মঁতেনিয়ার বিড়াল এবং আমাদের মুঠোফোন

১৫৩৩ সালে জন্ম নেওয়া মিশেল দু মঁতেনিয়া ছিলেন ফরাসি রেনেসাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দার্শনিক। তাঁর চিন্তার বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে তিনি একটি বিষয়কে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করতেন।

যেমন একদিন নিজের বিড়ালের সঙ্গে খেলতে খেলতে তাঁর হঠাৎ মনে হলো যে আসলে ঘটনাটা কী? বিড়ালটাকে নিয়ে কি আমি খেলছি নাকি আসলে বিড়ালটাই আমাকে নিয়ে খেলছে? আপনিও হয়তো মঁতেনিয়ার মতো এ রকম চিন্তা করেছেন। আপনার হয়তো মঁতেনিয়ার মতো বিড়াল নেই, কিন্তু মুঠোফোন-ল্যাপটপ তো আছে।

তা ছাড়া আপনি নিশ্চয়ই রাস্তাঘাট, পার্ক-রেস্তোরাঁ, অফিস-আদালত, নারী-পুরুষকে মুঠোফোনে তাঁদের চোখ আঠার মতো লাগিয়ে রাখতে দেখেছেন। ফলে মঁতেনিয়ার মতো আপনার মনেও এমন প্রশ্নের উদয় হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে ওই সব মানুষ কি আসলে মুঠোফোন চালাচ্ছেন, নাকি মুঠোফোনই তাঁদের চোখগুলো সম্মোহিত করে স্ক্রিনে আটকে রেখেছে?

তবে আপনার মনে যদি এ ধরনের প্রশ্ন এসে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে যে আপনি এমন সংখ্যালঘু লোকেদের দলে আছেন, যাঁরা মঁতেনিয়ার মতো ভিন্নভাবে চিন্তা করতে পারেন।

আপনার মনে এই প্রশ্ন এলে আপনি নিশ্চয়ই এটাও বুঝেছেন যে মঁতেনিয়ার বিড়াল আর আপনার হাতের মুঠোফোন বা কোলের ল্যাপটপ ঠিক এক নয়। মঁতেনিয়ার বিড়াল তাঁকে নিয়ে খেলত কেবল। কিন্তু আপনার মুঠোফোন আপনাকে নিয়ে কেবল খেলে না। সেটা আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। তার চেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, আপনার ওপর তার এই নিয়ন্ত্রণ এখন প্রায় অপ্রতিরোধ্য।

এই নিয়ন্ত্রণ যে হারে বাড়ছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে মা যেমন তার সন্তানের মনের আবেগ বুঝতে পারেন কিংবা তা বাড়াতে-কমাতে জানেন, অদূর ভবিষ্যতে একটি মুঠোফোন বা কম্পিউটার মানুষের আবেগকে তার চেয়ে ভালো বুঝবে বা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করবে। সে ক্ষেত্রে সে অনায়াস আমার কাছে যেকোনো জিনিস বিক্রি করে দিতে পারবে। সেটা একটা গাড়ি হোক কিংবা একটা বাড়ি অথবা গোটা কোনো মতাদর্শ।

শুধু তা–ই নয়, আমার মনের গভীরে যে ভয়, ঘৃণা বা আকাঙ্ক্ষা লুকিয়ে আছে, তা–ও সে বুঝে ফেলবে। এতে আমার লাভও হতে পারে, আবার ক্ষতিও হতে পারে। কী হবে, তা নির্ভর করবে আমি কত সচেতনভাবে তাকে ব্যবহার করতে পারছি, তার ওপর। আশঙ্কার কথা হচ্ছে, যন্ত্রের ‘বুদ্ধি’র সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমার ‘সচেতনতা’ কিন্তু বাড়ছে না বরং কমছে।

একদিকে আমরা মুঠোফোনে বা ল্যাপটপে ব্যবহৃত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ‘বুদ্ধি’ বাড়াচ্ছি আর অন্যদিকে ক্রমহ্রাসমান ‘সচেতনতা’র বিষয়টি উপেক্ষা করছি বলে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এই মানবিক ক্ষমতা আমরা নিজেদের অজান্তেই হারিয়ে ফেলছি। এই সুযোগে ইতিমধ্যে উন্নত বিশ্বের বেশ কয়েকটা নির্বাচনে ভোটারদের মেজাজমর্জি বুঝে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তাদের মনকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছে। ব্যবসা–বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও তা–ই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ক্রেতাদের চাহিদা নিরূপণ করে পণ্য তৈরি করা কিংবা তৈরি পণ্য বিক্রি করার জন্য ক্রেতাদের নানাভাবে প্ররোচিত করার বিষয়টি তো আমরা সবাই জানি।

তার পূর্বগরু যেমন চটপটে বা কৌতূহলী ছিল, সে আর তা নেই। গরুর দুধ দেওয়ার মতো আমিও কিন্তু মুঠোফোন বা কম্পিউটারের মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে প্রতিদিন প্রচুর তথ্য-উপাত্ত দিয়ে যাচ্ছি এবং অন্যদিকে আমি ক্রমাগত আমার মানবীয় ক্ষমতা হারাচ্ছি। যন্ত্রের ক্ষমতা বাড়াতে বাড়াতে আমি যদি এভাবে নিজের ক্ষমতা কমাই, তাহলে মঁতেনিয়ার বিড়ালের চেয়ে অনেক বেশি স্মার্ট আমার মুঠোফোন যে আমাকে নিয়ে খেলবে, তা বলাই বাহুল্য।

আমি যদি আরও অনেক বেশি সচেতন হতে পারতাম, তাহলে যন্ত্রের কাছে আমার পরাজয়ের সম্ভাবনাটা অনেক কমে যেত। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো, ‘বুদ্ধি’ আর ‘সচেতনতা’ কিন্তু এক নয়।

যত ভালো অ্যালগরিদম দিয়ে আমি যত বেশি তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করতে পারব, আমি তত বুদ্ধিমান এবং এ ক্ষেত্রে যন্ত্রের সঙ্গে মানুষের পেরে ওঠা কঠিন। অন্যদিকে, ‘সচেতনতা’র জন্য যেহেতু ব্যথা, আনন্দ, প্রেম, ক্রোধ ইত্যাদি অনুভব করতে হয়, যন্ত্রের পক্ষেও সচেতন হওয়া ঠিক তেমনই কঠিন। এটাই যন্ত্রের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা, অ্যাকিলিসের গোড়ালি। মানুষ যেভাবে যন্ত্রের ‘বুদ্ধি’ বাড়ানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে, ঠিক সেভাবে যদি সে নিজেকেও ক্রমাগত আরও ‘সচেতন’ করে তুলত, তাহলে যন্ত্র আর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে তাকে এভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত না।

এখন যদি আমরা এই সচেতনতা বৃদ্ধির দিকে নজর না দিই, তাহলে কালক্রমে যন্ত্রের গৃহপালিত জন্তুতে পরিণত হওয়া ছাড়া আমাদের আর উপায় থাকবে না। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, গৃহপালিত জন্তুরা কিন্তু আমাদের উপকার করতে গিয়ে নিজেরা নির্বোধ, নিশ্চল ও নিবীর্য প্রাণীতে পরিণত হয়। গরু আমাদের প্রচুর দুধ দেয় ঠিকই, কিন্তু আপনি যদি তাকে তার পূর্বগরুর সঙ্গে তুলনা করেন, তাহলে দেখবেন, গরু হিসেবে তার প্রচুর অবনতি হয়েছে।

তার পূর্বগরু যেমন চটপটে বা কৌতূহলী ছিল, সে আর তা নেই। গরুর দুধ দেওয়ার মতো আমিও কিন্তু মুঠোফোন বা কম্পিউটারের মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে প্রতিদিন প্রচুর তথ্য-উপাত্ত দিয়ে যাচ্ছি এবং অন্যদিকে আমি ক্রমাগত আমার মানবীয় ক্ষমতা হারাচ্ছি। যন্ত্রের ক্ষমতা বাড়াতে বাড়াতে আমি যদি এভাবে নিজের ক্ষমতা কমাই, তাহলে মঁতেনিয়ার বিড়ালের চেয়ে অনেক বেশি স্মার্ট আমার মুঠোফোন যে আমাকে নিয়ে খেলবে, তা বলাই বাহুল্য।

মঁতেনিয়া নিশ্চয়ই মুঠোফোনের কথা কল্পনাও করতে পারেননি। কিন্তু তিনি সচেতনতার অভাবের বিপদটা বুঝেছিলেন। এ জন্যই তিনি বলতেন, ‘আমি যেকোনো বিষয়ের চেয়ে নিজেকে বেশি অধ্যয়ন করি।

এটাই আমার অধিবিদ্যা, এটাই আমার পদার্থবিজ্ঞান।’ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের টানাপোড়েনের ক্ষেত্রে তাঁর আরেকটা কথা মনে রাখলে মনে হয় ভালো হবে। সেটা হচ্ছে একজন জ্ঞানী ব্যক্তি কখনো কিছু হারায় না, যদি সে নিজেকে নিজের কাছে রাখতে পারে।

মঁতেনিয়া এ কারণেই বহু আগে বলে গিয়েছিলেন, শিক্ষার্থীদের সৃষ্টিশীল করতে হবে এবং তাদের সূক্ষ্ম চিন্তনের দক্ষতা বাড়াতে হবে। কিন্তু সেটা প্রথাগত শিখন-শেখানো পদ্ধতিতে অর্জন করা যাবে না।

তার জন্য চাই আমাদের নতুন শিক্ষাক্রমে যাকে প্রকল্পভিত্তিক অভিজ্ঞতাজাত শিখনপদ্ধতি বলা হচ্ছে, সে রকম পদ্ধতি। অর্থাৎ কেবল বই মুখস্থ বা শিক্ষককে অনুকরণ করে নয়, শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করে করে নিজেদের চেষ্টায় চিন্তা করতে করতে কাজের মাধ্যমে তাদের উত্তর খুঁজে বেড়াবে।

অন্য বিষয় যেমন শিখবে, তেমনি নিজেকেও নিত্যনতুনভাবে আবিষ্কার করতে থাকবে। আশা করি এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়িত হবে এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যন্ত্রের খেলার পুতুল না হয়ে বরং যন্ত্রকেই তাদের ক্রীড়নকে পরিণত করবে।

  • সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক মাউশি ও নায়েমের সাবেক মহাপরিচালক