বিটিভি ভবনে পুড়িয়ে দেওয়া গাড়ির সারি
বিটিভি ভবনে পুড়িয়ে দেওয়া গাড়ির সারি

মানুষের জীবন নাকি সম্পত্তি, কোনটা বেশি দামি

সাম্প্রতিক সময়ে এটি একটি বড় প্রশ্ন। প্রীতিভাজন আনোয়ার গভীর শ্লেষের সঙ্গে প্রশ্নটি এভাবে উপস্থাপন করেছে, ‘সেতু ভবনে ৪০০ কোটি, ডিএনসিসির ২১০ কোটি, এক্সপ্রেসওয়ের ৫০ কোটি আর বিআরটিএর ৬০ কোটি...বিজিএমইএ বলছে তাদের ডেইলি লস ১ হাজার ৬০০ কোটি! কী বড় বড় ফিগার! ছোটবেলায় “ইত্যাদিতে” একবার হিসাব দেখাইসিলো হিউম্যান বডির এলিমেন্ট ওয়াইজ দাম বের করলে ২১–২২ হাজার হয় মাত্র! এখন সার্চ দিয়ে দেখলাম ৬০০ ডলারের মতো! সেই হিসাবে শ দুয়েক লাশে আর কয় টাকায় হয়? কিসের সাথে কিসের তুলনা! অদ্ভুত!’

আবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত আমার আগের লেখায় জনগণের সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে উল্লেখ না থাকায় কয়েকজন পাঠক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। সৌভাগ্যবশত পাঠদানের কারণে আমার ‘জীবনের মূল্য’ (কস্ট বেনিফিট অ্যানালিসিস কোর্স) ও ‘সম্পত্তির মূল্য’ (ফিন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট কোর্স) বিষয়ে সামান্য কিছু পড়াশোনা আছে। তারই আলোকে মানুষের জীবন, না জনগণের সম্পত্তি—কোনটা বেশি দামি প্রশ্নটির সুরাহা করার চেষ্টা করব।

প্রতিটি জীবনের দাম ৪৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার

‘দ্য ফরটি সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান’ নামে ২০০৩ সালের এক নিবন্ধে প্যাট্রিক ক্লিনটন মানুষের জীবনের মূল্যায়নের বিবর্তন তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন, আমাদের ছেলেবেলায় মানবদেহে বিদ্যমান রাসায়নিক দ্রব্যের ভিত্তিতে মানুষের জীবনের মূল্যায়ন করা হতো তার উৎপাদনক্ষমতার ভিত্তিতে নয়। সে হিসাবে একটি মানবদেহে ৭ দশমিক ১২ ডলারের ফসফরাস, ৫ দশমিক ৯৫ ডলারের পটাশিয়াম এবং ৪ মার্কিন ডলার মূল্যের এক ডজন অন্যান্য পদার্থ রয়েছে। সাকল্যে এই হিসাবে মানবদেহের মূল্য দাঁড়ায় ১৭ দশমিক ১৮ ডলার। 

পরবর্তী সময়ে মানবজীবনের মূল্য নির্ধারণের এ ধারণার পরিবর্তন ঘটে। নতুন ধারণায়, যেকোনো ব্যক্তির জীবনের মূল্য তার সারা জীবনের আয়-উপার্জনের বর্তমান মূল্যের সমপরিমাণ। এ হিসাবে প্রতিটি মানবজীবনের ছায়ামূল্য (শ্যাডো প্রাইস) ২.৫ মিলিয়ন ডলার থেকে ৪ মিলিয়ন ডলার। 

ব্যক্তিভেদে জীবনের মূল্য বিভিন্ন হওয়ার কারণ প্রথম আলোর ১৫০ মৃত্যুর বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট। মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে কম্পিউটার প্রকৌশলী, ব্যাংকার, ছাত্র, দিনমজুর ইত্যাদি রয়েছেন। তাঁদের সারা জীবনের আয়-উপার্জনের বর্তমান মূল্য বিভিন্ন। তাই তাঁদের জীবনের মূল্যও এই প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন হবে। 

একই পদ্ধতিতে আহত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে আঘাতের প্রকারভেদে ক্ষতির পরিমাণ ৪ হাজার ৭০০ ডলার (পড়ে গিয়ে আহত হওয়া) থেকে শূন্য দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার (মারাত্মক জখমের ক্ষেত্রে) হতে পারে। 

চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে জীবনের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দেহের জটিল কোষগুলোর বাজারমূল্যের ভিত্তিতে নির্ধারণের আলোচনা শুরু হয়েছে। যেমন ডি জাস্টোর প্রাক্কলন অনুযায়ী, ফুসফুসের বাজারমূল্য প্রতিটি ৫৮ হাজার ২০০ মার্কিন ডলার, হৃৎপিণ্ডের মূল্য ৫৭ হাজার ডলার, কিডনি জোড়ার মূল্য ৯১ হাজার ৪০০ ডলার। 

তবে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের চেয়েও বেশি মূল্যবান হচ্ছে শরীরের তরল পদার্থ, টিস্যু, প্রোটিন ইত্যাদি। যকৃতের বাজারমূল্য ৯১ হাজার ৪০০ ডলার হলেও এতে ২২ গ্রাম ট্রান্সফেরিন আছে, যা শরীরে লোহা প্রক্রিয়াজাত করতে ব্যবহৃত হয়। প্রতি গ্রাম ১৯ হাজার ৯০০ ডলার হিসাবে এর মূল্য দাঁড়ায় ৪ লাখ ২০ হাজার ডলার, যা যকৃতের মূল্যের সাত গুণের বেশি। 

শরীরের ডিএনএর বাজারমূল্য ৯ মিলিয়ন ডলারের বেশি। শরীরের সবচেয়ে মূল্যবান পদার্থ বোনম্যারোর দামই ২৩ মিলিয়ন ডলার। ডি জাস্টোর হিসাব অনুযায়ী, সাকল্যে প্রতিটি জীবনের মূল্য ৪৬ মিলিয়ন ডলার! 

এ হিসাবের পরিপ্রেক্ষিতে যে দুই শতাধিক প্রাণহানি ঘটেছে, বাজারমূল্যে তার ফলে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ১১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা বাংলাদেশের বার্ষিক জিডিপির প্রায় এক–চতুর্থাংশ। যাক, এবারে জনগণের সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতির হিসাব বিষয়ে আসি। 

জনগণের সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতির মূল্য 

স্থাবর সম্পত্তি, আন্দোলনে যার ক্ষতির কথা সরকার চড়া গলায় বলছে, মূল্যায়নের ক্ষেত্রে প্রচলিত পদ্ধতিগুলো হলো— এক. ক্রয়মূল্য; দুই. বাজারমূল্য বা ক্ষতিগ্রস্ত সম্পত্তির পুনর্বাসন ব্যয়; তিন. প্রত্যাশিত মূল্য, যা প্রত্যাশিত মূল্য থেকে প্রকৃত মূল্য বাদ দিয়ে বের করা হয়। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে ওপরের কোন ভিত্তিতে ক্ষয়ক্ষতির মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকারি ক্রয়ে অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণে সম্পত্তির ক্রয়মূল্য প্রকৃত মূল্যের চেয়ে ৩০-৫০ শতাংশ বেশি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত সম্পত্তির মেরামত বা পুনর্বাসন ব্যয় ধরাই সমীচীন হবে। তাই সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত মূল্য সরকার উল্লিখিত মূল্যের একটি ভগ্নাংশ মাত্র।

জানমালের ক্ষয়ক্ষতির দায়

ক্ষয়ক্ষতির মূল্য যা–ই হোক না কেন, প্রাণহানি বা জনগণের সম্পত্তির ক্ষতি—কোনোটাই কাম্য নয়। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায় আছে। জনগণের অর্থে পরিচালিত এসব বাহিনীর কাজই হলো জীবন রক্ষা ও সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি রোধ বা সীমিত করা। তাই প্রশ্ন ওঠে, গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনার হেফাজতে দায়িত্বপ্রাপ্ত এসব বাহিনী এ সময় কোথায় ছিল? তারা কেন এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলো? আর প্রাণহানির দায়ও তাদেরই। বিশেষ করে যাদের নির্দেশে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। 

গণ–অসন্তোষ ঘিরে আইন অমান্য আন্দোলন ও জনগণের সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি পৃথিবীর সব দেশেই কমবেশি ঘটে থাকে। তবে রাজনীতিবিদেরা ও আইন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সচেষ্ট থাকে, যাতে জনগণের সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সীমিত থাকে এবং প্রাণহানি পরিহার করা সম্ভব হয়।

বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সাম্প্রতিক মার্কিন সফর ও প্যারিসে অলিম্পিক অনুষ্ঠান উদ্বোধন উপলক্ষে ব্যাপক আইন অমান্য করার ঘটনা ঘটে। কিন্তু সেসব দেশের রাজনীতিবিদদের প্রজ্ঞা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধৈর্য ও সহনশীলতার ফলে সেখানে কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি এবং জনগণের সম্পত্তির সীমিত পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করা একটি সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত অধিকার। 

জীবনের চেয়ে মূল্যবান আর কিছু নেই 

জীবনের চেয়ে মূল্যবান কিছু নেই। সম্পত্তির ক্ষতি মেটানো সম্ভব কিন্তু প্রাণহানির ক্ষতি অপূরণীয়। আমরা জীবন ও সম্পত্তির ক্ষতি কোনোটাই চাই না। কিন্তু প্রাণহানির ক্ষতির সঙ্গে সম্পত্তির ক্ষতির কোনো তুলনাই চলে না।

আমরা রাজপথে ও অন্যত্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আর কোনো প্রাণহানি দেখতে চাই না। আমাদের সদাসতর্ক থাকতে হবে, যাতে আর কোনো দুঃশাসন নিরীহ, প্রতিবাদী নাগরিকের প্রাণহানির স্পর্ধা দেখাতে না পারে। আসুন, আমরা সবাই জীবনের জয়গান গাই। 

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান অর্থনীতিবিদ ও সাবেক সচিব