প্রথমেই জেনারেশন জেড নামে পরিচিত আন্দোলনকারী ছাত্রদের অভিনন্দন জানাই। আমরা অনেকেই ভাবতে শুরু করেছিলাম, আমাদের জীবদ্দশায় দেশ দুঃশাসনমুক্ত হবে না। তারা দেশকে ১৬ বছরের দীর্ঘ স্বৈরাচার, অপশাসন ও নির্যাতন থেকে রাহুমুক্ত করেছে। এ দীর্ঘ সময়ে নানান আন্দোলন-সংগ্রাম হলেও তা হালে পানি পায়নি। কিন্তু ছাত্ররা কেন সফল হলো, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
আমার মতে, ছাত্রদের আন্দোলনের সাফল্যের প্রধান কারণ তিনটি। এক. অন্য আন্দোলন-সংগ্রামগুলোর লক্ষ্য ছিল একটি স্থিতাবস্থার পরিবর্তে আরেকটি বিকল্প স্থিতাবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। যাতে সবকিছুই আগের মতো থাকবে।
কেবল নাটকের কুশীলব পরিবর্তন হবে, নতুন রাজা-রানি, যুবরাজ, পাইক-পেয়াদা দই-মাখন খাবে। শোষণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, ঘুষ, দুর্নীতি ও অপশাসন যথারীতি অব্যাহত থাকবে। এর বিপরীতে ছাত্রদের আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল খোলনলচে বদলে ফেলা, শোষণ, নির্যাতনমুক্ত গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা।
দ্বিতীয় কারণটি ব্যাখ্যা করতে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক প্রাক্তন ছাত্রীর (যার মেয়েও এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে), ৫ আগস্ট ভোররাত তিনটায়, ফেসবুকে দেওয়া পোস্ট উল্লেখ করা আবশ্যক মনে করছি।
পোস্টটি ইংরেজিতে দেওয়া। বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘আমি যাদের চিনি তাদের সবার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করছি। আমি আপনাদের যা কিছু বলেছি বা সঙ্গে যা কিছু করেছি, তাতে আপনারা আহত হয়ে থাকলে আমাকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ আমাদের সবার প্রতি অনুগ্রহ ও মঙ্গল করুন। এ কথাগুলো এ জন্য লিখছি, যদি আমি জীবিত ফিরে না আসি।’
আতিয়া নামের আমার ছাত্রীটি আন্দোলনের শুরু থেকে উত্তরা এলাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছাত্রদের খাবার ও পানি সরবরাহ করত।
পোস্টটি দেখে আতঙ্কিত হয়ে ভোরেই তাকে ফোন করি ও প্রাণশঙ্কার কথা উল্লেখ করে তাকে সুইসাইড মিশন থেকে বিরত থাকতে বলি। সে জবাবে বলে, ‘আমি তো রাস্তায় নেমে পড়েছি, স্যার, আপনিই বলেন আমরা কি আসলেই জীবিত আছি? একবার অন্তত বাঁচার চেষ্টা করি।’ আমি তার জবাব শুনে অসাড় ও হতভম্ব হয়ে পড়ি। হালুয়া-রুটির ভাগাভাগিতে আগ্রহী অন্য আন্দোলনকারীদের মধ্যে এ ধরনের প্রত্যয় ও আত্মত্যাগের মানসিকতা দেখা যায়নি।
সর্বশেষ কারণটি হলো তাদের পূর্বপ্রস্তুতি। আন্দোলনে নেতৃত্বদান ও অংশগ্রহণকারী জেনারেশন জেড বলে অভিহিত ছাত্ররা ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে ২০২৪ সালের আন্দোলনে উদ্ভাবনী কৌশল প্রয়োগ করেছিলেন এবং জনগণ তাতে সাড়া দেয়। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলের আন্দোলনগুলো ছিল গতানুগতিক।
তারা এমন একটি সমাজ ও জাতি চায়, যেখানে সবার জন্য সমান সুযোগ থাকবে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের লক্ষ্যও ছিল তা-ই। যেহেতু সরকারি চাকরির সংখ্যা সীমিত, তাই তাদের দাবি ছিল প্রধানত মেধার ভিত্তিতেই নিয়োগ প্রদান করতে হবে। এই প্রজন্ম একটি শোষণমুক্ত, গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর, যেখানে জনগণের প্রতিবাদের ও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার থাকবে। নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা মনোনয়নের মাধ্যমে ছাত্ররা তাদের সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করেছে।
লুণ্ঠন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ছাড়াও গত ১৬ বছরের অপশাসনের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো বিচার বিভাগ, সংসদীয় ব্যবস্থা, সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন, সাংবাদিকতাসহ সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে, অবাধ দুর্নীতির সুযোগের বিনিময়ে এগুলোয় পদলেহী ও আজ্ঞাবহ দুর্বৃত্তদের শীর্ষ পদে নিয়োগ প্রদান। আগামী সরকারের তাই একটি বড় কাজ হবে, এসব জঞ্জাল অপসারণ ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান নির্মাণ।
মেয়াদ: সাধারণভাবে তত্ত্বাবধায়ক উপদেষ্টা পরিষদের দায়িত্ব হলো নির্বাচন করা। কিন্তু ওপরের সংস্কারগুলো না করে কেবল নির্বাচন করলে তা অর্থবহ হবে না বা জনপ্রত্যাশা পূর্ণ করবে না।
তাই প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তাবিত উপদেষ্টা পরিষদকে অন্তত দুই বছর সময় দিতে হবে। তবে কোনো অবস্থাতেই উপদেষ্টা পরিষদের মেয়াদ সংবিধানে উল্লিখিত সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদের বেশি হবে না। অন্যথায় উপদেষ্টা পরিষদকে ঘিরে কায়েমি স্বার্থ গড়ে উঠবে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে হতাশা সৃষ্টি ও আমাদের গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন ব্যাহত হবে।
গঠন: ব্যয় সাশ্রয় ও কাজের পরিধি বিবেচনায় প্রধান উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যসংখ্যা ২০ জনে সীমিত হবে। প্রস্তাবিত উপদেষ্টা পরিষদে আমরা সততা, মেধা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার সমন্বয় দেখতে চাই। নারী, তরুণ ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব চাই।
আমরা অন্যের জবাবদিহি চাই, কিন্তু নিজেরা জবাবদিহি করতে চাই না। তাই আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণের সাত দিনের মধ্যেই তাঁরা নিজের ও পরিবারের সম্পদ বিবরণী ও কর প্রদানের নথি সরকারের কাছে দাখিল করে জবাবদিহির সূত্রপাত করবেন।
বলা বাহুল্য, উপদেষ্টা পরিষদ সৎ ও স্বজনপ্রীতিমুক্ত না হলে দুর্নীতির করালগ্রাস থেকে জাতিকে বাঁচানো যাবে না। অতীত সরকারের দুর্নীতি ছাড়াও ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতিমুক্ত রাখার জন্য তাঁদের সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে রাখতে হবে।
প্রয়োজনীয় দক্ষতা: বিদ্যমান সংকট মোকাবিলা, সংস্কার ও ভবিষ্যতের পথ সুগম করতে হলে ন্যূনতম যেসব ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ দক্ষতার প্রয়োজন হবে, তা হলো:
এক. সংবিধান ও বিচার বিভাগীয় সংস্কার।
দুই. জনপ্রশাসন সংস্কার।
তিন. আর্থিক সংস্কার।
চার. শিক্ষা ও সামাজিক খাত সংস্কার।
পাঁচ. বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত সংস্কার।
ছয়. অবকাঠামো খাত সংস্কার।
সাত. পররাষ্ট্রনীতি।
আট. সামাজিক নিরাপত্তা জাল।
নয়. প্রতিরক্ষা ও অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা।
সব ক্ষেত্রেই পুঁথিগত বিদ্যা অপেক্ষা উপদেষ্টাদের প্রায়োগিক জ্ঞান ও কর্মজীবনে সফলতা বা অর্জনের ওপর জোর দিতে হবে।
উপদেষ্টা নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। যেকোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সংগঠন উপদেষ্টা হিসেবে তাদের পছন্দের ব্যক্তিদের নাম বা তালিকা সুপারিশ করতে পারে। কিন্তু উপদেষ্টা নির্বাচনের ক্ষেত্রে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা প্রধান উপদেষ্টার ওপর ন্যস্ত করতে হবে।
ছাত্রদের শিক্ষাঙ্গনে ফিরে যেতে হবে ও ছাত্র সংসদ পরিচালনা করে জাতির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। যত দিন নতুন সরকার সঠিক পথে থাকবে, তত দিন নতুন সরকারকে সহায়তা প্রদান ও তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে হবে। পথবিচ্যুত হলে হুঁশিয়ারি প্রদান করে সরকারকে সঠিক পথে আনতে হবে।
আমরা জানি, যেকোনো বিপ্লবের মধ্যেই প্রতিবিপ্লবের বীজ রোপণ করা থাকে। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের স্বার্থেই এর অঙ্কুরোদ্গম বন্ধ করতে হবে। সে জন্য:
এক. আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে। মব জাস্টিসের প্রবণতা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করতে হবে।
দুই. বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মতো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেও বিদ্যমান রাজনৈতিক ধারাসমূহ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
তিন. ছাত্রদের ৯ দফা দাবি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।
চার. দ্রুত কাঠামোগত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও বিচারব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে।
পাঁচ. যোগ্যতার ভিত্তিতে শীর্ষ পদগুলোয় নতুন নিয়োগ দিতে হবে। ছয়. অর্থনীতির চাকা দ্রুত সচল করতে ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জরুরি প্রয়োজন মেটাতে হবে।
আমরা কেউ চাই না সাম্প্রতিক আন্দোলনে শহীদদের আত্মদান বৃথা যাক। জেনারেশন জেড-সূচিত বিপ্লব
সফল হোক।
মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান অর্থনীতিবিদ ও সাবেক সচিব