতির খেলা, গান, গল্প, ছড়া ইত্যাদি পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা। এর ফলে শিশুরা চারপাশে যা দেখে বড় হয়, তার প্রতিফলন শ্রেণিকক্ষে দেখতে পায়। যেহেতু এই খেলা ও সংস্কৃতির উপাদানগুলো তাদের অতিপরিচিত, শিশুরা তখন খুব সহজেই এগুলো আয়ত্ত করে ফেলতে পারে।

এতে করে তারা আত্মবিশ্বাসী হতে শেখে। শিশুদের খেলা নিয়ে বিভিন্ন গবেষণার ইতিবাচক ফল থেকে আমরা বুঝতে পারি, খেলা শিশুদের জন্য আনন্দময় পরিবেশ তৈরি করে এবং তখন তারা খুব সহজেই কঠিন বিষয়ও শিখে ফেলতে পারে।
যেসব শিশু নানা ধরনের দুর্যোগ বা দুর্দশার শিকার, সেখানেও দেখা গেছে খেলার মাধ্যমে মানসিক স্বস্তি ও শান্তি তারা ফিরে পেতে পারে। এ ক্ষেত্রে শুধু শিশুরা নয়, তাদের বাবা–মায়েরাও নিজ সন্তানদের সঙ্গে খেলা করার মাধ্যমে মানসিক স্বস্তি ফিরে পেয়েছেন, এমন অনেক নজির আছে।

আজকের এই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে শিশুদের খেলা অনেক কম গুরুত্ব পাচ্ছে। প্রথাগত শিক্ষাপদ্ধতিতে খেলা মূল্যায়ন করাও কঠিন। তারপরও আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে শিশুরা খেলতে খেলতে বন্ধুত্ব করার সুযোগ পায়, মানসিক চাপ থেকে রক্ষা পায় এবং সমস্যা মোকাবিলা করার মতো দক্ষতা অর্জন করে।

খেলার মাধ্যমেই শিশুরা নিজেদের আবিষ্কার করে, চিন্তা করতে শেখে ও বুঝতে পারে তাদের ক্ষমতা। অভিভাবক, শিক্ষক বা নীতিনির্ধারকদের যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় লক্ষ রাখা প্রয়োজন, খেলা শিশুদের জীবনে অপরিহার্য এবং খেলার স্বাধীনতাই দিতে পারে শিশুদের জয়ের আনন্দ!

  • কুঁড়ি চিসিম
    সিনিয়র প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট, ইসিডি ও প্লে
    ব্র্যাক আইইডি, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়