মতামত

খাদিজা রাষ্ট্রের জন্য এতটাই ভয়ংকর?

খাদিজা যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, এ বিষয়ে সে বিশ্ববিদ্যালয়েরও কি কোনো দায়িত্ব নেই?
ছবি: সংগৃহীত

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, সারা দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে (ডিএসএ) ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত মোট সাত হাজার একটি মামলা হয়েছে। এখন জুন মাস। গত পাঁচ মাসে এই আইনে আরও কয়েক শ লোকের বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

গত সোমবার জাতীয় সংসদে গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খানের প্রশ্নের উত্তরে আইনমন্ত্রী ওই তথ্য জানালেও এ আইনে গ্রেপ্তারের সংখ্যা জানাতে পারেননি। তিনি ঠেলে দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে পাস এবং ওই বছর ৮ অক্টোবর থেকে আইনটি কার্যকর হয়। এর তিন দিনের মাথায় ১১ অক্টোবর প্রথম এই আইনের অধীনে মামলা হয়। এর পর থেকে মামলা চলছেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মামলার বাদী পুলিশ কিংবা ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা। আর বিবাদী হলেন—সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা। একই ঘটনায় একই ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই আইনে বহু মামলা করারও নজির আছে।

গত জানুয়ারি মাসে সেন্টার ফর গভর্নেসের (সিজিএস) তথ্য অনুযায়ী, ডিএসএ মামলায় ১ হাজার ১১৯ জন আটক হয়েছেন। এ সময়ে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ‘কটূক্তি’ করার অভিযোগে ১৪০টি মামলা হয়েছে, ২১০ জন অভিযুক্ত হয়েছেন এবং ১১৫ জন আটক হয়েছেন। মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে কটূক্তি বা তাঁদের অবমাননার অভিযোগে ৬৪ মামলায় অভিযুক্ত ১৩০ জনের মধ্যে ৫১ জন আটক হয়েছেন। রাজনীতিবিদদের মানহানির অভিযোগে ১৬৮ মামলায় অভিযুক্ত ৪৭০ জন, আটক হয়েছেন ১২০ জন।

সরকারের পক্ষ থেকে যতই বলা হোক, ডিজিটাল মাধ্যমে অপরাধ বন্ধের উদ্দেশ্যে আইনটি করা হয়েছে, বাস্তবে এটি ব্যবহার করা হচ্ছে ভিন্নমতের লোকদের বিরুদ্ধে। এমনকি নারীরাও এই আইনের খড়্গ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না।

আইনমন্ত্রী যেদিন সংসদে ডিএসএর অধীন মামলার হিসাব দিচ্ছিলেন, সেদিনই পত্রিকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজা কুবরার জামিন না পাওয়ার খবর এল। খাদিজা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। অনলাইনে সরকারবিরোধী বক্তব্য প্রচারসহ দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের কথিত অভিযোগে ২০২০ সালের অক্টোবরে খাদিজা ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পৃথক দুটি মামলা হয়। একটি মামলা রাজধানীর কলাবাগান থানায়, অপরটি নিউমার্কেট থানায়। দুটি মামলার বাদীই পুলিশ। গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর খাদিজাকে গ্রেপ্তার করে নিউমার্কেট থানা-পুলিশ। সেই থেকে তিনি কারাগারে আছেন।

খাদিজা যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, এ বিষয়ে সে বিশ্ববিদ্যালয়েরও কি কোনো দায়িত্ব নেই? ডিএসএ মামলার কারণে একজন ছাত্রীর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, অর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মুখে কুলুপ এটে আছে। এটা কেমন  কথা? এই বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য আছেন, প্রশাসন আছে, বিবেকবান শিক্ষকগণ আছেন, কাউকে উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায়নি। তাঁরা ভেবেছেন মেয়েটিকে নিয়ে কিছু বললেই তাদের চাকরি চলে যাবে।

খাদিজার বিরুদ্ধে যখন মামলা হয়, তখন তাঁর বয়স ১৭ বছর। ১৮ বছরের নিচে যেকোনো ছেলেমেয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক। এ ক্ষেত্রে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে যদি দেখা যায় তিনি আইনের দৃষ্টিতে শিশু, সেক্ষেত্রে তাঁর বিচার শিশু আদালতে হওয়া উচিত। আর ডিএসএতে মামলা হলেও খাদিজাকে মাসের পর মাস কারাগারে কাটাতে হবে কেন? ব্যক্তি কিংবা সরকারের সমালোচনা রাষ্ট্রদ্রোহ হতে পারে না।

নিম্ন আদালত দুবার খাদিজার জামিন আবেদন নাকচ করেছেন। এরপর তিনি হাইকোর্টে জামিন চেয়েছেন এবং পেয়েও গেছেন। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ সেই জামিনের বিরুদ্ধে আপিল করেছে। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি তাঁর জামিন মঞ্জুর করেন হাইকোর্ট। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই জামিন আদেশ স্থগিত করেন চেম্বার বিচারপতি। এখন আবেদনটি আপিল বিভাগে শুনানির পর্যায়ে রয়েছে।

খাদিজার আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, গত ২৯ মে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে তাঁর মক্কেলের (খাদিজা) জামিনের বিরোধিতা করে বক্তব্য উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপক্ষ। এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ১০ আগস্ট তারিখ রেখেছেন আপিল বিভাগ। এর অর্থ সেই তারিখ পর্যন্ত খাদিজাকে কারাগারেই কাটাতে হবে।

খুনের মামলার আসামিও জামিন পেয়ে থাকেন। খাদিজা জামিন পেলেন না। তিনি কি খুনের মামলার আসামির চেয়েও ভয়ংকর কোনো অপরাধী? অথবা তিনি কি এতটাই ভয়ংকর অপরাধী যে, তাঁকে রাষ্ট্র তাঁর ভয়ে কম্পমান। হাইকোর্ট জামিন দেওয়ার পরও কেন রাষ্ট্রপক্ষ তার জামিন আটকানোর চেষ্টা করছে। সাধারণত রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এটি করা হয়।

খাদিজার মুক্তি চেয়ে তাঁর মা ফাতেমা খাতুন বলেন, ‘মেয়ে কারাগারে থাকায় গত ঈদ (ঈদুল ফিতর) আমাদের জন্য ছিল বিবর্ণ। কোরবানির ঈদের (ঈদুল আজহা) আগেই মেয়ে কারামুক্ত হবে বলে আশা করেছিলাম। কিন্তু দিন কয়েক আগে জানতে পারি, খাদিজার জামিন বিষয়ে শুনানি হবে ঈদুল আজহার পর। তার মানে, কোরবানির ঈদেও আমরা তাকে পাচ্ছি না।’

খাদিজার মায়ের এই আহাজারি কি রাষ্ট্রের কর্নকুহরে পৌঁছাবে না? আমাদের রাষ্ট্র কি এতটাই বধির যে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মায়ের কান্না শুনতে পাবে না। খাদিজার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বিচারে তাঁর শাস্তি হলে তিনি সে শাস্তি ভোগ করবেন। কিন্তু বিচারের আগেই কেন তাঁকে মাসের পর মাস কারাগারে কাটাতে হবে?

খাদিজা যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, এ বিষয়ে সে বিশ্ববিদ্যালয়েরও কি কোনো দায়িত্ব নেই? ডিএসএ মামলার কারণে একজন ছাত্রীর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, অর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মুখে কুলুপ এটে আছে। এটা কেমন কথা? এই বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য আছেন, প্রশাসন আছে, বিবেকবান শিক্ষকগণ আছেন, কাউকে উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায়নি। তাঁরা ভেবেছেন মেয়েটিকে নিয়ে কিছু বললেই তাদের চাকরি চলে যাবে।

অথচ এই দেশেই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মহান শিক্ষক তাঁর শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে নিজে জীবন দিয়েছেন। এই দুঃসাহসী শিক্ষকের নাম ড. শামসুজ্জোহা। ১৯৬৯ সালে আই্উব বিরোধী গণআন্দোলনের সময়ে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসও ছিল উত্তপ্ত। সরকার আন্দোলন দমন করতে ১৪৪ ধারা জারি করে। ছাত্ররা সেই আদেশ অগ্রাহ্য করে মিছিলের উদ্যোগ নিলে সেনাবাহিনী তাদের প্রতি গুলি তাক করে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা এগিয়ে আসেন এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, শিক্ষার্থীদের গুলি করার আগে আমাকে গুলি করতে হবে। এরপর সেনা সদস্যরা সত্যি সত্যি তাঁকে হত্যা করে।

ড. শামসুজ্জোহার উত্তরসূরি শিক্ষকেরা স্বাধীন বাংলাদেশে কী ভূমিকায় আছেন, দেশবাসীই দেখছেন। নিজেদের বিবেক ঘুম পাড়িয়ে তাঁরা চাকরি রক্ষা করছেন। তবে যেই তরুণ প্রজন্মকে আমরা অরাজনৈতিক বলে গালমন্দ করি, তারা কিন্তু খাদিজার পক্ষে এগিয়ে এসেছেন। সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে ঢাকা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী ও বাম ছাত্রসংগঠনগুলো প্রতিবাদ করেছে।

নানা হতাশার মাঝেও একটি আশার খবর হলো। সম্প্রতি এক নবদম্পতি খাদিজার কারামুক্তির দাবিতে প্রতিবাদ করেছেন বিয়ের আসরেই। তাঁদের হাতে ধরা ছিল ‘অ্যাবলিস ডিএসএ’ ও ‘ফ্রি খাদিজা’ লেখা দুটি প্ল্যাকার্ড। এই নবদম্পতি হলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের দপ্তর সম্পাদক মাহমুদুল হাসান এবং গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতা সুমাইয়া আফরিন। বিয়ের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের কয়েকজনও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান।

এই সব দম্পতির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরাও বলতে চাই, অবিলম্বে খাদিজাকে মুক্তি দিন। মানবতাবিরোধী ডিএসএ বাতিল করুন।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি। ইমেইল: sohrabhassan55@gmail.com