ভালো ফলের খেসারত কিংবা নির্বুদ্ধিতার দণ্ড ও রাষ্ট্রের দায়

১৯৯২ সালে আমি এসএসসি পাস করি। মাত্র ৪ নম্বরের জন্য সম্মিলিত মেধাতালিকায় স্থান করে নিতে পারিনি। এরপর সরকারি বিএম কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হয়ে খেলাধুলা সীমিত করে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম। এইচএসসি ফাইনালের ফল প্রকাশিত হলো ১৯৯৪ সালের ২০ ডিসেম্বর। আমি যশোর বোর্ডে সম্মিলিত মেধাতালিকায় বাণিজ্য বিভাগ থেকে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করি। বাড়িতে খুশির বন্যা বয়ে গেল। আমার মতো চঞ্চল ছেলের এত ভালো ফল করা গ্রামের সবাইকে তাক লাগিয়ে দিল।

এরপর একদিন টিভিতে খবর শুনলাম, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বোর্ডে স্ট্যান্ড করা শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা দেবেন। সংবর্ধনার তারিখ ও সময় জানিয়ে দেওয়া হলো। খুশিতে মন ভরে উঠল। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য যাবতীয় কাগজপত্র তৈরি করলাম।

দেশ তখন রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। তাই প্রথম তারিখটি পরিবর্তন করা হলো তৎকালীন বিরোধী দলের দেশব্যাপী হরতালের কারণে। পরে আবার তারিখ ঘোষণা করা হলো। কিন্তু সেবারও সংবর্ধনার দিনে হরতাল থাকায় তারিখ পরিবর্তন করতে হলো। এবার তারিখ নির্বাচন করা হলো ১৯৯৫ সালের ১৫ এপ্রিল, সময় সম্ভবত সকাল সাড়ে নয়টা।

ওই একই দিন সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের ভর্তি পরীক্ষা ছিল। আমরা চার বোর্ড থেকে বাণিজ্য বিভাগে ৮০ জন মেধাতালিকায় ছিলাম। কারও সঙ্গে কারও সে রকম পরিচয় ছিল না। আমরা দ্বিধায় পড়ে গেলাম সংবর্ধনায় অংশগ্রহণ করা নিয়ে।

আমার চাচাতো ভাই তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী। তিনি আমাকে নিয়ে ১৪ এপ্রিল উপাচার্য অফিসে গেলেন। তখন উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ। তিনি ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করে সংবর্ধনায় যেতে বললেন। পরে তিনি তাঁর বিশেষ ক্ষমতায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে নেবেন বলে আশ্বাস দিলেন। যারাই তাঁর অফিসে যোগাযোগ করেছে, তাদের তিনি একই কথা বলেছিলেন।

আমি তাই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করলাম। অনুষ্ঠান শেষে বুঝতে পারলাম, ৮০ জনের বেশির ভাগই ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সংবর্ধনায় যোগ দিয়েছে। আমরা চার বোর্ডের মাত্র ১৯ জন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করিনি। ভর্তি নিয়ে তখনো আমাদের মনে কোনো সংশয় তৈরি হয়নি।

এরপর উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ তৎকালীন বাণিজ্য অনুষদের ডিন অধ্যাপক এ বি এম খালেদকে আমাদের ভর্তি নিয়ে নেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু ডিন তাঁর কথা শোনেননি। দিন দুয়েকের মধ্যেই ক্যাম্পাসে আমাদের ভর্তির পক্ষে-বিপক্ষে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের পাল্টাপাল্টি মিছিল হতে দেখলাম। আমরা এবার সত্যিকার অর্থেই সংকটে পড়ে গেলাম।

আমরা ১৯ জনের প্রায় সবাই তখন ক্যাম্পাসে একত্র হলাম। একদিন কয়েকজন মিলে ডিনের সঙ্গে দেখাও করলাম আমাদের ব্যাপারে তাঁর সিদ্ধান্ত জানার জন্য। তিনি সরাসরি জানিয়ে দিলেন, ওই বছর আর আমাদের ভর্তি হচ্ছে না এবং পরবর্তী বছরের ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে বললেন। ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুইবার ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা যেত। যদিও তখন প্রায় প্রতিদিনই আমাদের ভর্তির বিষয়ে উপাচার্য, ডিন ও শিক্ষক সমিতির বিবৃতি পত্রপত্রিকায় আসত। শেষ পর্যন্ত আমরা আর বাণিজ্য অনুষদে ভর্তি হতে পারিনি। আমরা শুনেছি, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নাকি ডিনকে ফোন করে নির্দেশ দিয়েছিলেন আমাদের ভর্তি করিয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি সে নির্দেশ যৌক্তিকভাবে নাকচ করে দেন।

আমাদের মধ্যে কেউ কেউ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। দু-একজন ঘ ইউনিটের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য বিষয়ে ভর্তি হয়। আমি বাণিজ্য বিষয়ে পড়াশোনা করব বলে ঘ ইউনিটের ফরমও কিনিনি। তাই আমার এক বছর পাঠবিরতি হয়। গভীর হতাশা নিয়ে আমি একটি বছর কাটিয়ে দিলাম। যাঁরা আমার এইচএসসির কৃতিত্বপূর্ণ ফলে মনে মনে খুশি হতে পারেননি, তাঁরা এ ঘটনায় খুব খুশি হয়েছিলেন। মাঝেমধ্যে তাঁরা এ নিয়ে আমাকে বিভিন্ন ইঙ্গিত করতেন।

পরবর্তী বছর ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং বিভাগে। প্রথম বর্ষ থেকেই হলে থাকা শুরু করলাম। প্রথম বছর চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে এবং তারপর অন্যদের সঙ্গে। গভীর মনোযোগসহকারে পড়াশোনা করলাম। ভালো ফলও পেলাম। ১৯ জনের মধ্যে কুমিল্লা বোর্ডে তৃতীয় স্থান অর্জন করা একজন আমাদের বিভাগেই ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু হতাশায় ডুবে গিয়ে সে আর পাস করতে পারেনি।  

আমি যখন তৃতীয় বর্ষে পড়ি, তখন খালেদা জিয়া বিরোধীদলীয় নেত্রী। তখন আমি একবার ২৯ মিন্টো রোডে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম আমার ক্ষোভের কথা জানাতে। তাঁর পিএস রুমের ভেতরে গিয়ে আমার বিষয়টি জানালে তিনি আর দেখা করেননি। সম্ভবত তাঁর কাছে আমার প্রশ্নের কোনো সদুত্তর না থাকায় তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হননি। তবে আমি তাঁর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উচ্চ স্বরে আমার ক্ষোভের কথা জানিয়ে চলে আসি।

এরপর একসময় যাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের কাঁটাবনের বাসভবনে। দরজা খোলার পর আমার পরিচয় দিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলা শুরু করি। আমাদের ভর্তির বিষয়ে তাঁর অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তের জন্য তাঁকে ভর্ৎসনা করি। তাঁর স্ত্রী আমাকে চা খাওয়ার অনুরোধ করলেও আমি তা প্রত্যাখ্যান করে চলে আসি।

ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করে আমাদের সংবর্ধনায় যাওয়া হয়তো বোকামি ছিল। কিন্তু যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার তারিখ ও সময় আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল, সেখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কীভাবে এ রকম একটি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান একই দিনে, একই সময়ে নির্ধারণ করল? শিক্ষা মন্ত্রণালয় কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি জানত না?
আর আমরা সরল মনেই ওই সংবর্ধনায় অংশগ্রহণ করেছিলাম। এর মধ্যে কোনো রাজনীতি ছিল না। আমাদের এ রকম ধান্দাও ছিল না যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করে ফাঁকতালে সেখানে ভর্তি হব। এই ১৯ জনের মধ্যে ঘটনাক্রমে আমরা যশোর বোর্ডের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অর্জনকারীরাও ছিলাম। এর মধ্যে প্রথম দুজন ঢাকা ও তৃতীয় জন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

কী অদ্ভুত এক রাষ্ট্র ও তার সরকার! একদল শিক্ষার্থীকে মেধাবী গণ্য করে তাদের জন্য সংবর্ধনার আয়োজন করা হলো। তাতে যোগ দিতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের একটি অংশের শিক্ষাজীবন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেল, কিন্তু রাষ্ট্রের তাতে কিছু যায় আসেনি। এ ঘটনার পর সরকার চাইলে আমাদের উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠাতে পারত। নিদেনপক্ষে আমাদের একটু খোঁজখবর নিতে পারত। কিন্তু সরকার সে প্রয়োজনটুকুও মনে করেনি।

আমাদের এমবিএর ফলাফল প্রকাশের অল্প কয়েক দিনের মধ্যে সাবেক ডিন এ বি এম খালেদ স্যারের সঙ্গে বাণিজ্য অনুষদে আমার দেখা হয়। আমি তাঁর পা ধরে সালাম করি। তিনি আমার পরিচয় জেনে অবাক হন। কারণ আমাদের ভর্তির ব্যাপারে তাঁর নৈতিক অবস্থানের জন্যই আমাদের অনেকের এক বছর পাঠবিরতি ঘটে। তিনি অনুষদে দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে অনেক সময় ধরে কথা বলেন। আমাকে দীর্ঘক্ষণ যাবৎ বোঝাতে চেয়েছেন তিনি কেন ওই ভর্তি আদেশকে অবৈধ মনে করে তার বিরোধিতা করেছিলেন। আমিও তাঁর ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হয়েছিলাম।

আমার সৌভাগ্য হয়েছিল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই আমলেই হলে থাকার। ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ সমানভাবেই বিভিন্ন সময়ে জ্বালিয়েছে। তাদের কদর্য রাজনীতি খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছি। ছাত্রনেতাদের সামনে হলের প্রাধ্যক্ষ ও হাউস টিউটরদের অসহায়ত্ব দেখেছি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে শিক্ষক রাজনীতির নানা রূপ পর্যবেক্ষণ করেছি। ক্ষমতাসীনদের সামনে শিক্ষকদের নতজানু হয়ে যাওয়া অবলোকন করেছি, দেখেছি কীভাবে শিক্ষক নেতারা সরকারি দলের এমপি-মন্ত্রীদের তাঁবেদারি করেন। মনে মনে এ বি এম খালেদ স্যারের মতো একজন শক্ত মেরুদণ্ডের শিক্ষক খুঁজে বের করতে চেষ্টা করলাম। দেখলাম ওই ধরনের শিক্ষক প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছেন অথবা থাকলেও আমার জানা নেই।

আমাদের এ ঘটনা নিয়ে অনেকের মধ্যেই নানা রকম ভুল ধারণা ও ব্যাখ্যা রয়েছে। আমি নিজেও এ ঘটনার অপব্যাখ্যা শুনেছি অনেকের মুখে। তাই অনেক দেরি হলেও ঘটনাটি সবিস্তার বর্ণনা করার তাগিদ অনুভব করলাম।

  • মো. মাইন উদ্দিন অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়