যে কায়দায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করা হলো

শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে অন্যতম সমালোচনা, রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দেওয়া। নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, গণমাধ্যম ও প্রশাসনযন্ত্র—সব কিছুর চরমভাবে দলীয়করণের ফলে যে ক্ষতি হয়েছে, তা রাষ্ট্র ও নাগরিককে টানতে হবে অনেক বছর। কীভাবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো মুখ থুবড়ে পড়ল এবং জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষায় সেগুলোর কীভাবে সংস্কার করা যায়, তা নিয়ে লিখেছেন সৌমিত জয়দ্বীপ

মর্মান্তিক ‘জুলাই হত্যাকাণ্ডের’ পর অভূতপূর্ব গণ–অভ্যুত্থান ঘটলেও বিজয়োল্লাস খুব বেশি দীর্ঘ করা যায়নি। এটি যেকোনো ‘পাওয়ার শিফটিং’ বা রাজনৈতিক রূপান্তরের বৈশিষ্ট্য হলেও প্রত্যাশা ছিল, বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম ‘অরাজনৈতিক’ আকাঙ্ক্ষার গণ–অভ্যুত্থানের পর ক্ষতির পরিমাণ কম হবে। কিন্তু চাইলেই এ ধরনের আকাঙ্ক্ষা অরাজনৈতিক রাখা যায় না এবং রাজনৈতিক হওয়াই যে তার অনিবার্য ভবিতব্য, সেটি আবারও প্রমাণিত হয়েছে। ফলে শেষমেশ বিজয়োল্লাস ‘বিশৃঙ্খলা’য় রূপান্তরিত হয়েছে।

একটি বৈপ্লবিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ‘অ্যানার্কি’ বা নৈরাজ্য ঘটা খুবই স্বাভাবিক প্রবণতা। ফরাসি বিপ্লবেও এমনটা ঘটেছিল। ১৯৭১ সালের মহাবিজয়ের পরও তেমনটি দেখা গিয়েছিল। আর বিপুল প্রত্যাঘাতের পর জয় এলে ‘কার্নিভ্যাল মোমেন্ট’ বা ‘উৎসব মুহূর্ত’ও পাগলপ্রায় হয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু রাজনৈতিক বাইনারিকরণ সে মুহূর্তটাকেও খুব কম সময়ের মধ্যেই গ্রাস করে ফেলেছে। গত ৫ আগস্ট গণ–অভ্যুত্থানে সরকার পতনের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে না পড়তেই সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেভাবে ভূপাতিত হয়েছে, তাকে শুধু নৈরাজ্য দিয়েও ব্যাখ্যা করা কঠিন।

কেন ভেঙে গেল এই ব্যবস্থাপনা

পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো ‘ইনকামবেন্ট রেজিম’ বা ‘কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতাসীন’ পাওয়া যাবে না, যারা মসনদে থাকলে প্রাত্যহিক নানা কারণেই জনগণের অন্তত একটা অংশ অসন্তুষ্ট হবেন না।

আর এই কর্তৃত্ববাদীর রাজদণ্ড যদি দীর্ঘদিন জোরপূর্বক জনগণের ওপর অগণতান্ত্রিক কায়দায় অসম আগ্রাসনে লিপ্ত হয়, স্বৈরাচারী হয়, নির্বিচার-বিনা বিচারে হত্যা-গুমে লিপ্ত হয়, তাহলে প্রত্যাঘাত শুধু অসন্তুষ্টি থেকে আসে না। সেই অসন্তুষ্টি যে কখন আগ্নেয়গিরির অগ্নু্যৎপাতের মতো ‘বুকের ভেতর দারুণ ঝড়/ বুক পেতেছি গুলি কর’ মানসিকতায় রূপ নিয়ে ফেলে, তা মসনদশাহিরা টের পান না; বরং তাঁরা মসনদের মোহে লাগাতার ভুল করতে থাকেন এবং টানা জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে যেতে এতটাই ক্ষুব্ধ করে ফেলেন যে যাবতীয় দৃশ্যমান উন্নয়নের (অদৃশ্যে দুর্নীতিও আছে) ডঙ্কা একদিকে বাজতে থাকলেও, বিদায়ঘণ্টার বাজনা অপর দিকে দ্রুত বাজতে থাকে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায়, আমলাতন্ত্রনির্ভর রাষ্ট্রে সরকারের হৃৎপিণ্ড দুটি—স্থায়ী সরকার ও অস্থায়ী সরকার। স্থায়ী সরকারের অংশ আমলারা। অস্থায়ী সরকারের অংশ রাজনীতিকেরা। রাজনৈতিক নেতৃত্বই মূলত সরকারের সব নীতিমালার সিদ্ধান্ত নেন, আমলারা আদিষ্ট হয়ে নীতিমালা নির্বাহ ও প্রতিপালন করেন। অস্থায়ী সরকার যাবে-আসবে, স্থায়ী সরকার চলমান থাকবে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, অস্থায়ী সরকারের পতনের পর স্থায়ী সরকারের ব্যবস্থাপনা এমনভাবে ভেঙে গেল যে পুরো রাষ্ট্র বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে গেল; জনগণের বিজয়োল্লাস বাঁধনহারা হতে হতে জন–অন্তর্ঘাতে পরিণত হলো।

কেন ভেঙে গেল এ ব্যবস্থাপনা? ভেঙে গেল কারণ, পুরো রাষ্ট্রটি এমন একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চালানো হয়েছে গত দেড় দশকে, যেখানে রাষ্ট্রের চেয়ে সরকার বড়, সরকারের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে নেতা বড়, নেতার চেয়ে সর্বোচ্চ পদাধিকারী বড় মনোভাব আধিপত্য দেখিয়েছেন। বাংলাদেশের বেদনা হচ্ছে এই যে স্বাধীনতার পর থেকে যাঁরাই ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁরা এই নীতির বাইরে গিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করেননি। সর্বশেষ রেজিমের কথা তো বলাই বাহুল্য! ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন ফিরে ফিরে আসে!

একটি একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমের মাধ্যমে বাংলাদেশের সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে হীন ব্যক্তিস্বার্থ, পারিবারিক স্বার্থ ও দলীয় স্বার্থে ব্যবহারই শুধু করা হয়নি, এগুলোর মেরুদণ্ড অনির্দিষ্টকালের জন্য রীতিমতো ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে জটিলতম সংকটের কালে এই প্রতিষ্ঠানগুলো মুখ তুলে দাঁড়াতে তো পারেইনি, উল্টো যে অনুগতদের দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান এতদিন চালানো হয়েছে, তঁারাও মহামহিমের মতো হয় পাততাড়ি গুটিয়ে পালিয়েছেন, নতুবা স্বেচ্ছায় তারাদের মতো খসে পড়েছেন কিংবা অভ্যুত্থান-পরবর্তী লঘু প্রতিরোধেই ভড়কে গেছেন।

নির্বাচনী স্বৈরাচার ও মুখ থুবড়ে পড়া সব প্রতিষ্ঠান

বাংলাদেশে এত দিনের সংকট তৈরি হয়েছে ডেমোক্রেসি (গণতন্ত্র) বনাম ডিক্টেটরের (স্বৈরাচার) যুযুধান লড়াইয়ে ডেমোক্রেসিকে ‘সিস্টেমেটিক ডিক্টেটরশিপ’ (প্রাতিষ্ঠানিক স্বৈরাচার) দ্বারা পরাজিত করিয়ে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান মোটাদাগে যে চার ধরনের স্বৈরাচারের কথা বলে, তার একটি ‘সামরিক স্বৈরাচার’, যেটি ছিলেন আইয়ুব-এরশাদ।

‘রাজকীয় স্বৈরাচার’ ছাড়া বাকি দুটি—‘একদলীয় স্বৈরাচার’ ও ‘একব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরাচার’ গত রেজিমের সঙ্গে খুব মানানসই। কিন্তু গত রেজিম ‘প্রাতিষ্ঠানিক স্বৈরাচার’ নামের একটি নতুন প্রকৃতির জন্ম দিয়েছে, যেখানে রাষ্ট্রের তামাম প্রতিষ্ঠানকে ‘যথাযথ উপায়ে’ ব্যবহার করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা হয়েছে।

তথাকথিত ‘নির্বাচনী গণতন্ত্র’কে কবর দেওয়া হয়েছে আইনসভায় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে ব্যবহার করে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে। সেটিও আবার ‘স্বাধীন’ বিচার বিভাগের দ্বারা আইনসিদ্ধ (লেজিটেমাইজ) করে এবং রায়কে মনগড়াভাবে সংসদে ব্যাখ্যা করে, যেন ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করা যায়।

বিচার বিভাগ যে নির্বাহী বিভাগ থেকে স্বাধীন না, তা কোটা সংস্কারের ক্ষেত্রে হাইকোর্টের রায়েই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আরও পরিষ্কার চরিত্র বোঝা যায়, ত্বকীর কথা ভাবলে, সাগর-রুনির কথা ভাবলে, তনু কিংবা মুনিয়ার কথা ভাবলে। এ কেমন বিচারব্যবস্থা, যেখানে ‘উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোলের’ সামনে বিচারের বাণী নিভৃতই শুধুই থাকেনি, রীতিমতো প্রহসন করেছে। সুবিচার চাইলেই জনগণ হয়ে গেছে ‘রাজাকার’।

‘নির্বাচনী স্বৈরাচার’ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে ভিন্নমতকে দমন করা হয়েছে নিবর্তনমূলক ডিএসএ-২০১৮ ও পরের সিএসএ-২০২৩ আইন প্রণয়ন করে। গলাটিপে ধরা হয়েছে কতিপয় সংবাদমাধ্যমের আর পক্ষান্তরে তৈরি করা হয়েছে দলীয় সাংবাদিক গোষ্ঠী যাঁরা সংবাদ সম্মেলনে গিয়ে বলতেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনাকে প্রশ্ন করার ধৃষ্টতা নেই!’ মানে এমন একটি চাটার গণমাধ্যম সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল, যার কাজ ছিল সরকারি ‘প্রেস নোট’ অনুযায়ী তোতাপাখির মতো মুখস্থ বুলি আওড়ানো।

রাষ্ট্র থেকে সরকারকে এবং সরকার থেকে সরকারি দলকে আলাদা করার সুযোগ থাকে, যদি স্থায়ী সরকার তথা আমলাতন্ত্র নির্বাহী বিভাগকে স্বতন্ত্র রাখতে পারে। কিন্তু বিগত দেড় দশকে আমলাতন্ত্র এমন এক মহীরূহে পরিণত হয়েছিল, যার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দশা ছিল দুর্নীতিগ্রস্তের অধিক দুর্দশাগ্রস্ত। বেসামরিক প্রশাসন পার্টিজেনদের মতো দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়ি ঘুরিয়েছে, জনগণকে মনে করেছে ঊনমানুষ।

জনগণের সেবক না হয়ে ও রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা না করে বিচারবহির্ভূত গুম-খুনে ব্যস্ত থেকেছে বাহিনীগুলো। যখন যেভাবে খুশি মেহনতি মানুষ থেকে মধ্যবিত্ত সবাইকে বল প্রয়োগ করে আর্থিকভাবে ও আইনের মারপ্যাঁচে হয়রানি করেছে। ঢাকার রিকশাওয়ালা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পাঁচ মিনিট গল্প করলেই পুলিিশ নির্যাতনের হাহাকার শুনতে পাবেন তাঁদের মুখশ্রীতে। এমনকি ৫ আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানের আগপর্যন্ত থানায় থানায় আন্দোলনকারীদের ধরে নিয়ে ‘গ্রেপ্তার–বাণিজ্য’ করেছে পুলিশ!

ক্ষমতাচর্চা ও ‘জি হুজুর’ সংস্কৃতি

নব্বই-পরবর্তী তথাকথিত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ ছিল চার ‘দ’— দল, দালাল, দখল ও দুর্নীতির দেশ। কিন্তু এ সংকট আরও ভয়ানক রূপ নিয়েছে গত দেড় দশকে। রাষ্ট্রের ঠিক কোন প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে কথা বললে এই চার ‘দ’ পাওয়া যাবে না, তা গভীর গবেষণার বিষয়। মহাডাকাত বড় বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের হাতে ব্যাংক খাত সর্বস্বান্ত হয়েছে। ঋণের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করাই শুধু হয়নি, নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান খোলাই হয়েছে শুধু টাকা পাচারের জন্য! প্রাণ-প্রকৃতি-ভূমি-নদী দখল করেছে দস্যুরা।

শেয়ারবাজার ‘দরবেশীয় কায়দায়’ লুট হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নররা ‘বিশেষ ক্ষমতাবলে’ টাকা ছাপিয়ে দেশে মুদ্রাস্ফীতি তৈরি করেছেন। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে সিন্ডিকেটবাজদের খপ্পরে পড়ে, যা এখনো নিয়ন্ত্রণহীন। অর্থনীতিতে ধস নেমেছে। আর ঢাল হিসেবে আমাদের শোনানো হয়েছে কোভিড ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের গল্প!

যখনই উন্নয়নের গালভরা গল্প শোনানো হয়েছে, সব ক্ষেত্রে  বলা হয়েছে, ‘আমি করে দিয়েছি’। যেন টাকাগুলো জনগণের নয়, সরকারপ্রধানের ব্যক্তিগত সম্পত্তি! এমন ‘নিওলিবারেল’ উন্নয়নবাদের গল্প ফেঁদে প্রতিটি মহাপ্রকল্প থেকে মহাডাকাতি করা হয়েছে। একদম ব্ল্যাঙ্ক চেকের মাধ্যমে জন্ম দেওয়া হয়েছে বেনজীর ও মতিউরদের। পিএসসির মতো প্রতিষ্ঠান বিগত ১০টি বিসিএসে প্রশ্নপত্র ফাঁসের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছে। মেডিকেলের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে বারবার। বিজি প্রেস কলঙ্কিত হয়েছে। তালিকা কি শেষ করা যাবে?

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকান। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে সন্ত্রাস ও হলগুলোতে ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’ খোলার শাস্তি তো ছাত্রলীগ পেয়েছে ১৭ জুলাই ক্যাম্পাসগুলো থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে। কিন্তু সরকার পতনের পরপরই দলে দলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের অব্যাহতি গ্রহণের হিড়িক কিংবা সাধারণ শিক্ষার্থীদের চাপের মুখে পদত্যাগ কি প্রমাণ করে না যে এই প্রশাসকদের এত দিনের হম্বিতম্বি ছিল আসলে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখারই আস্ফালন?

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাকে গত ১৫ বছরে যথেচ্ছ দলীয় শিক্ষক তথা ভোটার নিয়োগ দিয়ে কোমায় পাঠিয়ে ফেলা হয়েছে। এমন মেরুদণ্ডহীন বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক শিক্ষক সমাজই তো স্বৈরাচারের কাম্য, যারা প্রাতিষ্ঠানিক সম্ভ্রান্ততাকে ধ্বংস করে হলেও ‘জি হুজুর, জি হুজুর’ বলে যাবেন। নইলে মন্ত্রীর ফোন পেয়ে উপাচার্য চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে ‘জি স্যার’ বলেন কোন ইহজাগতিক ধর্মবলে!

গণ–অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা

ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘এলিফেন্ট ইন দ্য রুম’। মানে এমন একটি বিতর্কিত বস্তুর অস্তিত্ব আছে, যাকে নিয়ে আলাপ উঠানো যায় না। স্বৈরাচারী রেজিমে এ তকমা সবচেয়ে ভালোভাবে সেঁটে যায় সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের গায়ে। কিন্তু বিগত রেজিমের জন্য এটি অর্ধসত্য। আমলাতন্ত্র বড়জোর সবচেয়ে নির্ভরশীল ‘লক্ষ্মণরেখা’ হতে পেরেছিল।

নইলে ৫ আগস্ট সকালে দলীয় নেতা–কর্মী নয়, মন্ত্রীবর্গ নয়, বাহিনীগুলোর উচ্চ কর্তাদের কেন গণভবনে তলব করার প্রয়োজন হয়েছিল শেষ ভরসা হিসেবে? এটাই প্রাতিষ্ঠানিক স্বৈরাচারের চরিত্র, যা সর্বাত্মকভাবে জনগণের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগে বিশ্বাসী। ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা এ পুরোনো একটা দল ভেতর থেকে কতটা ভ্রষ্ট-ভঙ্গুর হয়ে গেলে সেটিও পার্টি-প্রতিষ্ঠান হিসেবে আর ফাংশন করে না, আমলাতন্ত্রনির্ভরতা সেটিও দেখিয়ে দিয়েছে।

ফলে পূর্ণ সত্য এই যে এলিফেন্ট ইন দ্য রুম হিসেবে কাউকে স্বীকৃতি দিতে হলে তা অবশ্যই প্রাপ্য খোদ এই ‘সিস্টেমেটিক ডিক্টেটরশিপের’ প্রবর্তকের। যার আঙুল হেলন ছাড়া এই বাংলাদেশে একটি গাছের পাতাও নড়ত না বলে পাগলেও বিশ্বাস করে ফেলেছিল, কিন্তু ওই যে ‘আলাপ উঠানো যায় না’!

এত এত দৃষ্টান্ত কি বলে না যে এই রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান স্বৈরাচারের ছত্রচ্ছায়ায় লালিত-পালিত হয়ে খোদ রাষ্ট্রটিকেই ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বানিয়ে দিয়েছে? ৫ আগস্ট থেকে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার আগপর্যন্ত প্রতিটি প্রতিষ্ঠান তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে। কারণ, তাদের নিয়ন্ত্রক তাদের এত দিন বামন করে রেখেছিলেন, জনকল্যাণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ-বঙ্গবন্ধু-উন্নয়নবাদের নামে।

অন্তর্বর্তী সরকার থেকে শুরু করে ভবিষ্যতের যত সরকারই আসুক, তাদের মাথায় রাখতে হবে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বকীয়, স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাখতে হবে। যে রোগে বাংলাদেশ আক্রান্ত হয়েছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কার করলেই তা সাড়বে না। প্রয়োজন বৈপ্লবিক দাওয়াই, শাসনতন্ত্র থেকে সমাজব্যবস্থা—সর্বত্র। এটা গণ–অভ্যুত্থানেরই আকাঙ্ক্ষা। নব্বইয়ের পটপরির্তন সে আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেনি, চব্বিশও যেন ব্যর্থ না হয়। শুধু ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’র ভ্রান্ত জিকির তুললেই হবে না, বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থেই মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র ‘সাম্য, মানবিক মর্যদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের’ জনগণতান্ত্রিক-জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে রূপান্তর এবার অনিবার্য হয়ে উঠেছে।

  • ড. সৌমিত জয়দ্বীপ সহকারী অধ্যাপক, স্কুল অব জেনারেল এডুকেশন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়