হবু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান
হবু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান

মতামত

ট্রাম্প জমানায় যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্ক সম্পর্ক কেমন হবে

হেনরি কিসিঞ্জার তাঁর ডিপ্লোমেসি বইয়ে লিখেছেন, ‘রাষ্ট্রনায়কেরা যখন কোনো বিষয়ে সময়ক্ষেপণ করতে চান, তখন তাঁরা আলোচনার প্রস্তাব দেন।’

যেহেতু ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ফিরে আসার সুবাদে যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্ক সম্পর্ক একটি থমকে যাওয়া অবস্থায় পৌঁছেছে, সেহেতু কিসিঞ্জারের বক্তব্যের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি প্রশ্ন উঠছে। তা হলো, ট্রাম্প কি তাহলে এরদোয়ানের সঙ্গে কূটনৈতিক সংলাপ শুরুর প্রস্তাব দেবেন? যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের অংশীদারত্বমূলক কৌশলগতভিত্তিক অগ্রাধিকারের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। তবে সেই সম্পর্ক এখন নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত হচ্ছে।

ব্রিকস জোটে যোগ দেওয়াসহ বিভিন্ন মাধ্যমে তুরস্কের ভূরাজনৈতিক অবস্থান আরও শক্তিশালী হলে ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য নতুন কূটনৈতিক পথ তৈরি হতে পারে। এর ধারাবাহিকতায় বাণিজ্যে নতুন শুল্ক আরোপ, উত্তর সিরিয়ায় মার্কিন উপস্থিতি নিয়ে নতুন করে ভাবনাচিন্তা এবং ন্যাটোসহ অন্যান্য জোট নিয়ে বিতর্কের মতো বিষয়গুলো ট্রাম্পের নতুন সরকারকে একদিকে সম্ভাবনাময় করতে পারে, অন্যদিকে তা ঝুঁকিপূর্ণও করে তুলতে পারে।

প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তুরস্ক থেকে ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম আমদানির ওপর শুল্ক আরোপ করেছিলেন। এর ফলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক উত্তেজনা বেড়ে গিয়েছিল এবং ২০১৮-১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে তুরস্কের রপ্তানি প্রায় ২০ শতাংশ কমে গিয়েছিল।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এমন কিছু মন্তব্য করেছেন, যা দেখে মনে হচ্ছে আঙ্কারা আশা করছে, নতুন মার্কিন প্রশাসন তুরস্কের সঙ্গে আমেরিকার অর্থনৈতিক উত্তেজনা কমাবে।

তুরস্কের ওপর শুল্ক কমানো ট্রাম্পের নতুন পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ হতে পারে। এটি হলে তা বছরে প্রায় আড়াই হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্য সম্পর্ককে নতুন করে উদ্দীপ্ত করতে পারে। তুরস্কের পরিসংখ্যান ইনস্টিটিউটের তথ্য বলছে, তুরস্কের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি বাজার হলো (জার্মানির পরেই) যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্র যদি শুল্ক কমায়, তাহলে তুরস্কের বস্ত্র, যন্ত্রপাতি ও গাড়ির যন্ত্রাংশের মতো প্রধান প্রধান শিল্পের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে যুক্তরাষ্ট্রে তুরস্কের রপ্তানি বছরে প্রায় ১০ শতাংশ বাড়তে পারে।

শুল্ক কমানো ট্রাম্পের একটি পদক্ষেপ হতে পারে, যা তাঁর ‘আগে আমেরিকা’ নীতির দিকে ফিরে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়। এটি এমন একটি বোঝাপড়ার ওপর গুরুত্বারোপ করে, যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সাহায্য করবে। একই সঙ্গে তা ন্যাটোর একটি সদস্যরাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনাকে প্রশমিত করবে।

উত্তর সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র কুর্দি মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোকে যে সমর্থন দিয়ে আসছে, তা দীর্ঘদিন ধরে তুরস্ককে দুশ্চিন্তায় রেখেছে। এটি যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্ক সম্পর্ককে অস্থির করেছে। কারণ, আঙ্কারা কুর্দি পিপলস প্রটেকশন ইউনিটসকে (ওয়াইপিজি) অনেকটা পিকেকে ঘরানার সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে দেখে থাকে।

 ২০১৯ সালে ট্রাম্প উত্তর সিরিয়া থেকে সাময়িকভাবে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেই ঘোষণা তুরস্ককে উত্তর সিরিয়ায় একটি ‘সুরক্ষিত অঞ্চল’ গড়ে তোলার সুযোগ দিয়েছিল। এখন ট্রাম্প ফিরে আসায় সেখান থেকে আরও এক দফা মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সম্ভাবনা রয়েছে। এটি করা হলে তা তুরস্কের নিরাপত্তা স্বার্থের সহায়ক হতে পারে। এটি দুই দেশের সম্পর্ককে জোরালো করতে পারে।

উত্তর সিরিয়ায় প্রায় ৯০০ মার্কিন সেনা আছে। সেখানকার স্থিতিশীলতার জন্য, বিশেষ করে দায়েশ (আইএস) মোকাবিলায় তাদের উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ। তা সত্ত্বেও ট্রাম্প সেখান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করে তথা সেখানে মার্কিন প্রভাব কমিয়ে তুরস্ককে সীমান্তের ওপর আগের চেয়ে বেশি নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার সুযোগ করে দিতে পারে। তবে এটি যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্কের উত্তেজনা কমাতে সাহায্য করলেও মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি বদলে দেবে। এর ফলে কুর্দিদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মৈত্রীর সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে। আরেকটি বিষয় হলো, ন্যাটোতে তুরস্কের সদস্যপদ দেশটির প্রতিরক্ষাব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পশ্চিমাদের সঙ্গে তুরস্কের সংযোগ রক্ষার অপরিহার্য মাধ্যম।

তবে তুরস্ক রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কেনার পর ন্যাটোর সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক জটিল হয়ে পড়েছে। এর জের ধরে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান প্রকল্প থেকে তুরস্ককে বাদ দিয়েছে। ট্রাম্পের পূর্ববর্তী নীতি এই সমস্যা সমাধানে সব ধরনের দিক পরীক্ষা করেছিল। নতুন মেয়াদে তুরস্কের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা কূটনৈতিক সমস্যা সমাধানের একটি সুযোগ হতে পারে। তার অংশ হিসেবে কিছু শর্ত সাপেক্ষে তুরস্ককে এফ-৩৫ প্রকল্পে ফেরত নেওয়ার বিষয়টি ট্রাম্প প্রশাসন বিবেচনা করতে পারে।

যেহেতু তুরস্ক এই অঞ্চলে আধিপত্য বজায় রেখেছে, সেহেতু ন্যাটোর দক্ষিণ সীমান্তকে শক্তিশালী করতে এবং ভাগাভাগি করা নিরাপত্তাঝুঁকি মোকাবিলা করতে তুরস্কের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের একটি উন্নত প্রতিরক্ষা চুক্তি সাহায্য করতে পারে। সেই দিক বিবেচনায় নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিতে পারে।

  • ড. এলিফ সেলিন চালিক একজন লন্ডনভিত্তিক বিজ্ঞানী ও টেকসই উন্নয়নবিশেষজ্ঞ

    মিডল ইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত