মতামত

অর্থনীতির অন্তর্বর্তী সাফল্যকে স্থায়ী করা যায় কীভাবে

গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর অর্থনীতির রক্তক্ষরণ বেশ কমেছে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় একরোখা মনোভাবেরও পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয়। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় এসেছেন কয়েকজন পণ্ডিত প্রায়োগিক অর্থনীতিবিদ। তাঁদের ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত পক্ষপাতিত্ব আছে বলে জানা যায়নি। 

আর্থিক খাতের প্রবল সংকট আর সমালোচনার মধ্যেই গণ-অভ্যুত্থানে ধসে পড়ে বিগত সরকার। স্বাভাবিকভাবেই অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিনের মেয়াদে এসে অনেকেরই প্রশ্ন, কোথায় দাঁড়িয়ে অর্থনীতি? 

বিগত সরকারের আমলে বড় বড় দুর্নীতি হয় আর্থিক তথা ব্যাংক খাতে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আর্থিক খাত অন্তত পতনোন্মুখ অবস্থা থেকে উঠে এসেছে। অস্থির ডলার বাজারে ফিরেছে কিছুটা স্বস্তি। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে গতি এসেছে। শিল্পাঞ্চলে কিছু অসন্তোষ সত্ত্বেও রপ্তানি এখন ইতিবাচক ধারায়। তবে ভোগ্যপণ্যের বাজারের অস্বস্তি কাটেনি। বাজারের পাশাপাশি কর্মসংস্থান নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে।

উদ্যোক্তারা এখনো নতুন বিনিয়োগে তেমন এগিয়ে আসছেন না। তাঁরা ব্যবসায়িক পরিবেশের আরও উন্নতি চান। অন্যদিকে সরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডেও রয়েছে একধরনের স্থবিরতা। 

অনেক ব্যবসায়ী ও নীতি বিশ্লেষক মূল্যস্ফীতি কমাতে সুদহার বাড়ানোর নীতিকে সমর্থন করছেন না। এই নীতিতে মূল্যস্ফীতি কমছে না, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কর্মসংস্থানের গতি ধীর হয়ে গেছে, নতুন করে বেকারত্ব বাড়ছে। উদ্যোক্তারা বিনিয়োগের জন্যও ভুগছেন সিদ্ধান্তহীনতায়। 

ব্যাংক খাতে ভঙ্গুরতার প্রকৃত চিত্র আড়াল করেছে গত সরকার, কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বিশেষ করে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যাংকগুলোয় নজিরবিহীন অনিয়ম হয়ে একপর্যায়ে তারল্য–সংকটে পড়ে। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে চলতি হিসাবে ঘাটতি রেখে লেনদেনের সুযোগ দিয়ে সংকট ধামাচাপা রাখার চেষ্টা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এরই মধ্যে এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা ৭টিসহ ১১টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে পুনর্গঠন করে দিয়েছে। আর্থিক খাতের প্রকৃত অবস্থা উদ্‌ঘাটন ও ব্যাংক খাত সংস্কারে তিনটি টাস্কফোর্স গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। 

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রধান অগ্রাধিকার বিবেচনায় বাজারে মুদ্রা সরবরাহ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নতুন করে সরকারকে ঋণ না দিয়ে উল্টো আগের দেনা পরিশোধ করা হচ্ছে। অন্যদিকে ডলার-সংকটের দোহাই দিয়ে পণ্যের দর বাড়ানো রুখতে কেউ ডলার না পেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতেও বলা হয়েছে। অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রেমিট্যান্স ৩০ শতাংশ বাড়ায় ডলারের সংকট কমেছে।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম কিছুদিন শ্রমিক আন্দোলন ঘিরে অস্থিরতা রপ্তানির ক্ষেত্রে সংকট তৈরি করেছিল। এখন রপ্তানি পরিস্থিতিরও উন্নতি হয়েছে। অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রপ্তানি বেড়েছে ১১ শতাংশ। গত অর্থবছরে রপ্তানি ৫ শতাংশ কমে যায়। বিনিময় হার বাজারমুখী করার সিদ্ধান্ত রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বাড়ার মূল কারণ হতে পারে।

ঋণ পরিশোধের বড় চাপ আছে। তবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত কমে যাওয়ার প্রবণতা রোধ করা গেছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের মতো উন্নয়ন সহযোগীদের থেকে পাওয়া গেছে কম সুদে ঋণ পাওয়ার বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি। ফলে ডলার বাজার ও রিজার্ভ আরও স্থিতিশীল হওয়ার আশা করছে সরকার।

নতুন করে অর্থ পাচার কমেছে। অর্থ পাচারকারীকে চিহ্নিত করতে এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি দেশে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। অর্থ ফেরত আনতে কমিশনের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক আইনি সহায়তা প্রতিষ্ঠান নিয়োগের বিষয়টিও আলোচনায় রয়েছে। 

সরকার দ্রব্যমূল্য কমাতে ইতিমধ্যে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এনবিআর বিভিন্ন নিত্যপণ্যের শুল্ক কমিয়েছে। দামের লাগাম টানতে বাজার তদারকি, ডিলার ও মিলের মালিকদের পণ্য সরবরাহে উৎসাহিত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পণ্যের অবৈধ মজুত ঠেকাতে নজরদারি এবং কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য সরবরাহ বাড়াতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার কথাও হচ্ছে। আমদানি পর্যায়ে নিত্যপণ্যের শুল্ক কমানো হলেও বাজার বিশৃঙ্খলা ও গোষ্ঠীস্বার্থের কারণে পণ্যের দাম কমছে না। স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনযাত্রা আরও কঠিন হয়ে উঠেছে।

মূল্যস্ফীতি কমাতে ও অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরাতে খরচ কমানোর নীতি নিয়েছে সরকার। অপচয় ও অপ্রয়োজনীয় সরকারি ব্যয় রোধে নেওয়া হয়েছে পদক্ষেপ। গত আগস্টে খাদ্য খাতে ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল। সেপ্টেম্বরে তা ছিল ১০ দশমিক ৪০ আর অক্টোবরে তা আবার বেড়ে হয়েছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ।

নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে পোশাক খাতে যে শ্রম-অসন্তোষ ছিল, তা নিরসনে সরকারের মোটামুটি দায়িত্বশীল ভূমিকা ছিল। সাভারের আশুলিয়া এবং গাজীপুরের বেশ কয়েকটি কারখানায় হামলা-ভাঙচুর করা হয়। দুই মাসের মতো অর্ধশতাধিক কারখানা বন্ধ থাকে। মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের মধ্যে ১৮ দফার একটি যৌথ ইশতেহারের ঘোষণায় অস্থিরতা বেশ প্রশমিত হয়। আগামী দিনেও রপ্তানিতে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রাখতে শ্রম-অসন্তোষ প্রশমিত রাখতে হবে। 

চলতি অর্থবছরের বাজেট ব্যয়ের পরিকল্পনায় বড় অঙ্কের কাটছাঁট করবে সরকার। প্রাক্কলিত ব্যয় এক লাখ কোটি টাকার মতো কমতে পারে। তবে পরিচালন বাজেট ছাঁটাইয়ের সুযোগ কম। তাই বেশির ভাগ কাটছাঁট বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি থেকে হবে। কিছু প্রকল্পের বরাদ্দ কমানো হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের একনেকের প্রথম বৈঠকেই এডিপিভুক্ত সব উন্নয়ন প্রকল্প যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এদিকে এ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রথম প্রান্তিকে এডিপি বাস্তবায়নের হার গত অর্থবছরের একই সময়ের প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।

ছাত্র-জনতার সফল অভ্যুত্থানে শেয়ারবাজারে চাঙাভাব দেখা গিয়েছিল। মাত্র চার দিনের উত্থানে শেয়ারবাজারে সূচক বেড়েছিল ৭৮৬ পয়েন্ট। তবে মাঝখানে উল্টো হাওয়ায় টানা প্রায় আড়াই মাসের দরপতনে বিনিয়োগকারীদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। পরিস্থিতি সামলাতে সরকার এগিয়ে আসায় সাময়িক হলেও পতনের ধারা থেকে বেরিয়ে এসেছে শেয়ারবাজার।

বিগত সরকারের সময় শেয়ার কারসাজি নিয়ে তদন্ত শুরু হলে জড়িত ব্যক্তিরা শেয়ার কেনাবেচায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। এ কারণে হঠাৎ ক্রেতা চাহিদা কমে যায়। কিছু ক্ষেত্রে তাঁদের শেয়ার বিক্রি বাজারে দরপতনকে উসকে দেয়। সরকার শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির শীর্ষ নেতৃত্বে বদল আনে। পুনর্গঠিত শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে শুরুতে বাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হলে দরপতন মাত্রা ছাড়ায়। 

পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার দ্রুত শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে মূলধনি মুনাফায় করহার সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করে। আইসিবির বিনিয়োগসক্ষমতা বাড়াতে তিন হাজার কোটি টাকার ঋণ গ্যারান্টি দেওয়ার ঘোষণা করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে সাময়িক দরপতন বন্ধ হয়েছে।

নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে পোশাক খাতে যে শ্রম-অসন্তোষ ছিল, তা নিরসনে সরকারের মোটামুটি দায়িত্বশীল ভূমিকা ছিল। সাভারের আশুলিয়া এবং গাজীপুরের বেশ কয়েকটি কারখানায় হামলা-ভাঙচুর করা হয়। দুই মাসের মতো অর্ধশতাধিক কারখানা বন্ধ থাকে। মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের মধ্যে ১৮ দফার একটি যৌথ ইশতেহারের ঘোষণায় অস্থিরতা বেশ প্রশমিত হয়। আগামী দিনেও রপ্তানিতে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রাখতে শ্রম-অসন্তোষ প্রশমিত রাখতে হবে। 

এখন অন্যতম প্রশ্ন হলো আমরা কীভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তার স্বকীয়তায় কাজের বর্ধিত সুযোগ করে দেব। কীভাবে নতুন করে মন্দ ঋণ কমে ব্যাংকিং খাতে নতুন ঋণের জন্য তারল্য সৃষ্টি হবে। প্রাধিকার খাতে আরও অর্থপ্রবাহ বাড়বে। কীভাবে অপর সমপর্যায়ের দেশের আলোকে বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা ও রপ্তানি প্রতিযোগিতা ধরে রাখব। প্রাধিকার ধর্তব্য হচ্ছে শ্রমিকের ও মানবসম্পদের দক্ষতা এবং সক্ষমতা বৃদ্ধি আর সর্বোপরি দক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করে যথাযথ নির্বাচন করে ক্ষমতার পালাবদলের মাধ্যমে একটি সাবলীল, অভিনব ও সম্মানজনক উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখা। আর এসবের মূলমন্ত্র হবে ‘বিনিয়োগ-কর্মসংস্থান-দারিদ্র্য বিমোচন’। 

মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক