মতামত

ইউক্রেন যুদ্ধ যেভাবে ইউরোপের চরিত্র পাল্টে দিচ্ছে

রাশিয়ার সামরিক অভিযান চালানোর এক বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেছে
ফাইল ছবি

ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের নির্বাচন হতে এখনো এক বছর বাকি, কিন্তু ইতিমধ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়নজুড়ে (ইইউ) রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী প্রচারণার মেজাজে চলে গেছে। এই নির্বাচনে সন্দেহাতীতভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, অভিবাসন এবং ধর্ম—এ বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবে। এগুলোর বাইরে যে ইস্যুটি সব রাজনীতিককে এক ছাতার তলায় আনবে বলে মনে হচ্ছে, সেটি হলো রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালানোর এক বছরের বেশি সময় পর ইউরোপের মূলধারার পক্ষগুলো ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়ার ইস্যুতে এক সুরে কণ্ঠ মেলাচ্ছে। ইউক্রেন ইস্যুতে তাদের মধ্যে এই যে ঐক্য দেখা যাচ্ছে, তা কিন্তু ইউরোপের ‘অন্তরাত্মা’ নিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্দ্বকে আড়াল করছে। ইউরোপের সেই অন্তরাত্মাটি হলো তার স্বাধীনতার ধারণা।

এটি বিশদ পরিসরে স্বীকৃত যে ইউক্রেনের এই প্রতিরোধ লড়াই গণতন্ত্র এবং ইউরোপিয়ান মূল্যবোধকে টিকিয়ে রাখার লড়াই হিসেবে ইউরোপিয়ানরা দেখে থাকে। আবার এ–ও ঠিক যে এই লড়াইয়ে ইউরোপকে জিততে হলে তাকে তার নিজের স্বাধীনতা প্রকল্পের কিছু প্রধান বিষয়কে জলাঞ্জলি দিতে হবে। এটিই ইউরোপের স্বাধীনতার ধারণার সবচেয়ে বড় কূটাভাস।

সর্বজনীনতা, সামরিক জবরদস্তি থেকে বিরত থাকা, বৃহত্তর জোটের সার্বভৌমত্বের স্বার্থে নিজেদের সার্বভৌমত্বে ছাড় দেওয়া, ইউরোপকে একটি একক সত্তা হিসেবে মনে করা—এগুলোর ওপর দাঁড় করানো একটি গুচ্ছনীতি অর্ধশতাব্দী ধরে আত্মস্থ করে ইউরোপ তার স্বাধীনতার ধারণা গড়ে তুলেছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি ইইউকে অন্যান্য অঞ্চল থেকে, এমনকি এর সদস্যদেশগুলো থেকেও আলাদা করেছে। কিন্তু রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ ইইউ ব্লকের এই মৌলিক নীতিগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এবং সন্দেহপ্রবণ জাতীয় নেতাদের এই নীতিগুলোকে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ করে দিয়েছে।

ইউরোপীয়রা আগে তাঁদের কার্যক্রমকে জাতীয়তার ঊর্ধ্বের বিষয় বলে ভাবতেন কিন্তু এখন তাঁরা স্বীকার করেন, ইইউ মডেল সর্বজনীন নয়; বরং ব্যতিক্রমী। গত বছরের পুরোটা সময়ে ইউরোপীয় নীতিনির্ধারকেরা পূর্ব এবং দক্ষিণে অন্যান্য রাজনৈতিক প্রকল্পে না গিয়ে ইইউয়ের সীমানাকে শক্তিশালী করার বিষয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন। এর ফলে মূলত ইউরোপ মহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে যে ইউরোপীয় একত্রীকরণ হয়েছিল, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তা এখন একটি ‘সশস্ত্র শান্তি’ ও নিরাপত্তা প্রকল্পে রূপান্তরিত হচ্ছে।

যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে ইইউর উদারনৈতিক মূল্যবোধ এবং এর যুদ্ধকালীন প্রস্তুতির মধ্যে যে উত্তেজনা দেখা যাচ্ছিল, তা নিয়ে খুব কমই আলাপ–আলোচনা হচ্ছিল। টেকনোক্রেটিক ইউরোপীয় কমিশন রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইউক্রেনকে সশস্ত্র করার পরামর্শ দিয়ে যুদ্ধকে সমর্থন করেছিল। এর ফল হিসেবে ইউরোপ নীতিগত দিক থেকে তার চরিত্র হারিয়ে ফেলছে।

ইউরোপীয় কমিশন রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে ইইউ অর্থনীতিকে অস্ত্র বানিয়েছে এবং অর্থনৈতিক যুদ্ধকে তীব্রতর করেছে। সর্বোপরি তারা রেশনিংয়ের মাধ্যমে জ্বালানি সরবরাহ ও জ্বালানি মূল্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক যুদ্ধকে রূপ দেওয়ার কাজ সম্পন্ন করেছে। কিন্তু ইউরোপের রাজনৈতিক চিন্তাধারায় সবচেয়ে নাটকীয় যে পরিবর্তনটি হয়েছে, তা হলো পারস্পরিক নির্ভরতার বিষয়টি আগের মতো চলতে পারবে কি না, তা তারা পুনর্বিবেচনা করছে।

ইউরোপের দেশগুলো যদি নিজেদের মধ্যে অর্থনৈতিক বন্ধনকে জোরালো করে, তাহলে নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব মিটে যাবে এবং পারস্পরিক শত্রুতা একপর্যায়ে মিত্রতায় পরিণত হবে—এমন একটি বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে ইউরোপ এক হয়েছিল। কিন্তু পুতিন দেখিয়ে দিয়েছেন, পারস্পরিক নির্ভরতাকেও চাঁদাবাজির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

দশকের পর দশক ধরে ইউরোপের দেশগুলো নিজেদের সার্বভৌমত্বে ছাড় দিয়ে আসছে। ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করা, এক দেশের নাগরিকের অবাধে অন্য দেশে ভ্রমণ করাসহ নানা ধরনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এসব দেশের মানুষের উগ্র জাতীয়তাবাদকে বশে রাখাই এর মূল লক্ষ্য। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অভিবাসী ও শরণার্থীর স্রোত এবং অর্থনৈতিক বিষয়-আশয়ের কারণে ইউরোপীয় নাগরিকেরা জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। তাঁরা এখন মনে করছেন, সার্বভৌমত্ব সংরক্ষিত হওয়া দরকার।

যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে ইইউর উদারনৈতিক মূল্যবোধ এবং এর যুদ্ধকালীন প্রস্তুতির মধ্যে যে উত্তেজনা দেখা যাচ্ছিল, তা নিয়ে খুব কমই আলাপ–আলোচনা হচ্ছিল। টেকনোক্রেটিক ইউরোপীয় কমিশন রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইউক্রেনকে সশস্ত্র করার পরামর্শ দিয়ে যুদ্ধকে সমর্থন করেছিল। এর ফল হিসেবে ইউরোপ নীতিগত দিক থেকে তার চরিত্র হারিয়ে ফেলছে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

  • মার্ক লিওনার্ড ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের পরিচালক