যুক্তরাজ্যের কারাগার থেকে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের ছাড়া পাওয়াকে তাঁর ও বিশ্বজুড়ে থাকা তাঁর অগণিত ভক্তের জয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। কিন্তু আদতে এই জয় তাঁর এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সুস্পষ্ট সুরক্ষার জন্য যথেষ্ট নয়। আদালতে অ্যাসাঞ্জ দোষ স্বীকার করবেন—যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এ শর্তযুক্ত চুক্তির অংশ হিসেবে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। বিচারে দোষী প্রমাণিত হলে ১৯৭১ সালের গুপ্তচরবৃত্তি আইন অনুযায়ী ‘যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় প্রতিরক্ষা–সম্পর্কিত গোপনীয় তথ্য ও নথি বেআইনিভাবে হাতিয়ে নেওয়া ও প্রচার করার জন্য’ তাঁর জেল হতে পারে।
উত্তর মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী সাইপানের মার্কিন আদালতে বুধবার (আজ) উইকিলিকস প্রতিষ্ঠাতার মামলার শুনানি হবে এবং শুনানি শেষে তিনি জামিনে মুক্ত হবেন বলে আশা করা হচ্ছে। কিন্তু গুপ্তচরবৃত্তি–বিষয়ক এ আইন কেবল যুক্তরাষ্ট্রের নয়, তার বাইরেরও যেসব সাংবাদিক জাতীয় নিরাপত্তা–সংক্রান্ত বিষয়ে প্রতিবেদন করে থাকেন, তাঁদেরও ঘাড়ের ওপর খাঁড়ার মতো ঝুলে থাকবে। প্রসঙ্গত, অ্যাসাঞ্জ নিজে একজন অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক; মার্কিন নাগরিক নন।
মার্কিন কৌঁসুলিরা যুক্তি দিয়েছেন, অ্যাসাঞ্জ মোটেও কোনো সাংবাদিক ছিলেন না। তিনি মূলত এমন একজন হ্যাকার, যিনি তাঁর ব্যক্তিগত এজেন্ডা নিয়ে কাজ করেছেন। তাঁদের যুক্তি হলো, যেহেতু অ্যাসাঞ্জ যুক্তরাষ্ট্রকে তথ্য সরবরাহ করা বহু মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছেন, তাই সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ক্ষতি না করেও তাঁর বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি আইন প্রয়োগ করা যেতে পারে।
কিন্তু সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক স্বাধীনতার প্রবক্তারা বলে আসছেন, অ্যাসাঞ্জ মূলধারার সাংবাদিক কি না বা তাঁকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে, এ ক্ষেত্রে এসব একেবারে অপ্রাসঙ্গিক আলাপ। তাঁরা বলছেন, অ্যাসাঞ্জকে যে কাজের জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে, তা হলো ‘গোপনীয় তথ্য বের করা ও তা প্রচার করা’, আর পেশাগত দায়িত্ব হিসেবে জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক সাংবাদিকেরা এ কাজ হামেশাই করে থাকেন।
২০১০ সালে মার্কিন সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিশ্লেষক চেলসি ম্যানিং ইরাক ও আফগান যুদ্ধবিষয়ক বিভিন্ন নথি উইকিলিকসের হাতে তুলে দিয়েছিলেন এবং উইকিলিকস তথ্যগুলো প্রকাশ করেছিল। ওই নথিপত্র প্রকাশের পর ইরাক যুদ্ধ ও আফগান যুদ্ধে মার্কিন সেনাবাহিনীর মাধ্যমে সম্ভাব্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি আলোতে এসেছিল। এই অতি গোপনীয় তথ্যগুলো জরুরি জনস্বার্থ–সংশ্লিষ্ট—এমন বিবেচনা থেকেই সে সময় দ্য গার্ডিয়ান এবং অন্যান্য সংবাদ সংস্থা এগুলো প্রকাশ করেছিল।
২০২১ সালে জো বাইডেন দায়িত্ব নেওয়ার পর তাঁর হাতে তাঁর পূর্বসূরি ট্রাম্পের জারি করা গুপ্তচরবৃত্তি আইনের অভিযোগগুলো প্রত্যাহার করতে পারতেন। কিন্তু বাইডেন তা করেননি। বারাক ওবামার সময়কার বিচার বিভাগ সাংবাদিকতার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে মনে করে এ আইন অনুসরণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
বাইডেনের অধীন মার্কিন কৌঁসুলিরা ট্রাম্পের করা অভিযোগগুলো তুলে নেননি। এসবের মধ্যেই অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি হয়। চুক্তির শর্ত হিসেবে অ্যাসাঞ্জ গোপনীয় নথিগুলোর অপব্যবহারের বিষয়টি স্বীকার করবেন।
গত মার্চে অ্যাসাঞ্জের নিজের দেশ অস্ট্রেলিয়ার সরকারের উৎসাহে চুক্তির প্রক্রিয়াটি চালু হয়েছিল বলে জানা যাচ্ছে। তবে অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে জো বাইডেন মামলা চালু রাখলেও রাজনৈতিক দিক বিবেচনা করে তিনি অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রে আনতে চাননি। অ্যাসাঞ্জকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে এসে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করালে সেটি বাইডেনের নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
এটি বাইডেনকে প্রগতিশীল ও স্বাধীনতাবাদীদের কাছ থেকে আরও বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে। বাইডেন গত এপ্রিলে বলেছিলেন, তিনি অ্যাসাঞ্জের বিচার প্রত্যাহার করা–সংক্রান্ত একটি অস্ট্রেলিয়ান অনুরোধ বিবেচনা করছেন। কিন্তু বিচার বিভাগ তার বন্দুক এখনো তাক করে আছে বলে মনে হচ্ছে এবং কৌঁসুলিরা তাঁদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
অ্যাসাঞ্জ লন্ডনের উচ্চ আদালতে তাঁর প্রত্যর্পণের বিরুদ্ধে আপিল করার অধিকার প্রশ্নে পক্ষে রায় পাওয়ার পর মার্কিন বিচার বিভাগ একটি আবেদন চুক্তিতে সম্মত হয়েছে। তবে এখনো তারা গুপ্তচরবৃত্তি আইন ব্যবহার করার বিষয়ে জেদ ধরে রেখেছে।
কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির নাইট ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্ট ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক জামিল জাফর বলেন, ‘একটি চুক্তি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি এড়াতে পারে, কিন্তু চুক্তিটি মনে করিয়ে দেবে, সাংবাদিকেরা প্রতিদিন যা করে থাকেন, তা করার জন্য অ্যাসাঞ্জকে পাঁচ বছর জেল খাটতে হয়েছে। এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধরনের সাংবাদিকতার ওপর লম্বা ছায়া ফেলবে। এই ছায়া শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়; বরং তা সারা বিশ্বকে ঢেকে দিতে পারে।’
● জুলিয়ান বোর্জার দ্য গার্ডিয়ান–এর কলাম লেখক
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত