ঘূর্ণিঝড় রিমালে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা থেকে নোনাপানি সরানোর দিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে
ঘূর্ণিঝড় রিমালে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা থেকে নোনাপানি সরানোর দিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে

সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নোনাপানি অপসারণ

রিমালের খবর দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে সংবাদমাধ্যম থেকে। রিমালের পীড়া যত কঠিন হোক, তা আর কারও শিরে নেই, মনেও নেই। এরই মধ্যে দেশের নামকরা আলোকচিত্রশিল্পী দীন মোহাম্মদ শিবলী খুব দক্ষতার সঙ্গে আমাদের এক মহাসর্বনাশের ছবি তুলেছেন রিমাল বিধ্বস্ত এলাকা থেকে। 

ফেসবুকে ছবিটি ছাড়ার সময় শিবলী আকুতি করেছেন, লাইক, ওয়াও দেওয়ার আগে একটু ভাবতে, আমদের জন্য কী সর্বনাশ অপেক্ষা করে আছে? বলেছেন, ‘হাজার হাজার একর ধানিজমি এগুলো। মিঠাপানির পুকুরভরা মাছ ছিল এই জমিনে।

পোল্ডারের বাঁধ ভেঙে নোনাপানিতে তলিয়ে গেছে সবকিছু। সাইক্লোন রিমাল চলে গেছে এক সপ্তাহ হলো। মাসখানেকের মধ্যে আমন ধান করতে হবে এখানে। কেউ জানে না এই পানি কবে নামবে। শুকিয়ে গেলে লাখ টন লবণের কী হবে? আবার কি সবুজ ধানে ভরে উঠবে এই জমিনগুলো?’

১ জুন পরিবেশবাদী সংগঠন বাপা এক সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিল, এবারের সাইক্লোনে বেড়িবাঁধের ক্ষতি এক দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতের সৃষ্টি করতে যাচ্ছে। খুলনা অঞ্চলের তিন জেলায় ৬১ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিছু এলাকায় পুরোপুরি এবং কিছু এলাকায় আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাঁধ। এতে বাঁধসংলগ্ন নিচু এলাকা উপচে লোকালয়ে নোনাপানি প্রবেশ করেছে; শত শত গ্রামে চিংড়িঘেরসহ ফসলি জমিতে নোনাপানি প্রবেশ করেছে।

বরিশাল অঞ্চলে কমপক্ষে ৪০০ জায়গায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেড়িবাঁধ। নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে বহু স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে নোনাপানি ঢুকে মিঠাপানির আধারগুলো নষ্ট করে দিয়েছে। অনেক জায়গায় ভাটার টানে পানি বেরিয়ে যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। জলখালাসির পদ বিলুপ্তির পর থেকেই দেশের বেশির ভাগ জলকপাট রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কোথাও ভেঙে গেছে, কোথাও দেবে গেছে কপাট। 

আমন মৌসুম ধরতে হলে মাঠ থেকে জলাশয় থেকে দ্রুত নোনাপানি বের করার ব্যবস্থা নিতে হবে। পাম্প করে এই পানি বের করার ব্যবস্থা করা যায়। ১৯৯১ সালের সাইক্লোন এবং ২০০৭ সালের সিডরের পর এটা করা হয়েছিল। আমরা যদি এখনই নোনাপানি অপসারণ না করি এবং বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য জায়গা তৈরি না করি, তবে মানুষ তাঁদের জীবিকার শেষ বিকল্পটি হারাবেন। আমাদের এটি ১ সপ্তাহ বা ১০ দিনের মধ্যে করতে হবে। পানি অপসারণের পর নিচের এক-দেড় ফুট মাটি উঠিয়ে ফেলতে হবে। এই মাটি পাড় রক্ষার কাজে লাগানো যায়। 

এত পাম্পমেশিন, জনবল কোথায় মিলবে 

খবরে ফেসবুকে বিচ্ছিন্নভাবে নানা সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ত্রাণসামগ্রী বিতরণের প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে। ত্রাণসামগ্রীর চেয়ে বেশি দরকার পানি আর পানির উৎসগুলো লবণমুক্ত করা। ধানের মাঠকে নোনাপানি সরিয়ে নেওয়া। সেটাই হবে আসল ত্রাণ। জলাধার লবণমুক্ত করার কাজে কোস্টগার্ড, আনসার-ভিডিপি, সাইক্লোন প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) স্বেচ্ছাসেবক, রোভারস, ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরের সদস্য, যুব রেডক্রস স্বেচ্ছাসেবকদের সংগঠিত করা যেতে পারে। সংগঠিত করা যেতে পারে স্থানীয় মানুষদের। কাজের বিনিময়ে অর্থ কর্মসূচি শীতকালের জন্য অপেক্ষায় না রেখে এখনই হাতে নেওয়া যেতে পারে। 

পাম্পমেশিনের একটা বড় উৎস ছিল বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। একানব্বইয়ের সাইক্লোনের পর এগুলো ব্যবহৃত হয়েছিল। তা ছাড়া সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং ফায়ার সার্ভিসের পাম্পিং মেশিন ব্যবহার করা যেতে পারে। সেচকাজে ব্যবহৃত ব্যক্তিমালিকানাধীন পাম্পের কোনো ঘাটতি নেই এ দেশে। স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিরা সহজেই এগুলোর ব্যবস্থা করতে পারবেন। যেখানে কিছুই নেই, সেখানে শ্যালো নৌকার ইঞ্জিনও ব্যবহার করা যেতে পারে। 

নোনাপানি অপসারণের সঙ্গে সঙ্গে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ভেঙে যাওয়া বাঁধগুলো মেরামত করতে হবে। জনগণকে সম্পৃক্ত করে জনগণের মালিকানায় বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে বর্তমান নীতিকৌশল পরিবর্তন করে এটা করতে হবে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডকে (পাউবো) চরফ্যাশন মডেল নিয়েই এগোতে হবে। পাউবো ১৯৯১ সালের ঝড়ের পর স্থানীয় মানুষকে সম্পৃক্ত করে এবং তাঁদের হাতে বাঁধের মালিকানা ছেড়ে দিয়ে চরফ্যাশনে এক অভূতপূর্ব ইতিহাস তৈরি করেছিল। সে বাঁধ এখনো টিকে আছে। মানুষ সেটা রক্ষণাবেক্ষণ করে। সরকারের কোনো খরচ নেই। 

ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে শুধু অন্যান্য অবকাঠামোর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঝড়ের আগের দিন থেকে পড়ালেখা বন্ধ। এগুলো অবিলম্বে চালু করা প্রয়োজন। মেক শিফট বা আপত্কালীন অস্থায়ী ব্যবস্থার প্রবিধান সরকারের আছে। সেটা দ্রুত কার্যকর করা প্রয়োজন। সাইক্লোন উপদ্রুত অঞ্চলে জনস্বাস্থ্যের আরেক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে শৌচাগার। সবচেয়ে কম মজবুত করে বানানো শৌচাগারগুলো ঝড়ের প্রথম ধাক্কায় ভেঙে পড়ে। শৌচাগারের অভাবে সবচেয়ে বেশি সমস্যার মুখে পড়েছেন নারী, শিশু, প্রবীণ আর প্রতিবন্ধীরা।

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক 

nayeem5508@gmail.com