বন্দী কিশোরেরা কেন আত্মহত্যা করে

তিন কিশোরী ঈদের পরের সপ্তাহে আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়। গত ২৫ জুন রাত ১০টার দিকে সিলেট নগরীর শিবগঞ্জ লামাপাড়া এলাকার পুনর্বাসন কেন্দ্রের ছাদ থেকে তারা লাফিয়ে পড়তে চেয়েছিল। প্রথমে তারা চারতলা ভবনের ভেন্টিলেটর ভেঙে কার্নিশে উঠে তারপর হয়তো একটু ভয় পেয়ে ইতস্তত করতে থাকে। এলাকার লোকজন টের পেয়ে তাদের উদ্ধার করেন। 

প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, কিশোরীদের মনোভাব টের পেয়ে স্থানীয় লোকজন ভবনের নিচে অবস্থান নেন। কিশোরীদের আত্মহত্যা না করার জন্য নানাভাবে বোঝাতে থাকেন। এই ফাঁকে কিছু লোক জানালার গ্রিল ভেঙে কার্নিশ থেকে তাদের উদ্ধার করেন। এত হইহট্টগোল–চেঁচামেচি সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ ছিল কিছুটা ভাবলেশহীন দর্শক। তারা কেবল ফায়ার সার্ভিসে একটা ফোন দিয়ে চুপচাপ বসে ছিল। 

অন্য কেন্দ্রের পরিস্থিতিও খুব একটা ভালো নয়। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টার দিকে যশোরের পুলেরহাট শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের এক বালক আত্মহত্যার চেষ্টা করে। বন্দী বালক খোকন (ছদ্মনাম) হারপিক পান করে মরতে চেয়েছিল। পরে তাকে চিকিৎসার জন্য যশোর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বেঁচে ফিরে এলেও তার প্রয়োজনীয় মনঃসামাজিক চিকিৎসা হয়নি। শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বরং তাকে ‘মানসিক বিকারগ্রস্ত ও হতাশ বন্দীর’ তকমা লাগিয়ে দিয়েছেন। 

বিষপানের নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে খোকন বেঁচে থাকলেও আরেক শিশু বাবুলের (ছদ্মনাম) ভাগ্য তার সঙ্গে ছিল না। তাকে বাঁচানো যায়নি। বছর দুয়েক (১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২) আগে সে আত্মহত্যা করে। সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে কেন্দ্রের সহপরিচালক সংবাদকর্মীদের বলেছিলেন, ‘সকালে ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের ভেতরে অনুষ্ঠান চলছিল। অনুষ্ঠান চলাকালে বাবুল নিজ কক্ষে গিয়ে গলায় গামছা পেঁচিয়ে ফাঁস দেয়। পরে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে অন্য কিশোরেরা দেখতে পেয়ে ঝুলন্ত দেহ নামিয়ে কর্মকর্তাদের খবর দেয়।’ 

ভালোবাসা দিবসের জমজমাট অনুষ্ঠান ছেড়ে একটা বালক একা বেরিয়ে যাচ্ছে, সেটা কারও নজরে পড়ল না! তাকে মৃত আবিষ্কার করল অন্য কিশোরেরা! আটকে রাখা মনমরা শিশুদের ওপর নজরদারি কি তাহলে শুধুই একটা কাগুজে বিষয়? 

বেশ কয়েক বছর আগে গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে অবস্থিত কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্রে এক কিশোরী (১৫) আত্মহত্যার চেষ্টা করলে বিষয়টি প্রায় জাতীয় খবরে পরিণত হয়। বলা বাহুল্য, ঘুমের ওষুধ খেয়ে ওই কিশোরীর আত্মহত্যাচেষ্টা সফল হয়নি। ওই কিশোরী প্রেম করে বিয়ে করার ঘটনায় তার বাবার করা মামলায় কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্রে নিরাপত্তা হেফাজতে ছিল। কিশোরীর মা-বাবা দুজনই উচ্চশিক্ষিত। বাবা রাজধানীর একটি হাসপাতালের চিকিৎসক এবং মা আইনজীবী। 

আমরা যে যা–ই বলি না কেন, আত্মহত্যা আর আত্মহত্যাচেষ্টার ঘটনা শিশু-কিশোর পুনর্বাসন বা উন্নয়ন কেন্দ্রের প্রায় নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সব ঘটনা প্রকাশ্যে আসে না, আবার প্রকাশ্যে এলেও সেটাকে কীভাবে ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা দিয়ে সংবাদটি পত্রস্থ করতে হবে, সেটা আমাদের অনেকেরই অজানা। খবরের পাঠক বা দর্শক বাড়াতে আমরা সাধারণ নীতিনৈতিকতার ধার ধারছি না।

অনেক মা-বাবা নিজেদের সন্তানকে ‘শিক্ষা’ দেওয়ার জন্য এসব কথিত উন্নয়ন বা পুনর্বাসন কেন্দ্রে আইনের নানা ফাঁকফোকর দিয়ে বন্দী করে রাখেন। একবার এক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা তাঁর নিজের মেয়েকে সবার চেনা জনৈক ‘মানবাধিকারকর্মীর’ সহযোগিতায় আটকে রেখেছিলেন। কোনাবাড়ীর সেই সাড়া জাগানো আত্মহত্যাচেষ্টার ঘটনাকে গাজীপুরের তৎকালীন সমাজসেবা উপপরিচালক ‘গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ার জন্য চিকিৎসা’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। 

আমরা যে যা–ই বলি না কেন, আত্মহত্যা আর আত্মহত্যাচেষ্টার ঘটনা শিশু-কিশোর পুনর্বাসন বা উন্নয়ন কেন্দ্রের প্রায় নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সব ঘটনা প্রকাশ্যে আসে না, আবার প্রকাশ্যে এলেও সেটাকে কীভাবে ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা দিয়ে সংবাদটি পত্রস্থ করতে হবে, সেটা আমাদের অনেকেরই অজানা। খবরের পাঠক বা দর্শক বাড়াতে আমরা সাধারণ নীতিনৈতিকতার ধার ধারছি না।

সিলেটের ঘটনায় এলাকাবাসীর সক্রিয় চেষ্টায় কিশোরীদের প্রাণ রক্ষা ও উদ্ধারের খবর ছড়িয়ে পড়লে পুলিশ ছুটে আসে, ছুটে আসেন সাংবাদিকেরাও। সংবাদমাধ্যমের কেউ কেউ মন খারাপ কিশোরীদের ছবি নাম–ঠিকানাসহ অনলাইনে প্রকাশ করে দেন। এটা যে একটা অপরাধ এবং পুনরায় আত্মহত্যার প্ররোচনার শামিল, সেটা আমরা কবে অনুধাবন করতে পারব? 

সিলেটের পুনর্বাসন কেন্দ্রের কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, কিশোরীরা আত্মহত্যা নয়, পালানোর চেষ্টা করছিল। ঘটনাচক্রে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হওয়া শাহপরান থানার পুলিশ এখন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সুর মিলিয়েছে। তদন্তের আগে উপসংহারে পৌঁছানো দিন দিন আমাদের খাসলতের অংশ হয়ে যাচ্ছে। 

তবে জীবনে প্রথম সাংবাদিকদের কাছে পেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টাকারী তিন কিশোরী পুনর্বাসন কেন্দ্রের নিয়মিত ও অনিয়মিত যেসব নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছে, তা কোনোভাবেই চলতে দেওয়া যায় না। কিশোরীদের ভাষ্য অনুযায়ী, পুনর্বাসন কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা তিন ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে তাদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে আসছেন। তাদের সঙ্গে কথিত তিনজন খারাপ আচরণের সঙ্গে সঙ্গে অশ্লীল কথাবার্তাও বলেন। জামাকাপড় তো দূরে থাক, ঠিকমতো খাবার, গোসল, কাপড় কাচার সাবান, ব্যবহারের জন্য তেলও দেন না। যে কারণে পালাতে নয়, আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল তারা। 

কিশোরীদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ ‘বৈষম্য’–বিষয়ক। এসব কেন্দ্রে যারা পরিবারের মাধ্যমে আসে, তাদের প্রতি এক রকম আচরণ আর যারা পুলিশের মাধ্যমে আসে, তাদের প্রতি অন্য রকম আচরণ করা হয়। কিশোরীদের ভাষায়, ‘পুলিশ আমাদের এই পুনর্বাসন কেন্দ্রে দিয়েছে, তাই আমাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। কারণ, পুলিশ পুনর্বাসন কেন্দ্রে টাকা দেয় না। আর যাদের পরিবার থেকে কিংবা বিভিন্ন লোকজন পুনর্বাসন কেন্দ্রে দিয়ে যান, তাদের কদর করা হয়। কারণ, ওই ব্যক্তি বা পরিবারের লোকেরা প্রতিষ্ঠানে টাকা পাঠায়।’ এটি একটি গুরুতর অভিযোগ এবং নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি রাখে।

প্রতিষ্ঠানে আটকে রাখা শিশুদের কথা শুনতে হবে। ব্রিটিশরা যদি নিরপেক্ষ আর সমাজের মান্য লোকদের নিয়ে প্রতিটি জেলের জন্য বেসামরিক জেল পরিদর্শকের বিধান রাখতে পারে, আমরা কেন শিশুদের কথা শোনার জন্য নিরপেক্ষ পরিদর্শকব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি না। শিশু-কিশোরদের পেছনে ফেলে রেখে আমরা কি খুব বেশি দূর যেতে পারব? 

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক, গবেষক

nayeem5508@gmail.com