চীনের সামরিক শক্তি নিয়ে উদ্বেগ বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভূরাজনীতির নতুন বিন্যাস হচ্ছে। এটিকে অনেকে নতুন ঠান্ডা যুদ্ধ বলে অভিহিত করছেন।
এ মুহূর্তে দুটি ভিন্ন ত্রিপক্ষীয় জোটের জন্ম হতে দেখা যাচ্ছে। দুটি জোটই অদূর ভবিষ্যতে চীন যদি তাইওয়ানে আগ্রাসন শুরু করে তাহলে বেইজিংকে কীভাবে সম্মিলিতভাবে বাধা দেওয়া যায়, যুক্তরাষ্ট্রের সেই কৌশলের অংশ হিসেবে জন্ম হয়েছে।
যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া তাদের অকাস (এইউকেইউএস) জোটের কার্যক্রম অবধারিতভাবে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। সম্প্রতি জোটটি যৌথভাবে পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য আগামী পাঁচ বছরের জন্য পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী পার্থে পারমাণবিক সাবমেরিনগুলো নোঙর করার আশা করছে। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়া নিজেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ভার্জিনিয়া-ক্লাস সাবমেরিন কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অকাস সাবমেরিন চুক্তি ইংরেজিভাষী তিন জোটকে ইন্দো-প্যাসিফিকে ক্ষমতা প্রদর্শন করতে বড় ধরনের সহায়তা করবে। বিশেষ করে, চীনের তথাকথিত ফার্স্ট আইল্যান্ড চেইনে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা তৈরি হবে। পূর্ব চীন সাগর থেকে তাইওয়ান প্রণালি ও দক্ষিণ চীন সাগর পর্যন্ত অঞ্চল এই ফার্স্ট আইল্যান্ড চেইনের আওতাধীন।
অন্যদিকে জাপান-ফিলিপাইন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে জেএপিএইচইউএস নামে আরও একটি ত্রিপক্ষীয় জোট গঠনের জন্য দর-কষাকষি চলছে। ত্রিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা রূপরেখার মধ্য দিয়ে জোটের কার্যক্রম প্রথম দৃশ্যমান হয়েছে। ভবিষ্যতে তাইওয়ান ও ফার্স্ট আইল্যান্ড চেইনে চীনকে রণকৌশলগতভাবে বাধা দেওয়ার ক্ষেত্রে জোটটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে।
গত মাসে এশিয়া টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ওয়াশিংটনে নিযুক্ত ফিলিপাইনের রাষ্ট্রদূত হোসে ম্যানুয়েল রামুলদেজ বলেছেন, ‘যদি তাইওয়ানে কোনো ঘটনা ঘটে, তাহলে আপনারা কি ভেবেছেন আমরা তা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকব? মোটেই না। আমরা এখানে সত্যিকার অর্থেই একটি ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যে আছি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের জোট নিশ্চিতভাবেই খুব গুরুত্বপূর্ণ, কেননা আমরা আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছি, আর আজ যা করছি, তার পেছনে তাদের অবদান আছে।’
জাপান ও ফিলিপাইন দুটি দেশই তাইওয়ানের নিকট প্রতিবেশী। দেশ দুটিই পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাতে চলেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান যে শান্তিবাদী পররাষ্ট্রনীতি নিয়েছিল, সেখান থেকে তারা এখন অনেকটা সরে এসেছে। জাপান এখন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে কৌশলগতভাবে আরও সক্রিয় অবস্থান গ্রহণ করেছে।
ইউক্রেনের মতো অবরুদ্ধ দেশেও জাপান অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র ব্যবস্থা রপ্তানি করার উদ্দেশ্য নিয়ে এগোচ্ছে। টোকিওর এ মতো পদক্ষেপে তাইওয়ানের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে এবং চীনের সঙ্গে জাপানের সামরিক সংঘাতের শঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
এদিকে ফিলিপাইনে গত বছর চীনের অনুগত প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তের পরাজয় হয়। এরপর ম্যানিলা তাদের পুরোনো জোটে ফিরে গেছে। ফার্দিনান্দ মার্কোসের নেতৃত্বে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটি এখন ত্রিপক্ষীয় জোট জেএপিএইচইউএসে মূল কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
স্বশাসিত তাইওয়ানকে বেইজিং তাদের করদ রাজ্য বলে মনে করে। আঞ্চলিক নিরাপত্তা কৌশল ও অর্থনৈতিক একীভবনের ক্ষেত্রে তাইওয়ানের কেন্দ্রীয় ভূমিকায় রয়েছে। বিশ্বে অত্যাধুনিক চিপস উৎপাদনের ক্ষেত্রে তাইওয়ান শীর্ষে।
গত শতাব্দীতে যেমন পেট্রোলিয়াম পণ্য বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্র ছিল, এ শতাব্দীতে তেমন সেমিকন্ডাক্টর শিল্প বিশ্ব অর্থনীতির মূল কেন্দ্র হবে। কিন্তু রাজনৈতিক বিজ্ঞানী ক্রিস মিলারের মতে, তেলের চেয়ে চিপসশিল্প আরও বেশি জটিল। কেননা, তেল উৎপাদনকারী দেশের সংখ্যা অনেক হলেও চিপস উৎপাদনে তাইওয়ান সর্বেসর্বা।
তাইওয়ানের দিক থেকে বেইজিং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বড় ধরনের হুমকি অনুভব করছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের সাবেক স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের পর দ্বীপটি ঘিরে চীনের যুদ্ধপ্রস্তুতি দেখা যায়। এ মাত্রার যুদ্ধ প্রস্তুতি অভূতপূর্ব।
এক বছর আগে, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ডের কমান্ডার আডমিলার ফিলিপ ডেভিডসন সিনেটে সামরিক সেবা কমিটির শুনানিতে সতর্ক করে বলেন, ‘তাইওয়ানকে একীভূত করার সুস্পষ্ট লক্ষ্য রয়েছে চীনের। আমি মনে করি এটি এই দশকেই ঘটতে চলেছে, প্রকৃতপক্ষে আগামী ছয় বছরের মধ্যেই।’
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যেও একই কথার প্রতিধ্বনি শোনা গেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা সম্প্রতি কী দেখছি? চীনের বাহিনীগুলোর দিক থেকে কিছু প্ররোচনামূলক আচরণ আমরা দেখতে পেয়েছি।’
যুক্তরাষ্ট্র ও তাইওয়ানের শীর্ষ কর্মকর্তারা অবশ্য সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, চীনের দিক থেকে বড় কোনো পদক্ষেপ ২০২৪ সালের শুরুর দিকেই আসতে পারে। বিশেষ করে যদি আগামী নির্বাচনে তাইওয়ানের আরও বেশি স্বাধীনতাপন্থী ও কট্টর কেউ যদি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তাহলে সেই সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। সেটা যদি ঘটে তাহলে দ্য ইকোনমিস্ট-এর মতে, তাইওয়ান হয়ে উঠবে, ‘বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থান’।
অকাস জোটটি পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিনের ওপর নির্ভর করছে। আগামী দশকগুলোতে এই সাবমেরিন ইংরেজিভাষী দেশ তিনটির জোটকে নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের বড় ক্ষমতা দেবে। কম প্রাতিষ্ঠানিক হলেও জেএপিএইচইউএস জোটটি আঞ্চলিক কৌশল বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পেন্টাগনের কাছে আরও বেশি উপযোগী।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে জাপানের পক্ষ থেকে বেশ কিছু কৌশলগত নথি প্রকাশ করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলসংক্রান্ত নথি।
জাপানের সংবিধান শান্তিবাদী হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে দেশটি ‘আঘাত আসলে পাল্টা আঘাতের সক্ষমতা অর্জনের সামর্থ্য’ অর্জনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেছে। জাপান আগামী পাঁচ বছর প্রতিরক্ষা বাজেট দ্বিগুণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সামরিক বাহিনীকে আধুনিকায়ন করতে এ সময় দেশটি ৩১৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তাইওয়ানকে নিয়ে একই উদ্বেগে থাকা পুরোনো মার্কিন মিত্র ফিলিপাইনকে কাছে পাচ্ছে জাপান। ফিলিপাইনের দ্বীপ ম্যাভুলিসে নৌঘাঁটি করেছে ম্যানিলা। এটি তাইওয়ানের বেলাভূমি থেকে মাত্র ১০০ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থিত।
মার্কোস জুনিয়র প্রশাসন যখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক চুক্তির আওতায় ফিলিপাইনের উত্তর অঞ্চলে সামরিক ঘাঁটি খুলছে আর জাপান তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় দ্বিগুণ করেছে।
গত মাসে এশিয়া টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ওয়াশিংটনে নিযুক্ত ফিলিপাইনের রাষ্ট্রদূত হোসে ম্যানুয়েল রামুলদেজ বলেছেন, ‘যদি তাইওয়ানে কোনো ঘটনা ঘটে, তাহলে আপনারা কি ভেবেছেন আমরা তা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকব? মোটেই না। আমরা এখানে সত্যিকার অর্থেই একটি ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যে আছি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের জোট নিশ্চিতভাবেই খুব গুরুত্বপূর্ণ, কেননা আমরা আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছি, আর আজ যা করছি, তার পেছনে তাদের অবদান আছে।’
রিচার্ড হেডারিয়ান একাডেমিক ও ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে