পশ্চিমারা রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে জড়াতে বাধ্য হয়েছে, সেই সংঘাত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সামরিক ব্যবস্থা এবং তাদের প্রতিরক্ষাশিল্প ঘাঁটিগুলোর পদ্ধতিগত দুর্বলতাকে উন্মোচন করে দিয়েছে।
পশ্চিমাদের এই সমস্যাগুলোর শুরুটা হয়েছে মৌলিক প্রযুক্তির প্রবণতা থেকে। ইউক্রেনে মনুষ্য পরিচালিত ব্যয়বহুল ট্যাংক, যুদ্ধবিমান ও যুদ্ধজাহাজের মতো সামরিক ব্যবস্থা মনুষ্যবিহীন সস্তা ড্রোন, ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ও গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রের মুখে পড়ে দিশাহারা হয়ে গেছে।
রাশিয়া ইতিমধ্যেই আট হাজারের বেশি সাঁজোয়া যান, কৃষ্ণসাগরে তার মোতায়েন করা নৌবহরের এক-তৃতীয়াংশ নৌযান এবং বহু যুদ্ধবিমান হারিয়েছে।
এই ক্ষয়ক্ষতি রাশিয়াকে তার ব্যয়বহুল মনুষ্যবাহী সামরিক সরঞ্জাম যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরিয়ে নিতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
চীন, রাশিয়া, ইরান, তুরস্ক এবং অধুনা ইউক্রেনের তৈরি সস্তা ড্রোনগুলো নজরদারি, লক্ষ্যবস্তু ঠিক করা এবং নির্দেশনার জন্য কার্যকর আক্রমণাত্মক অস্ত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
হাতের কাছে পাওয়া যায়, এমন বাণিজ্যিক পণ্যের মতো করে লাখ লাখ ড্রোন উৎপাদন করা হচ্ছে। এগুলো তৈরি করতে এক হাজার ডলার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার ডলার খরচ হচ্ছে।
এই ধরনের ড্রোন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা পশ্চিম ইউরোপের কোথাও তৈরি হয় না। এটি পশ্চিমাদের সামরিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর একটি বড় দুর্বলতা।
পশ্চিমাদের হাতে এখন যে বিধ্বংসী ব্যবস্থা আছে, তা দিয়ে রাশিয়া, চীন ও ইরানের ড্রোনগুলো ধ্বংস করা সহজ হলেও তা খুবই ব্যয়সাধ্য। পশ্চিমা এসব ব্যবস্থা দিয়ে প্রতিটি টার্গেটে খরচ হয় ১ লাখ ডলার থেকে ৩০ লাখ ডলার পর্যন্ত।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পশ্চিমাদের প্রতিক্রিয়া এখন পর্যন্ত খুবই অপ্রতুল। এআই-সক্ষম প্রযুক্তির রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ সেমিকন্ডাক্টর ক্যাপিটাল ইকুইপমেন্ট এবং প্রসেসরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে
খরচের এই অসম অনুপাত পশ্চিমাদের কয়েক দশকের আত্মতুষ্টিতে ভোগা এবং আমলাতান্ত্রিক অদক্ষতার ফল।
পশ্চিমে সামরিক ঠিকাদারেরা কখনোই খরচ কমানোর প্রতিযোগিতায় নেমে ড্রোন বানায়নি; যদিও সম্প্রতি কয়েকটি মার্কিন ও ইউক্রেনীয় কোম্পানি খুব কম খরচে ড্রোন বানানোর কাজ শুরু করেছে।
সবচেয়ে ভয়ের কথা হলো, বর্তমানে যে সস্তা ড্রোন প্রযুক্তির সময়টা আমরা পার করছি, সেটি মনুষ্যবিহীনভাবে নিজে নিজে লক্ষ্যস্থলে হামলা চালানোয় সক্ষম অস্ত্রের ভবিষ্যতের সূচনামাত্র।
এখন যেসব ড্রোন ব্যবহৃত হচ্ছে তার বেশির ভাগই মানুষ দূর থেকে রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করে বা সরল-সোজাভাবে জিপিএস বা ডিজিটাল ম্যাপ অনুসরণ করে পরিচালিত হয়।
কিন্তু নতুন যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তি (যা একাডেমিক গবেষণা পণ্য এবং বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে প্রকাশ্যে পাওয়া যাচ্ছে) বিকশিত হচ্ছে, তা শিগগিরই যুদ্ধে ব্যবহৃত হবে এবং সম্ভবত সন্ত্রাসবাদেও এআই প্রযুক্তি দ্বারা পরিচালিত ড্রোন ব্যবহৃত হবে।
এআই-সক্ষম ড্রোনগুলো ঝাঁক বেঁধে উড়ে উড়ে অভিযানে থাকা পদাতিক বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে পারে। যেমন এই ড্রোনগুলো আক্রমণকারী বাহিনীকে তাদের নিশানায় থাকা লক্ষ্যবস্তুকে ঘিরে রাখতে এবং পালিয়ে যাওয়া ঠেকাতে সক্ষম করে তুলতে পারে।
লক্ষ্যবস্তুকে সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করার ক্ষেত্রেও এসব এআই সক্ষম ড্রোন অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এসব ড্রোন ওপর থেকে মানুষের আলাদা আলাদা মুখ, ধর্মীয় পোশাক এমনকি একটি নির্দিষ্ট গাড়ির লাইসেন্স প্লেট শনাক্ত করতে পারে।
এ ছাড়া এই ধরনের ড্রোনের ঝাঁক ক্রমবর্ধমানভাবে শহর, বন ও ভবনগুলোর মধ্য দিয়ে চলার পথ বের করে চলতে পারে।
এরপরই আছে বাণিজ্যিক ও সামরিক হিউম্যানয়েড রোবট। গত জানুয়ারিতে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকদের প্রকাশিত ভিডিওগুলোতে দেখা গেছে, তাদের বানানো এআই-চালিত রোবট রান্নার পাত্রে মাছ ভাজা থেকে শুরু করে ঘরদোর পরিচ্ছন্ন করাসহ গৃহস্থালির কাজ করছে।
এসব ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম ইউরোপ, তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়া সম্মিলিতভাবে এখনো চীন (এবং রাশিয়া) থেকে এগিয়ে থাকলেও তাদের নেতৃত্ব সংকুচিত হচ্ছে।
চীন ইতিমধ্যেই ড্রোন ও রোবট দুটিতেই ব্যবহারযোগ্য হার্ডওয়্যার উৎপাদন ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারে আধিপত্য বিস্তার করেছে।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পশ্চিমাদের প্রতিক্রিয়া এখন পর্যন্ত খুবই অপ্রতুল। এআই-সক্ষম প্রযুক্তির রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ সেমিকন্ডাক্টর ক্যাপিটাল ইকুইপমেন্ট এবং প্রসেসরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।
এমনকি পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণকে প্রতিহত করা হয়েছে এবং শিথিল করা হয়েছে। যদিও চীনে হাই-এন্ড এআই প্রসেসরের রপ্তানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কিন্তু ইউএস ক্লাউড পরিষেবাগুলোতে একই প্রসেসরের ব্যবহার উন্মুক্ত রাখা হয়েছে।
এনভিডিয়া এখন চীনকে প্রায় একই ধরনের শক্তিশালী এআই প্রসেসর সরবরাহ করে যাচ্ছে।
যদিও গুগলের মতো কিছু মার্কিন কোম্পানি তাদের এআই মডেলগুলোকে নিজেদের মালিকানায় রেখে দিয়েছে এবং তাদের প্রযুক্তিতে চীনাদের প্রবেশাধিকার সীমাবদ্ধ করেছে, কিন্তু অন্যরা বিপরীত আচরণ করেছে।
ওপেনএআই তার অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেসে সরাসরি চীনা অ্যাকসেস নিষিদ্ধ করলেও সেই একই এপিআই মাইক্রোসফটের মাধ্যমে চীনের জন্য খুলে রাখা হয়েছে।
যদি এটি চলতে থাকে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপ চীন এবং এমনকি রাশিয়া ও ইরানের বাণিজ্যিক এআই অ্যাপ্লিকেশনে ও এআই–নির্ভর সামরিক তৎপরতা মোকাবিলায় পিছিয়ে পড়বে।
● চার্লস ফার্গুসন একজন প্রযুক্তি বিনিয়োগকারী ও নীতি বিশ্লেষক এবং অস্কারজয়ী তথ্যচিত্র ইনসাইড জব-এর পরিচালক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত