এমানুয়েল মাখোঁ ২০১৬ সালে ফ্রান্সের রাজনৈতিক ময়দানে পা রাখার সিদ্ধান্ত নেন এবং ওই বছরই তিনি ‘এন মার্শে’ (পরিবর্তনের পথে) নামের একটি নতুন মধ্য উদারতাবাদী দল চালু করার মাধ্যমে রাজনীতিতে আসেন।
তার আট বছর পর এসে এখন দেখা যাচ্ছে, চরম ডানপন্থী নেত্রী মারিঁ লো পেন জনপ্রিয়তায় প্রেসিডেন্ট মাখোঁকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন এবং ক্ষমতার খুব কাছাকাছি এগিয়ে এসেছেন।
৬ থেকে ৯ জুন অনুষ্ঠিত ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে লো পেনের দল ন্যাশনাল র্যালি ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে। আর মাখোঁর দল ‘রেনেসাঁ’ (এন মার্শে নামটি বদলে পরে দলটির নাম ‘রেনেসাঁ’ রাখা হয়েছে) পেয়েছে ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট।
অর্থাৎ মাখোঁর দলের দ্বিগুণের বেশি ভোট পেয়েছে লো পেনের দল।
এর মধ্য দিয়ে ধারণা করা হচ্ছে যে ইইউ নির্বাচনে নিজের দলের পরাজয়ের প্রতিক্রিয়ায় মাখোঁর ডাকা আসন্ন আগাম পার্লামেন্ট নির্বাচনে লো পেনের ন্যাশনাল র্যালি বিপুল ভোটে জয়লাভ করবে।
অর্থাৎ, ফ্রান্সের জনগণ এমন একটি কট্টর ডানপন্থী রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় আনতে যাচ্ছে, যে দল অনেক আগে থেকেই ফ্রান্সে অভিবাসীদের (মূলত মুসলমান) ঢোকা বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে।
তার মানে, লো পেনের ন্যাশনাল র্যালির ক্ষমতায় আসার মধ্য দিয়ে দেশটির মুসলমানদের অধিকার ও স্বাধীনতাকে পিষে ফেলার আয়োজন হতে যাচ্ছে।
উদারপন্থী পণ্ডিতেরা ইতিমধ্যে মাখোঁর আগাম নির্বাচন দেওয়ার ঘোষণাকে একটি জুয়া হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
তাঁরা ২০১৬ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোট করার ও আগাম নির্বাচন দেওয়ার সিদ্ধান্তের সঙ্গে মাখোঁর আগাম নির্বাচন দেওয়াকে তুলনা করেছেন।
ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনের পর থেকে ফ্রান্সের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ইউরোপের সংবাদ শিরোনামগুলোয় প্রাধান্য পেয়ে আসছে এবং এই মহাদেশে চরম ডানপন্থীদের পুনরুত্থানের আশঙ্কা ঘনীভূত হয়েছে।
তবে বৃহত্তর চিত্রের দিকে তাকালে ব্রাসেলসে ইইউর নতুন পার্লামেন্টের গঠন (যেখানে এখনো মধ্যপন্থীরা তাঁদের প্রভাব ধরে রেখেছেন) উদারপন্থীদের অন্তত আপাতত ধড়ফড় করা মনকে শান্ত করতে সাহায্য করতে পারে।
মধ্য ডানপন্থী ইউরোপিয়ান পিপলস পার্টি (ইপিপি) ও দ্য প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স অব সোশ্যালিস্ট অ্যান্ড ডেমোক্র্যাট এবং উদারপন্থী রিনিউ অ্যান্ড গ্রিনস—মূলধারার শক্তি হিসেবে পরিচিত এসব দল চলতি মাসের ইইউ পার্লামেন্ট নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে।
সোজা কথায়, ইপিপিকে ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনিসহ (যাঁর ডেপুটিরা ইউরোপিয়ান কনজারভেটিভস অ্যান্ড রিফরমিস্টস [ইসিআর] গ্রুপিংয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় ককাস গঠন করে) অতি ডানপন্থীদের কাছে আপাতত সমর্থন চাইতে হচ্ছে না।
এর মানে হলো, অন্তত আগামী পাঁচ বছর ইউরোপের রাজনীতি আগের মতোই মূলধারার দলগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ইপিপির উরসুলা ভন ডার লিয়েন দ্বিতীয় মেয়াদে ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রধান হিসেবে থাকবেন।
ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট হতে পারেন পর্তুগালের সমাজতান্ত্রিক সাবেক প্রধানমন্ত্রী আন্তোনিও কস্তা।
এরপরও চরম ডানপন্থীদের পুনরুত্থান নিয়ে উদ্বেগ রয়ে গেছে। কারণ, কেবল ফ্রান্স নয়, জার্মানিতেও চরম ডানপন্থীরা মাথাচাড়া দিচ্ছেন।
সাম্প্রতিক ইউরোপীয় নির্বাচনে জার্মানিতে চরম ডানপন্থী দল অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি (এডিএফ) ১৬ শতাংশ ভোট পেয়ে দেশটির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজের দল সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে।
অভিবাসীবিরোধী এডিএফ সাবেক পূর্ব জার্মানিতে ও তরুণ ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে। দলটি এতটাই উগ্র ও প্রতিক্রিয়াশীল যে লো পেনের ন্যাশনাল র্যালির মতো চরম ডানপন্থী দলের পক্ষেও তাদের কিছু চরমপন্থী অবস্থান ও বক্তব্য অনুমোদন করা সম্ভব হয় না।
ন্যাশনাল র্যালি সম্প্রতি ইউরোপীয় পার্লামেন্টে আইডেনটিটি অ্যান্ড ডেমোক্রেসি (আইডি) গ্রুপিং থেকে জার্মানির এই দলের বহিষ্কারের দাবি করেছে; কেননা দলটির এক বড় নেতা আংশিকভাবে হিটলারের কার্যক্রম সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য করেছিলেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের দুটি প্রধান দেশ ফ্রান্স ও জার্মানিতে অতি ডানপন্থীদের নাটকীয় উত্থান গোটা ইউরোপের জাতীয় রাজনীতিতে চরম ডানপন্থীদের উজ্জীবিত করেছে।
অন্যদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের সম্ভাব্য বিজয় ইইউজুড়ে জাতীয়তাবাদী ও জনতুষ্টিবাদীদের উৎসাহিত করবে বলে মনে হচ্ছে।
মনে হচ্ছে ইইউ সদস্য রাষ্ট্রগুলোয় ও ব্রাসেলসে তাঁরা আরও বেশি ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী হয়ে উঠবেন। তবে এখনো আশাবাদী হওয়ার বেশ কিছু দিক আছে। কারণ, ব্রাসেলসে মধ্যপন্থীদের অবস্থান টিকে থাকা ছাড়া পূর্ব ইইউভুক্ত দেশগুলোয় চরম ডানপন্থীদের ততটা বাড়বাড়ন্ত হয়নি।
হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডের মতো ডানপন্থী-প্রধান দেশগুলোয় ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদীরা পিছু হটতে শুরু করেছেন।
ঐতিহাসিক রেকর্ড অনুযায়ী এটি কিছুটা অপ্রত্যাশিত। যেসব দেশ ২০০৪ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগ দিয়েছিল, সেগুলো মূলত নেটিভিজম ও অতি ডানপন্থী রাজনীতির আঁতুড়ঘর বলে পরিচিত।
এদের মধ্যে ভিক্তর ওরবানের হাঙ্গেরি ‘অনুদার গণতন্ত্রের’ মধ্যমণি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওরবান যাবতীয় জবাবদিহি ও ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখার সংস্কৃতিকে ভেঙে ফেলেছেন; সুশীল সমাজ ও মুক্ত গণমাধ্যমের ওপর আক্রমণ করেছেন এবং ইইউর মূলধারাকে অস্বীকার করে সেখানে কার্যত এক ব্যক্তির শাসন জারি করেছেন।
ওই নির্বাচনের ফলের পর ওরবান যদিও বিজয় উদ্যাপন করেছেন, কিন্তু ভেতরে-ভেতরে তিনি চিন্তান্বিত হয়ে পড়েছেন। কারণ, তাঁর দল থেকে বেরিয়ে নতুন আরেকটি দল গঠন করা তরুণ নেতা পিটার ম্যাগিয়ার এই নির্বাচনে তাঁকে প্রায় ধরাশায়ী করে ফেলেছিলেন। কট্টর রক্ষণশীল ভাবাদর্শ থেকে বেরিয়ে আসা ম্যাগিয়ার পরের নির্বাচনে হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেন, সে দুর্ভাবনা ওরবানকে উতলা করে ফেলেছে।
ওরবানেরও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক ভক্ত ও অনুসরণকারী আছেন। স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ফিকো, তিবিলিসির শাসক জর্জিয়ান ড্রিম, যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ তাঁরা সবাই একই ধারার শাসনব্যবস্থা পছন্দ করেন।
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট নির্বাচনে হাঙ্গেরিতে ওরবানকে বিপর্যয়ের মুখে পড়তে দেখা গেছে। এই ইউরোপিয়ান ভোটকে দেশটির স্থানীয় ভোটের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়।
এই ভোটে ওরবানের ফিডেশ পার্টি রাজধানী বুদাপেস্টের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করতে পারলেও তাদের জয়ের ব্যবধান ছিল খুবই কম।
২০১৯ সালের ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে হাঙ্গেরিতে ওরবানের দল ৫২ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। আর এবার তাদের ভোট ৪৪ শতাংশে নেমে এসেছে।
ওই নির্বাচনের ফলের পর ওরবান যদিও বিজয় উদ্যাপন করেছেন, কিন্তু ভেতরে-ভেতরে তিনি চিন্তান্বিত হয়ে পড়েছেন। কারণ, তাঁর দল থেকে বেরিয়ে নতুন আরেকটি দল গঠন করা তরুণ নেতা পিটার ম্যাগিয়ার এই নির্বাচনে তাঁকে প্রায় ধরাশায়ী করে ফেলেছিলেন।
কট্টর রক্ষণশীল ভাবাদর্শ থেকে বেরিয়ে আসা ম্যাগিয়ার পরের নির্বাচনে হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেন, সে দুর্ভাবনা ওরবানকে উতলা করে ফেলেছে।
পোল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টাস্কের নেতৃত্বাধীন জোট সিভিক কোয়ালিশন (কো) ৩৭ দশমিক ১ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রথম স্থানে এসেছে।
এই ফলের মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, জারস্লাভ কাচজিনস্কির চেয়ে ১ শতাংশ ভোট বেশি পেয়েছে কো। অতি সামান্য ভোটে কো এগিয়ে থাকলেও এই জয় প্রতীকী অর্থে গুরুত্বপূর্ণ।
গত বছর ৩০ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী টাস্ক ক্ষমতায় এসেছিলেন। কিন্তু তারপর বাম ও একটি মধ্যপন্থী ব্লকের সঙ্গে এক হয়ে জোট সরকার গঠন করেছিলেন।
২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত রক্ষণশীল ল অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির শাসনাধীন থাকা অবস্থায় পোল্যান্ড অনুদার ও ইউরোপিয়ানবিরোধী অবস্থানের দিকে মোড় নিয়েছিল।
পার্লামেন্টে এখনো একক দল হিসেবে তাদের এমপির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তবে মিত্র ওরবানের মতো কাচজিনস্কির জনপ্রিয়তাও নিজের দেশে কমতে শুরু করেছে।
হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডকে ইইউতে মাঝারি সারির খেলোয়াড় হিসেবে খারিজ করা বেশ সোজা। তবে অনেকেই বিশ্বাস করেন, ফ্রান্স ও জার্মানিতে যে পটপরিবর্তন হচ্ছে, তা আসলেই গুরুত্বপূর্ণ।
তবে এখান থেকে শেখার অনেক কিছু আছে। এমনকি যেসব জায়গায় চরম ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদীরা ক্ষমতা দখল করেন, সেখানেও গণতন্ত্র স্থিতিস্থাপক প্রমাণিত হতে পারে।
নির্বাচন আসলেই গুরুত্বপূর্ণ এবং নির্বাচনই অনুদার রাজনীতিবিদ ও স্বৈরশাসকদের ডানা ছেঁটে দেওয়ার সুযোগ করে দিতে পারে। নির্বাচন এমন এক মাধ্যম, যা ইতালির মেলোনির মতো চরম ডানপন্থীদের মধ্যপন্থায় বাঁক নিতে বাধ্য করতে পারে।
তবে ফ্রান্সে যদি লো পেনের জয় হয় এবং ২০২৭ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে মাখোঁর স্থলাভিষিক্ত হন, তাহলে সেটি অবশ্যই আশঙ্কার বিষয় হবে।
পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে ইইউর সদস্যদেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং পরস্পর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে।
সে কারণে সিন নদীর তীরে আসন্ন সপ্তাহগুলোয় আয়োজিত ভোটে যে ফল পাওয়া যাবে, তা যে ইউরোপজুড়ে প্রভাব ফেলবে, তাতে সন্দেহ নেই।
● দিমিতার বেচেভ কার্নেগি ইউরোপের সিনিয়র ফেলো
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ