গদ্যকার্টুন

আইনস্টাইন এসে কি বৃত্তির ফল পাল্টালেন

আমাদের প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, ইভিএমের ফল পাল্টাতে পারবেন না স্বয়ং আইনস্টাইন এসেও।

এদিকে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করার পর স্থগিত করতে হয়েছে। কারণ, যে পরীক্ষা দেয়নি, সেও বৃত্তি পেয়ে বসে আছে। কোডিং করতে গিয়ে ভুল হয়ে গেছে! সামান্য ভুল।

আইনস্টাইন দুটো ঘটনাতেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে! তিনি বলেছেন, এসব কী হচ্ছে?

আইনস্টাইন নাকি তাঁর শৈশবে কোনো কথা বলতেন না। তিন-চার বছর বয়সে তিনি প্রথম কথা বলেন। খাবারের টেবিলে তিনি হঠাৎ বলে ওঠেন, সুপ বেশি গরম।
তখন আইনস্টাইনকে বলা হয়, তুমি যদি কথা বলতেই জানতে, তাহলে এত দিন বলোনি কেন?

বালক আইনস্টাইন জবাব দিয়েছিলেন, এত দিন সুপ ঠিকঠাক ছিল। তা-ই কথা বলার প্রয়োজন হয়নি।

বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে এত দিন কেন আইনস্টাইন কথা বলে উঠলেন না, তাঁকে জিগ্যেস করা হলে তিনি বলেন, ‘এত দিন তো কোনো গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশি আমাকে তাঁদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের মধ্যে টেনে নামাননি! তাই কথা বলার প্রয়োজন আমি বোধ করিনি।’
‘এখন কী হলো?’ আইনস্টাইনকে প্রশ্ন করা হয়!
আইনস্টাইন বলেন, ‘যখন বলা হলো, আমি নাকি ইভিএমের ফল পাল্টাতে পারব না, তখনই আমার রাগ হলো।’
‘কেন? রাগ হলো কেন? আপনি কি ইভিএমের ফল বদলে দিতে পারবেন?’
আইনস্টাইন বললেন, ‘শোনেন। একটা কৌতুক বলি। বলপেন কিংবা ফাউন্টেনপেন কাজ করে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির জোরে। কলমের নিব নিচের দিকে ধরে কাগজে লিখতে হয়। মাধ্যাকর্ষণ কালিকে নিচে টানে। তখন লেখা হয়। মহাশূন্যে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি নেই। সে জন্য নভোযানে ফাউন্টেন পেন বা বলপেন কাজ করবে না। এই সমস্যা সমাধানে আমেরিকানরা এক বিলিয়ন ডলার খরচ করে একটা কলম উদ্ভাবন করে। আর রাশানরা দুই টাকা দিয়ে একটা পেনসিল কিনে নিয়ে যায়।’

‘এটা দিয়ে আপনি কী বোঝাচ্ছেন?’
‘আমি বোঝাচ্ছি যে টাকা খরচ করে এমন ইভিএম মেশিন কেন বানাতে হবে, যাতে ইচ্ছেমতো ফল পাওয়া যায়। ইচ্ছেমতো ফল তৈরি করে সেটা ঘোষণা করে দিলেই তো হয়। এ জন্য তো ইভিএম মেশিন নিয়ে গবেষণা করে টাকা খরচ করতে হয় না।’
‘তো আপনিও ইভিএমের ফল বদলাতে পারবেন না, এই কথা শুনে আপনার রাগ হলো। তা সত্ত্বেও আপনি চুপ করে থাকলেন!’
‘জি, থাকলাম। রাগ হলে আমি বেহালা বাজাই। বেহালা বাজাতে থাকলাম। রাগ কিছুটা কমে এসেছিল।’
‘তাহলে আজকে হঠাৎ আবার কথা বলে উঠলেন কেন?’
‘কারণ, প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার ফল নিয়ে সেই বাংলাদেশেই একটা যাচ্ছেতাই কাণ্ড করা হয়েছে। আপনি চিন্তা করে দেখুন, একটা বাচ্চা ছেলে বৃত্তি পেয়েছে বলে আনন্দে লাফাচ্ছে, তার মা-বাবা মিষ্টি কিনে ঘরে ঘরে পাঠাচ্ছে, তখন শোনা গেল ফল স্থগিত। তারপর যখন নতুন ফল বের হলো, দেখা গেল, সেই বাচ্চা বৃত্তি পাবে না। এই বাচ্চার মনের ওপরে কী প্রতিক্রিয়া হবে। আর তার মা-বাবাইবা মুখ দেখাবেন কী করে?’
‘জি। মহামতি আইনস্টাইন, আপনার এই উদ্বেগ যথার্থ। সে ক্ষেত্রে আপনার বক্তব্য কী? বাংলাদেশের এখন কী করা উচিত?’

‘এটাও সহজ। আমেরিকানদের মতো বিলিয়ন ডলারের গবেষণা না করে ইভিএম এক্সপার্টকে বৃত্তি পরীক্ষার ফল নির্ধারণ ও প্রকাশের দায়িত্ব দেওয়া হোক। আর প্রাথমিকের ফল প্রকাশের দায়িত্বে থাকা কম্পিউটারবিদকে ইভিএমের দায়িত্ব দেওয়া হোক। তাহলে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার ফল আর কোনো দিনও পাল্টাবে না। আর নির্বাচনের ফলও স্থগিত রেখে পুনঃপ্রকাশ করা যাবে।’
‘নির্বাচন কমিশন কি প্রকাশিত ফল স্থগিত করতে চাইছে?’
‘এটা আপনাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। আমি এ নিয়ে কথা বলব না। তবে নিচের খবরটা তো আপনারাই প্রকাশ করেছেন:
নির্বাচনের ফলাফলের প্রজ্ঞাপন (গেজেট) হওয়ার পরও প্রয়োজনে নির্বাচন বাতিল করার ক্ষমতা চায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ জন্য জাতীয় নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) সংশোধনী আনার যে প্রস্তাব ইসি দিয়েছিল, তার সঙ্গে একমত পোষণ করেছে আইন মন্ত্রণালয়। এটি জাতীয় সংসদে পাস হলে কোনো নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পরও অনিয়ম প্রমাণিত হলে ইসি ওই নির্বাচন বাতিল করতে পারবে।’

‘এটা তো ভালো। অনিয়ম হওয়া ফল যদি ইসি বাতিল করে, সেটা তো সুনিয়মকেই প্রতিষ্ঠিত করবে।’
‘ভালোমন্দের কথা হচ্ছে না। কথা হচ্ছে, আমি আইনস্টাইন ইভিএমের ফল পাল্টাতে পারব কি পারব না।’
‘আপনি বলতে চাচ্ছেন আপনি পারবেন?’
‘আমি কি তা বলেছি? আপনি আপনার কথা আমার মুখে বসাচ্ছেন কেন? শোনেন, আমার খুবই বিখ্যাত একটা উক্তি আছে। প্রত্যেকেই জিনিয়াস। এখন আপনি যদি একটা মাছের প্রতিভা বিচার করেন, সে গাছে উঠতে পারে কি পারে না, তা দিয়ে, তাহলে মাছটা নিজেকে ভাববে একটা আহাম্মক।’
‘এর দ্বারা কী বোঝাতে চাচ্ছেন?’
‘আমি কেন ইভিএমের ফল পাল্টাতে আসব? আমি কি কম্পিউটারবিদ নাকি, আমি ক্ষমতালোভী ভোটপ্রার্থী। ইভিএমের রেজাল্ট পাল্টানো দিয়ে আমার প্রতিভা বিচার করা হলে আমি অবশ্যই নিজেকে ভাবব একজন ইডিয়ট।’

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক