সন্তানকে ‘নাদুস-নুদুস চেহারায়’ দ্রুত বড় করার মনোবৃত্তি কেন?

আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ—বহুল চর্চিত এ কথা সবার জানা। তবে সময় এসেছে, আজকের শিশু আগামীর নয়, এখনকারই ভবিষ্যৎ বলার। এ কথার সঙ্গে শিশুর বিকাশ ও বেড়ে ওঠার বিষয়টি জড়িত।

দ্রুত নগরায়ণের কারণে জনবহুল এই দেশের শিশুরা আর প্রকৃতির কোলেপিঠে মানুষ হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। তাদের বড় হতে হচ্ছে কংক্রিট ও গ্রিলের খাঁচায় বন্দী হয়ে। দিগন্তজোড়া মাঠের পরিবর্তে তাদের চক্কর খেতে হচ্ছে চারদেয়ালের মধ্যে। ফলে এসব শিশুর প্রতি দরকার বাড়তি ‘সুষম মনোযোগের’। সুষম খাদ্যের পাশাপাশি ‘সুষম মনোযোগ’ প্রত্যয় ব্যবহারের সময় চলে এসেছে।

বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা ক্লাউস শোয়্যাবের মতো অনেকে বলে থাকেন, তথ্যপ্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফলে বর্তমানকালে এক ইউনিট সম্পদ সৃষ্টি করতে কয়েক দশক আগের তুলনায় অনেক কমসংখ্যক শ্রমিক লাগে।

কারণ, ডিজিটাল ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রান্তিক খরচ এত কম যে তা প্রায় শূন্যের কোঠার দিকে নিম্নমুখী। এখন বাজারের ধরন পরিবর্তন হয়ে কায়িক শ্রমঘনের পরিবর্তে বুদ্ধিভিত্তিক (ইন্টেলেকচুয়াল) শ্রমবাজার ও শিল্পায়ন হচ্ছে। ফলে আগামী দিনের যুবাদের হতে হবে মেধা-মননে সেরা। না হলে প্রতিযোগিতামূলক বাজারব্যবস্থায় তাঁরা পিছিয়ে যাবে।

পরিবর্তিত বাজারব্যবস্থার ব্যাপ্তি কৃষিশিল্প পণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে বৈশ্বিক মাপকাঠির শিক্ষা পর্যন্ত বিস্তৃত। বিষয়টার শিকড় এতটাই গভীরে পৌঁছেছে যে পাড়ার মুদিদোকানি থেকে শুরু করে কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকও টিকে থাকার এই লড়াইয়ের বাইরে নন। এমনকি সেসব ঠিকাশ্রমিকই তাঁদের স্তরে এগিয়ে থাকবেন, যাঁরা কায়িক শ্রমিকের সঙ্গে প্রযুক্তিগত মেধাকেও কাজে লাগাতে পারবেন। উদাহরণস্বরূপ, আজকের দিনের ডেলিভারি ম্যান বা অ্যাপসভিত্তিক বাসাবাড়ির আসবাব বদলের শ্রমিকের কথা বলা যেতে পারে।

আমাদের শিশুরা বিশ্ব মঞ্চের ওপরের স্তরে অবস্থান করবে, এটাই প্রত্যাশা। সেই প্রত্যাশা পূরণে প্রয়োজন সঠিক শিক্ষা ও যথাযথ খাদ্য ব্যবস্থাপনা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে সাংস্কৃতিক মোড়কে বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাস্তবভিত্তিক সমন্বয় ঘটাতে হবে।

অন্যদিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে, শিশুদের খাদ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়ার দিকে। খাদ্য থেকে ব্যক্তির পুষ্টি মেলে। আর পুষ্টির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ব্যক্তির মেধাশক্তির বিষয়টি। তেলের কনটেইনার ফুটো নিয়ে গাড়ি যেমন বেশি দূর এগোতে পারে না, তেমনি অসুস্থ শরীর নিয়ে গড়পড়তা ব্যক্তির পক্ষে বেশি দূর এগোনো সম্ভব নয়। তাই সঠিক স্বাস্থ্য ও মেধা গঠন না হলে, শিশু সম্পদ নয় সংকট তৈরি করবে।

২.

দেশে আজ শিশুদের খাদ্য নিয়ে অনাচার চলছে। এ অনাচার ছড়িয়ে গেছে সর্বত্র। শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ২০১৩ সালে উল্লেখযোগ্য একটি আইন জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। ওই আইনে বলা আছে, মাতৃদুগ্ধের বিকল্প শিশুখাদ্য ও বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করা শিশুর বাড়তি খাদ্যের বিজ্ঞাপন দেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

পুষ্টিবিদেরা মনে করেন, আইনটি দেশের শিশুদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। শিশুখাদ্যবিষয়ক এই আইনে ব্যক্তির পাশাপাশি দায়ী প্রতিষ্ঠানকেও শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। আইন অনুযায়ী শিশুখাদ্যের মোড়কে কোনো শিশু বা শিশুর মা বা উভয়ের বা অন্য কোনোরূপ ছবি ব্যবহার করা যাবে না।

কিন্তু টিভি চালু করলে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা পত্রিকার বিজ্ঞাপনের দিকে চোখ বোলালে আমরা এর অনেক ব্যত্যয় দেখতে পাই। শিশুর বাড়তি খাবারের রমরমা যেসব চটকদার বিজ্ঞাপন তৈরি করা হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে।

বিশেষ করে টিভি অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে চকলেট, জুস, চিপস, কোমল পানীয় ও শক্তিবর্ধক বিবিধ খাবারের যেসব বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়, তা নিয়ে জাতীয়ভাবে কথা বলা দরকার। কারণ শিশুরা অনুগতপ্রবণ সত্তা, তারা বিজ্ঞাপন দেখেই সেসব খাবারের প্রতি ঝুঁকে যায়।

তাত্ত্বিকভাবে একে বলা হয়, কনফরমেটি। অর্থাৎ এর দ্বারা এমন একটি অবস্থাকে বোঝায়, যেখানে ব্যক্তি যৌক্তিক ব্যাখ্যা ছাড়াই অন্যদের অনুসরণ করে থাকে।

আমাদের অনেক মায়েরাও এ ক্ষেত্রে এক কাঠি সরেস। এসব খাবার খাইয়ে সন্তানকে ‘নাদুস-নুদুস চেহারায়’ দ্রুত বড় করার একধরনের মনোবৃত্তি তাঁদের মধ্যে লক্ষ করা যায়। অথচ প্রান্তিক জনগণ পর্যন্ত সরবরাহ হওয়া এসব খাদ্য-পানীয়র গুণগতমান নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে।

৩.

বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০২২-এ দেখা গেছে, ৬ থেকে ২৩ মাস বয়সী দেশের প্রায় ৫০ শতাংশ শিশু কোমল পানীয়, অতিরিক্ত লবণ ও চিনিসমৃদ্ধ প্রক্রিয়াজাত খাবার খাচ্ছে। জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (নিপোর্ট) বলছে, দেশে ২৩ লাখের বেশি শিশু অস্বাস্থ্যকর খাবার খাচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) স্থূল জন্মহার, স্থূল মৃত্যুহার ও জনসংখ্যার তথ্য বিশ্লেষণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলামের ভাষ্য, বাংলাদেশে ৬ মাস থেকে ২ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ৪৭ লাখ হতে পারে। এ নিয়ে কিছুদিন আগে প্রথম আলোয় একটি প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়।

ওই প্রতিবেদনে শিশুবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লার একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরা হয়েছিল। আবিদ হোসেন মোল্লার মতে, পাঁচটি ‘চ’ আদ্যক্ষরের খাবার এখন শিশুদের প্রধান খাদ্য হয়ে উঠছে—চিপস, চানাচুর, চকলেট, চুইংগাম ও চাটনি। অথচ এ সব কটিই সুষম খাবারের পরিপন্থী। ইতিমধ্যে যাঁরা সন্তানের মা-বাবা হয়েছেন, ধারণা করছি তাঁরাও এসব খাবারের প্রতি তাঁদের সন্তানদের আগ্রহপ্রবণতার কথাই বলবেন।

এসব অস্বাস্থ্যকর খাবারে থাকা ক্ষতিকর উপাদান শিশুর স্বাভাবিক শারীরিক বৃদ্ধির অন্তরায়। ক্ষুধামান্দ্য থেকে শুরু করে, স্থূলকায়, উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি করে হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি, ডায়াবেটিসকে আমন্ত্রণ জানানোর মতো নানা রোগের বিষয়গুলো সামনে চলে আসে।

৪.

শিশুখাদ্যের এই অনাচার প্রচার সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে রাস্তার পাশে থাকা দোকানগুলোয়। এসব দোকানের সামনে রংবেরঙের চিপসের প্যাকেট থেকে শুরু করে জুস নামধারী বিভিন্ন ধরনের রঙিন পানীয়, চিনি ও রঙের আধিক্যে তৈরি ওয়েফার-জাতীয় খাবার, যাচ্ছেতাই চকলেটসহ শিশুদের জন্য আকর্ষণীয় নানা খাবার সাজিয়ে রাখা হয়।

এমনভাবে এসব সাজিয়ে রাখা হয় যে হরহামেশা চিপস, রুটি, কেক ও ওয়েফারের মোড়ক পথ-চলতি মানুষের শরীরের সঙ্গে ‘ধাক্কা’ লাগে। এতে মা-বাবার হাত ধরে রাস্তায় নামা শিশুরা, স্কুলগামী শিশু-কিশোর বয়সী শিক্ষার্থীদের চোখ সহজেই এসব খাবারের দিকে যায় এবং তাদের মন এসব পেতে আনচান করে ওঠে।

অথচ এসব খাবার উৎপাদনকারী অনেক প্রতিষ্ঠানই নামসর্বস্ব প্রকৃতির। এ ছাড়া রাস্তার পাশে ধুলা-ময়লার মধ্যে উন্মুক্তভাবে শিশুদের জন্য লোভনীয় খাবার বিক্রি করতে দেখা যায়।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিশুদের জন্য লোভনীয় খাবার কীভাবে বিক্রি হয়, তা জানতে কথা বলেছিলাম বিদেশে অবস্থানরত কয়েকজন বাংলাদেশির সঙ্গে। তাঁদের মধ্যে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির একজন পিএইচডি গবেষক, তুরস্কের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, যুক্তরাষ্ট্রের কানসাস স্টেট ইউনিভার্সিটির একজন পিএইচডি গবেষক ও ভারতের জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী রয়েছেন।

এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিষয়ে তাঁদের বক্তব্য হলো সেখানে শিশুরা সুপারশপ ধরনের বিপণিবিতান থেকে তাদের খাবার পছন্দ করে থাকে। অর্থাৎ খাবার শিশুর কাছে নয়, শিশু খাবারের কাছে যায়।

তুরস্কের পরিবেশ সম্পর্কে ওই শিক্ষকের বক্তব্য হলো, সেখানে শিশুদের যেসব খাবার পাওয়া যায়, তা ততটা অস্বাস্থ্যকর নয়। তাঁর দাবি, তুরস্কে শিশুখাদ্যে কঠোরভাবে ন্যূনতম যে মান বজায় রাখা হয়, বাংলাদেশের বিচারে তা উচ্চপর্যায়ের।

আর বিক্রির ধরন বিচারের ভারতের অবস্থা বাংলাদেশের কাছাকাছি। তবে গড়ে সেখানকার খাবারের মান বাংলাদেশের মতো যথেচ্ছ নয় বলে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর ভাষ্য। ব্যক্তিগতভাবে দুবার ভারতে যাওয়ার অভিজ্ঞতাও তাঁর এই মতকে সমর্থন করে।আসুন আমরা শিশুখাদ্যের দিকে একটু সুষম মনোযোগ দিই। ব্যবসার প্রচার-প্রসারে বিজ্ঞাপন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে প্রলোভনমূলক যাচ্ছেতাই বিজ্ঞাপন তৈরি করা বন্ধ হোক।

পাশাপাশি কঠোর নীতিমালা বাস্তবায়ন দরকার উৎপাদন থেকে শুরু করে দোকানে শিশুখাদ্য প্রদর্শনের বিষয়েও। আর এসব কাজে রাষ্ট্রকে বাধ্য করতে প্রয়োজন অংশগ্রহণমূলক সামাজিক আন্দোলন।

  • মো. ছানাউল্লাহ প্রথম আলোর সহসম্পাদক