নতুন সরকার: এমন ‘অমৃতবচন’ আর চাই না

সব আলোচনা-সমালোচনা, তর্কবিতর্ক এবং ক্ষেত্রবিশেষে শঙ্কার মধ্যেই ৭ জানুয়ারির নির্বাচন শেষ হলো। নতুন সংসদ সদস্যেরা শপথ নিয়েছেন, মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে। মন্ত্রীরা নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছেন। অর্থাৎ, নতুন সরকার তাদের কাজ শুরু করেছে।

নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু হয়েছে, কতটা অংশগ্রহণমূলক হয়েছে—এ নিয়ে তর্কবিতর্ক হয়তো সামনের দিনগুলোতেও জারি থাকবে। তবে নতুন সরকার যেহেতু কাজ শুরু করেছে দিয়েছে, তাই তাদের ভাষা কেমন হওয়া উচিত, সেটা বোধ করি ভেবে দেখার বিষয়।

আমরা যখন অন্য কারও সঙ্গে কথা বলি কিংবা যোগাযোগ করি, তখন যে শব্দ কিংবা ভাষার ব্যবহার করি, তা আমাদের আচার-আচরণ এবং মানসিকতার পরিচয় বহন করে। ঠিক তেমনই, একটা সরকার এবং সেই সরকারের মন্ত্রী-এমপি-আমলারা রাষ্ট্রের নানা বিষয়ে কথা বলার সময় যে ধরনের শব্দ এবং ভাষার প্রয়োগ করেন, তা ওই সরকারের মনমানসিকতার পরিচায়ক। কিছু উদাহরণ দিয়ে বরং বুঝিয়ে বলা যাক।

যেমন ধরুন, দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ক্রমাগত বাড়ছিল। ওই সময় সরকারের এক মন্ত্রী বললেন, ‘দেশের মানুষ বেহেশতে আছে’, আরেকজন বললেন, ‘অর্থনীতি তো ভালোই আছে, আমার এলাকার নারীরা প্রতিদিন তিনবার লিপস্টিক দেয়’—এসব কথায় পরিষ্কার, সরকার কিংবা সরকারের দায়িত্বে থাকা মানুষগুলো হয় বাস্তবতার বাইরে বসবাস করছেন, না হয় তাঁরা সাধারণ মানুষকে নিয়ে উপহাস করছেন।

একটা দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সব সময় ভালো না-ও চলতে পারে। যদি অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক হয় কিংবা দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়, তাহলে সেটা স্বীকার করে নিন।

কোথায় কোথায় আপনাদের ভুল আছে, সেগুলো নিয়ে কথা বলুন। নইলে মানুষের মনে এই ধারণা তৈরি হবে যে সরকার হয়তো সাধারণ মানুষকে গুরুত্ব দিচ্ছে না।

অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কেমন, সেটা বোঝানোর জন্য দায়িত্বশীল এক মন্ত্রী বলে বসলেন, ‘আমাদের সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর মতো।’

এই বাক্য শুনতে কারওই খুব একটা ভালো লাগার কথা নয়। ওই একই মন্ত্রী এর কিছুদিন পর বললেন, অমুক দেশকে বলে এসেছি, তারা যেন আমাদের নির্বাচিত করে। দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে এমন মন্তব্য কি আসা উচিত? এতে সাধারণ মানুষের প্রতি সরকারের উদাসীনতা প্রকাশ পায়।

দায়িত্বশীল মানুষের ব্যবহার করা এসব শব্দ এবং ভাষা দেশের নাগরিকদের সরকারের আচরণ এবং মানসিকতা সম্পর্কে একধরনের বার্তা দেয়। তাই এ ধরনের ভাষা থেকে বিরত থাকা উচিত।

আবার ধরুন, দেশের কোনো একটা সমস্যা নিয়ে আলোচনা চলছে। এর মধ্যেই যদি একজন সংসদ সদস্য বলে বসেন, ‘আগের সরকারগুলো তো আরও খারাপ ছিল’...ইত্যাদি। ১৫ বছর ধরে একটা দল সরকার পরিচালনা করছে। এখন এই ধরনের কথাবার্তা বোধ করি মানুষ আর নিতে চাইবে না। তাই এ ধরনের আলোচনা বন্ধ করে সেখান থেকে বের হয়ে কীভাবে সামনে এগোনো যায়, সে কথা বলুন। অন্যদের দোষ দিয়ে কোনো ফায়দা নেই।

এই ১৫ বছরে পৃথিবীতে বসে মানুষ চাঁদের দক্ষিণ গোলার্ধ নিয়ে গবেষণা শুরু করেছে। রুয়ান্ডার মতো দরিদ্র দেশ মাথা উঁচু করে উঠে দাঁড়িয়েছে। তাদের রাজধানী শহর আফ্রিকার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহরে পরিণত হয়েছে।

করোনার মতো মহামারির মধ্য দিয়ে মানবজাতিকে যেতে হয়েছে। এর মধ্যে এর টিকাও আবিষ্কৃত হয়েছে। এই ১৫ বছরে মানুষের হাতে হাতে স্মার্ট ফোন এসেছে। মানুষ এখন মুঠোফোনে পৃথিবী দেখতে পায়। এই গ্রহে কোথায় কী হচ্ছে, সেটা মুহূর্তে জানতে পারে।

আর আপনারা যদি এরপরও ১৫ বছর আগে কে কী করেছে, সেটা নিয়ে পড়ে থাকেন। তাহলে নতুন প্রজন্ম হয়তো সেটা গ্রহণ করবে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে শব্দ কিংবা ভাষার ব্যবহার আরও উন্নত করা যায়?

উত্তরটা বোধ করি খুব সহজ। যখন একটা সরকার এবং সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী-এমপিরা দেশের জনগণ এবং একদম প্রান্তিক মানুষকে নিয়ে ভাববেন, তাঁদের গুরুত্ব দেবেন, তাঁদের মতামতকে প্রাধান্য দেবেন, বুঝতে শিখবেন যে সাধারণ মানুষের মতামতের মূল্য আছে; তখন এমনিতেই শব্দ ও ভাষার প্রয়োগে তাঁরা সতর্ক হবেন।

ব্যক্তি পর্যায়ে একটা মানুষ তখনই দাম্ভিক আচরণ করেন, যখন সে নিজেকে অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর মনে করেন। সরকারের ক্ষেত্রেও তা-ই। তাই সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তদের বুঝতে হবে, আপনাদের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আপনারা বিনয়ী হবেন।

ভাষার ব্যবহার তখনই ভালো হবে, যখন বুঝতে শিখবেন যে দায়িত্ব পালন না করতে পারলে জনগণ একটা না একটা সময় মুখ ফিরিয়ে নেবেই।

ড. আমিনুল ইসলাম জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি
ই-মেইল: tutul_ruk@yahoo.com