মনে পড়ে ছোটবেলার কথা। পরীক্ষা বিষয়টাকে যমের মতো ভয় পেতাম। পরীক্ষার তারিখ কোনো কারণে পেছালে আনন্দের অন্ত থাকত না। স্কুলে থাকতে মনে পড়ে, পরীক্ষা পেছানোর জন্য যারা সবচেয়ে সচেষ্ট থাকত, আমি তাদের একজন। এর কারণ যে প্রস্তুতির অভাব, তা নয়। আমার মেধা যেমনই হোক, পরিশ্রমের কোনো কমতি কোনো কালেই ছিল না। ঘণ্টা ধরে নিয়ম করে অতি উৎসাহের সঙ্গে প্রতিদিনের পড়া প্রতিদিন আমার মতো শেষ করা বাচ্চার সংখ্যা এখনো যেমন খুব বেশি নেই, তখনো ছিল না। পড়ার জন্য আমাকে কখনো শাসন করতে হয়েছে বলে মনে পড়ে না। কিন্তু তারপরও আমার পরীক্ষাভীতি ছিল যমের মতো।
অবশ্য এই পরীক্ষা দিতে না-চাওয়ার দলে আমি একা নই। যেচে পরীক্ষা কে দিতে চায়, বলেন? তবে এর মধ্যে ব্যতিক্রম দেখলাম এই নির্বাচন কমিশনকে। তারা পরীক্ষা দেওয়ার জন্য অস্থির। ২৫ এপ্রিল নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, ‘নির্বাচনে এসে আমাদের পরীক্ষা নিতে আপনাদের (বিএনপি) আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আপনারা আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন না। পরীক্ষা না নিয়ে আপনারা কীভাবে জানলেন, আমরা ফেল করব? আমরা সব সময় পরীক্ষা দিতে প্রস্তুত।’
পরীক্ষা দিতে সব সময় প্রস্তুত থাকে দুই ধরনের ছাত্র—এক. যারা নিয়মিত পড়াশোনা করে রেজাল্ট ভালো করে এবং জানে যে পরীক্ষা দিলে আবারও ভালো ফলই আসবে।
আর দুই. যারা জানে পরীক্ষায় পাস করা তাদের কম্মো নয় এবং তাতে তাদের কিছুই যায় আসে না। কারণ, বিষয়টিতে তারা অভ্যস্ত। নির্বাচন কমিশন কোনটার মধ্যে পড়ে, সে বিষয়ে আলোচনার আগে দেখে নিই, তারা নিজেদের ব্যাপারে কী ভাবছে। ইসি আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা (নির্বাচন কমিশন) এখন পর্যন্ত ভালো কাজ করছি এবং ভবিষ্যতেও ভালো কাজ করব।’ ছাত্র আত্মবিশ্বাসী সন্দেহ নেই, কিন্তু এই আত্মবিশ্বাসের ভিত্তি কী, আমার জানা নেই। শপথ নেওয়ার পর থেকে তাদের যে ইতিহাস, তা মোটেও সুখকর নয়।
শপথ নেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার নির্বাচনকে তুলনা করেন যুদ্ধক্ষেত্রের সঙ্গে। তিনি বিরোধী দলকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির মতো মাঠে থাকার পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘আমি বলতে চাচ্ছি, মাঠ ছেড়ে চলে আসলে হবে না। মাঠে থাকবেন, কষ্ট হবে। এখন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট হয়তো দৌড়ে পালিয়ে যেতে পারতেন, কিন্তু উনি পালাননি। তিনি বলছেন, “আমি রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করব।” তিনি রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিরোধযুদ্ধ করে যাচ্ছেন।’ তিনি যুক্ত করেন, ‘নির্বাচনের ক্ষেত্রও একটি যুদ্ধ, সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। যেখানেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়, সেখানে কিছুটা ধস্তাধস্তি হয়। এগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে ইসি চেষ্টা করবে। একজনের শক্তি দেখে চলে গেলে হবে না। দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। নেতা-কর্মীদের কেন্দ্রে কেন্দ্রে থাকতে হবে। তাঁরা যদি ভোটকেন্দ্রে না থাকেন, তাহলে অন্য পক্ষ অবাধে ভোট দিতে থাকবে। ইসি তা চায় না। ইসি প্রতিদ্বন্দ্বিতা চায়।’
নির্বাচন যদি যুদ্ধক্ষেত্রই হবে, তাহলে আর কমিশনের প্রয়োজন কী? দলগুলো, যারা নির্বাচনে অংশ নেবে তারা মল্লযুদ্ধের মাধ্যমেই ঠিক করে নেবে জয়-পরাজয়। একটি মোটামুটি আদর্শ ব্যবস্থায় নির্বাচন সুষ্ঠু করার দায় কোনো রাজনৈতিক দলের নয়। নির্বাচনে যদি বিরোধী দলের একজন কর্মীও মাঠে না থাকেন, তারপরও নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখা, মাঠে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা, ভোটাররা যাতে নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারেন এবং নির্ভয়ে তাঁর পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন, সেটি নিশ্চিতের দায়িত্ব একমাত্র নির্বাচন কমিশনের। ইসি দাবি করছে, তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা চায়। কিন্তু এটি কী ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা? মারামারির আর কেন্দ্র দখলের? যুদ্ধক্ষেত্রের যে উদাহরণ তিনি টেনেছেন, তাতে তো এমনটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক, নয় কি?
ইসি ধস্তাধস্তি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কথা বলেছে। অথচ সেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং প্রশাসনের মধ্যম সারির কর্মকর্তারাও ইসির নিয়ন্ত্রণে নেই। ইসির পক্ষ থেকে আয়োজিত এক সংলাপে বক্তব্য দিতে গিয়ে ডিসিদের নিরপেক্ষতা নিয়ে একবার প্রশ্ন তুলেছিলেন কমিশনার আনিসুর রহমান। মাঠ প্রশাসনের কর্তাদের ‘নখদন্তহীন’ এবং তাঁরা ‘মন্ত্রী-এমপিদের ছাড়া চলতে পারেন না’ বলে মন্তব্য করেছিলেন তিনি। তাঁর বক্তব্যের এ পর্যায়ে সভাকক্ষের মধ্যেই একযোগে ডিসি-এসপিরা হইচই শুরু করেন। এ সময় সিইসিসহ অন্য কমিশনার এবং জননিরাপত্তা বিভাগের সচিবও মঞ্চে ছিলেন। শেষমেশ কমিশনার আনিসুর রহমান বলেন, ‘তাহলে কি আপনারা আমার বক্তব্য শুনতে চান না?’ তখন সবাই একযোগে ‘না’ বললে নিজের বক্তব্য শেষ না করেই বসে পড়েন তিনি।
ডিসি-এসপিদের এ আচরণ সংবিধান ও আইনের সরাসরি লঙ্ঘন। কমিশনের যেকোনো আদেশ বা নির্দেশ তাঁরা শুনতে বাধ্য। বাংলাদেশের পদমর্যাদাক্রমে (ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স) নবম অবস্থানে থাকা একজন সাংবিধানিক পদধারীকে চরমভাবে অপমান করেছেন পদমর্যাদাক্রমে ২৪ নম্বরে থাকা ডিসি-এসপিরা। কিন্তু সেটার জন্য শাস্তি পাওয়া দূরেই থাকুক, ন্যূনতম জবাবদিহির আওতায় আসতে হয়নি ওই সব মধ্য পর্যায়ের আমলাদের। এতে নির্বাচনকালীন এসব কর্মকর্তা কতটুকু ইসির নিয়ন্ত্রণে থাকবেন, সেই প্রশ্ন খুব যৌক্তিকভাবেই ওঠে। ভুলে গেলে চলবে না, নির্বাচনের দিন মাঠের রাজত্ব এই কর্মকর্তাদের হাতেই থাকে।
এই ইসির অধীন পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন হতে যাচ্ছে। সেগুলোতে বিএনপিকে অংশগ্রহণ করানোর ব্যাপারে একধরনের তাগিদ আছে ইসির দিক থেকে। কিন্তু এই ইসির অধীন অতীতে যেসব নির্বাচন হয়েছে, সেগুলো কেমন ছিল? উদাহরণ হিসেবে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের কথা আনা যায়। সেই নির্বাচনে স্থানীয় এমপি বাহাউদ্দিন বাহারকে এলাকা থেকে সরাতে নাকানিচুবানি খেতে হয়েছিল ইসিকে। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে তাঁকে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দেয় ইসি। তিনি সিটি করপোরেশন এলাকার বাসিন্দা। তাঁর বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের একাধিক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিন্তু বাহার নির্বাচন কমিশনের আদেশকে ন্যূনতম কোনো পাত্তা দেননি। নির্বাচন কমিশনের আদেশের বিরুদ্ধে তিনি অবশ্য উচ্চ আদালতে একটি রিট করেছিলেন, যেখানে আদালত রুল দিলেও নির্বাচন কমিশনের আদেশকে স্থগিত করেননি বা অবৈধ বলেননি। আর নির্বাচন কমিশনও বাহারকে এলাকার বাইরে যেতে আদেশ দেওয়া ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
একপর্যায়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল তাঁর অসহায়ত্ব প্রকাশ করে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘ইসির নির্দেশনা পাওয়ার পর একজন সংসদ সদস্য এটাকে অনার না করলে কমিশনের তেমন কিছু করার নেই। আমাদের এমন কোনো ক্ষমতা নেই যে কাউকে জোর করতে পারি। আমরা তো আর কাউকে কোলে করে নিয়ে যেতে পারি না।’
এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘বাহারকে নির্বাচনী এলাকার বাইরে পাঠাতে নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট ব্যবস্থা নেয়নি, তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করেনি। বাহার যদি না যান, তাহলে কমিশন চাইলে নির্বাচন স্থগিত করে দিতে পারত, সেটা করেনি। আমরা কমিশনে যখন ছিলাম, তখন কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমকে এ প্রক্রিয়ায় এলাকার বাইরে পাঠাতে সক্ষম হয়েছিলাম। তিনি সেখানে গিয়ে দরবার বসিয়েছিলেন। তাঁকে বলেছিলাম, আপনি সরে না গেলে নির্বাচন স্থগিত করে দেব। তিনি সরে যেতে বাধ্য হন। তখন তো এই সরকারই ছিল’ (ডয়চে ভেলে বাংলা ১৩/৬/২২)।
এই নির্বাচনের পরপরই যে কথাটি ভীষণভাবে আলোচনায় আসে তা হলো, যে কমিশন একজন সংসদ সদস্যকে সামলাতে পারে না, সেই কমিশন জাতীয় নির্বাচনের সময় ৩০০ আসনের ৩০০ জন সংসদ সদস্যকে কী করে নিয়ন্ত্রণ করবে? শুধু তো সংসদ সদস্য নয়, বেশ কিছু আসনে আছেন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীর মতো অতি ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, তাঁদের কমিশনের আদেশ মানানো দূরেই থাক, তাঁদের আদেশ মানতে গিয়ে কমিশনের গলদঘর্ম হতে হবে।
নির্বাচন কমিশন আগামী নির্বাচনটি কীভাবে করতে চায়, তার আরেক প্রমাণ আমাদের সামনে এল কিছুদিন আগে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের দিন সাংবাদিকদের পালনীয় একটি নীতিমালা প্রকাশ করেছে। এতে ভোটের দিন সাংবাদিক এবং গণমাধ্যমকর্মীদের মোটরসাইকেল ব্যবহার করতে না পারা, ভোটকেন্দ্রের ভেতরে এবং গণনার সময় লাইভ সম্প্রচার কিংবা ফেসবুক লাইভ করায় নিষেধাজ্ঞা, ভোটকেন্দ্রে একই সঙ্গে দুটির বেশি সংবাদমাধ্যমের কর্মীর ঢুকতে না পারা, কেন্দ্রে সাংবাদিকদের ১০ মিনিটের বেশি অবস্থান করতে না পারা এবং কেন্দ্রে নির্বাচনী কর্মকর্তা, এজেন্ট ও ভোটারদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার নিষেধাজ্ঞাসহ অনেকগুলো নিয়ম করা হয়েছে। খুব সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানেই বোঝা যায়, সাংবাদিকদের রীতিমতো হাত-পা বেঁধে ফেলে নির্বাচনের অনিয়ম এবং কারচুপি ধামাচাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যেই তৈরি করা হয়েছে এই নীতিমালা।
এ ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর ইভিএমের বিষয়ে অবস্থানের ক্ষেত্রে ইসির মিথ্যাচার, সরকারি দলের চাওয়া ইভিএমকে নির্বাচনে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা, কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু করতে না-পারা এবং হালে চট্টগ্রাম উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির করুণ দশাসহ আরও নানা অভিযোগ আমলে নিলে তাদের ব্যর্থতার তালিকা দীর্ঘ। এই নির্বাচন কমিশন পরীক্ষা দিতে চেয়েছে, তারপর পাস বা ফেল করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে বলেছে। যে কমিশন গঠিত হওয়ার দিন থেকে একের পর এক ফেল করে যাচ্ছে, তাদের এত পরীক্ষার শখ কিছুটা আশ্চর্যেরই বটে। পরীক্ষা দেওয়ার জন্য তাদের এই সীমাহীন উৎসাহের কারণ সম্ভবত সরকারের ইচ্ছামাফিক যেকোনো প্রকারে বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসা। কারণ, শুরু থেকেই সরকারের ইচ্ছার বাস্তবায়নই এই কমিশনের একমাত্র সফলতা, অন্য কিছু নয়।
রুমিন ফারহানা বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ও হুইপ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী