সেই ’৯০-এর দশক থেকে ভারতের জাতীয় নির্বাচনগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে আসছি। কিন্তু একটা বিষয় আগে কখনোই দেখিনি। আর তা হলো দেশটিতে শুরু হওয়া নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফল আগে থেকে অনেকটা নিশ্চিতভাবে বলে দেওয়া। বরং এখন বিতর্কটা হচ্ছে যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কত বড় ব্যবধানে তৃতীয়বারের মতো পুনর্নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। (ভারতের লোকসভা নির্বাচন ১৯ এপ্রিল শুক্রবার থেকে শুরু হয়ে সাত দফায় চলে ১ জুন শেষ হবে।)
মোদির সমালোচকেরা বলছেন যে তিনি নির্বাচনের ফল নিজের দিকে আনার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করছেন, সরকারি গোয়েন্দা ও অন্যান্য সংস্থাকে নিয়োগ করেছেন বিরোধীদের দমন করার জন্য। তারপরও এসব পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তেমন কোনো জনরোষ দেখা যায়নি। আর তাই প্রশ্ন উঠেছে, কীভাবে একটি প্রাণবন্ত গণতন্ত্র লৌহমানবের শাসন মেনে নিচ্ছে?
আমার অভিমত হলো যে আমরা একধরনের মৌন সমঝোতার দিক অগ্রসর হয়েছি, যেখানে দোদুল্যমান ভোটাররা মোদির অধীনে গণতন্ত্রের মন্দা মেনে নিয়েছে যতক্ষণ পর্যন্ত মোদি অর্থনৈতিক অগ্রগতি জারি রাখতে পারছেন, ততক্ষণ।
ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) কট্টর সমর্থকেরা সব সময়ই যেকোনো মূল্যে তাঁদের নেতা ও দলের হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের সঙ্গে রয়েছেন। তবে বর্ধিত সংখ্যক তরুণ ও নতুন ভোটারদের কাছে আকর্ষণীয় হয়, মোদি এমন কিছু সামনে তুলে ধরে তাঁর গতানুগতিক ভিত্তিভূমি বেশ ভালোভাবেই সম্প্রসারণ করতে সক্ষম হয়েছেন।
অবস্থাটা এখন যেন সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পূর্ব এশিয়ার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। সেই সময়টায় দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানে একনায়কতান্ত্রিক নেতাদের অধীনে দীর্ঘ সময় ধরে দ্রুত প্রবৃদ্ধি ও নিম্ন মূল্যস্ফীতির বলয়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। এই নেতারা সত্যিকারে অবাধ নির্বাচনের পথ খুলেছিলেন তাঁদের দেশ মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার পর।
মোদির অধীনে ভারত তুলনামূলকভাবে তেজি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং নিম্ন ও স্থিতিশীল মূল্যস্ফীতির অভিজ্ঞতা লাভ করেছে, যা অনেকটাই সেই পূর্ব এশিয়ার প্রথম দিকের উন্নয়ন ধাঁচের মতো। সেই সঙ্গে রয়েছে ক্রমাগত ফুলে ওঠা শেয়ারবাজার, ঝলমলে অবকাঠামো প্রকল্পের বিস্তার এবং নতুন সব ডিজিটাল পাটাতন, যা বিভিন্ন কল্যাণমূলক সুবিধা জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে ভূমিকা রাখছে।
মোদির গণমাধ্যম যন্ত্র দেশের মধ্যে ক্রমাগত এটা বুঝিয়ে যাচ্ছে যে তাঁর সক্রিয় পদক্ষেপের কারণেই বিশ্বমঞ্চে ভারতের অবস্থান ক্রমেই উচ্চতর হচ্ছে। বিহারের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ম্যানহাটানে বসবাসকারী ধনাঢ্য প্রবাসী ভারতীয়—সবার কাছ থেকে আমিও এ কথাই শুনতে পেয়েছি বিভিন্ন সময়ের সফরে।
অবশ্য বাইরের দেশের কারও কাছে এটা উপলব্ধি করা কঠিন যে একটি উদীয়মান দেশের জন্য বৈশ্বিক মর্যাদা ও অবস্থান কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। সেই পুরোনো কৌতুকটা উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনজন লেখককে তাঁদের পছন্দের একটা বিষয়ে লিখতে বলা হলো। ব্রিটিশ লেখক লিখলেন যে কীভাবে দুনিয়া শাসন করতে হয়, আমেরিকান লেখক লিখলেন যে কীভাবে টাকা বানাতে হয় আর ভারতীয় লেখক লিখলেন যে দুনিয়া ভারত সম্পর্কে কী চিন্তা করে।
এ যুক্তি তো দেওয়াই যায় যে মোদির আগে থেকেই ভারতের উত্থান শুরু আর তা হয়েছিল ১৯৯০-এর দশকে কংগ্রেসের নেওয়া অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচির সুবাদে। ২০১৪ সালে যখন মোদি ক্ষমতায় আসেন তখন ভারত তো বিশ্বের দশম বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে গেছে। এখন অবশ্য অতীতের ওই সব অর্জনকে ভুলে যাওয়া হচ্ছে আর কংগ্রেস-নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়টাকে মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে দুর্বল নেতৃত্ব, ব্যাপক দুর্নীতি আর নাজুক অর্থনীতির কাল হিসেবে।
অনেক উদারপন্থী ভারতীয় এখন সেই ভাষাতেই কথা বলছেন, যেটা আমি পূর্ব এশিয়ায় শুনতে অভ্যস্ত। তাঁরা বলছেন যে ভারতে এখনো ‘কথা বলার স্বাধীনতা আছে, কিন্তু কথা বলার পর স্বাধীনতা নেই।’ বেছে বেছে শাস্তির মুখে পড়ার ভয়ে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা প্রায় কেউই আর এমন কিছু বলেন না যা সরকারের ন্যূনতম সমালোচনা হয়ে যায়। দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত বা বিচারের মুখোমুখি হওয়া ৯৫ শতাংশ রাজনীতিবিদই বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দলের।
এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে পিউ রিসার্চ জরিপে ৬৭ শতাংশ উত্তরদাতা এমন একজন ‘শক্তিশালী নেতার’ পক্ষে সমর্থন দিয়েছে, যিনি ‘সংসদ বা আদালতের হস্তক্ষেপ ছাড়াই সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম।’ মোদির ক্ষমতায় থাকার প্রথম বছরগুলোয় এ ধরনের উত্তরদাতার হার ছিল প্রায় ৫৭ শতাংশ। এটাই ছিল পূর্ব এশিয়ার দর–কষাকষির নির্যাস এবং ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি এটাকে মেনে নেওয়া সহজ করেছিল।
পশ্চিমা বিশ্বের সরকারগুলো ভারতে তেজস্বী চীনের বিপরীত শক্তি হিসেবে দেখতে আগ্রহী। আর তাই তারা নাগরিক ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়ে নয়াদিল্লির সঙ্গে আলাপচারিতায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নীরবই থাকছে। আর তাই মোদি যে একটি শক্তিশালী ও জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র গড়ে তুলছেন, যা ভারতের ভাবমূর্তি সমুন্নত করছে—এই দাবি নিয়ে নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো কারণ ভোটাররাও খুঁজে পাচ্ছেন না।
অনেক উদারপন্থী ভারতীয় এখন সেই ভাষাতেই কথা বলছেন, যেটা আমি পূর্ব এশিয়ায় শুনতে অভ্যস্ত। তাঁরা বলছেন যে ভারতে এখনো ‘কথা বলার স্বাধীনতা আছে, কিন্তু কথা বলার পর স্বাধীনতা নেই।’ বেছে বেছে শাস্তির মুখে পড়ার ভয়ে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা প্রায় কেউই আর এমন কিছু বলেন না যা সরকারের ন্যূনতম সমালোচনা হয়ে যায়। দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত বা বিচারের মুখোমুখি হওয়া ৯৫ শতাংশ রাজনীতিবিদই বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দলের।
তারপরও ভারতীয় গণতন্ত্রের মৃত্যুঘণ্টা বেজে গেছে, এমনটা এখনই বলা বেশি তাড়াতাড়ি হয়ে যায়। সমালোচকেরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন, বিজেপির সাংগঠনিক পেশিশক্তি এবং মুসলমান ও অন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের অপব্যবহারকে মোদির উত্থানের পেছনে মূল চালিকা হিসেবে অভিহিত করেছেন। কিন্তু বিজেপির অভূতপূর্ব সাফল্যকে সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা করা যায় মোদির ব্যক্তিগত নৈপুণ্য ও আবেদন দিয়ে। যেসব রাজ্যসভার নির্বাচনের ব্যালটে মোদির নাম ছিল না, সেসব নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল ভালো করতে পারেনি। ভারতের ২৮টি রাজ্যের প্রায় অর্ধেক শাসন করলে বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দল।
ভারতের গণতন্ত্র মন্দাদশায় পতিত হয়েছে, কিন্তু এখনো অকেজো হয়ে পড়েনি। ভোটাররা এখানে রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিনিময়ে দৃশ্যমান অগ্রগতি কিনে নিতে সম্মত হয়েছেন। তবে এই বিকিকিনির সমঝোতাটা কিন্তু মোদির সঙ্গে। আর তাই এটা তত দিন বজায় থাকবে, যত দিন মোদি ক্ষমতায় থাকবেন এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুফল সরবরাহ করে যেতে পারবেন।
রুচির শর্মা রকফেলার ইন্টারন্যাশনালের চেয়ার। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আসজাদুল কিবরিয়া