পুতিন ও সি চিন মিলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চলেছেন

চীনের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান সি চিন পিং এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে সম্পর্কের ধরন কেমন, তা নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের অনেকেই ধাঁধার মধ্যে আছেন।
ছবি : এএফপি

আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে সহিংস দুই বিপ্লবের উত্তরাধিকারী পরস্পরের সঙ্গে হাত মেলালেন। তাঁদের ‘নতুন যুগের জন্য সমন্বিত কৌশলগত অংশীদারত্ব’ পুনর্মূল্যায়ন করলেন। সম্প্রতি মস্কোয় সেই ঘটনা আমরা ঘটতে দেখলাম।

চীনের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান সি চিন পিং এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে সম্পর্কের ধরন কেমন, তা নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের অনেকেই ধাঁধার মধ্যে আছেন। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, অনেকের ধারণা, ইউক্রেন যুদ্ধে সি চিন পিংয়ের অবস্থান নিরপেক্ষ। অনেকে আবার এটাও ভাবছেন, সি চিন পিং এ যুদ্ধে শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী।

বিশ্বায়নের শান্তিপূর্ণ বিশ্বে কেন চীন-রাশিয়ার মধ্যে নতুন সম্পর্ক স্থাপিত হলো, সেটা কষ্ট করে কল্পনা করার চেয়ে বরং আমাদের এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য ইতিহাসে ফিরে যেতে হবে। এর জন্য বিশ্বের সঙ্গে রাশিয়া ও চীন যে সংঘাতে জড়িয়েছে, সেই ইতিহাস আমাদের বুঝতে হবে।

ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর জন্য পুতিন খোলাখুলিভাবে চীনের কাছ থেকে অর্থনৈতিক শক্তি পেয়েছে। এই আগ্রাসন চীন-রাশিয়া অক্ষ জোটের পুনর্জীবনের ক্ষেত্রে প্রথম ভূরাজনৈতিক পদক্ষেপ। ঠান্ডা যুদ্ধ–পরবর্তী শান্তিপূর্ণ বিশ্ব নিয়ে এ দুটি রাষ্ট্র কখনোই পরিতৃপ্ত ছিল না। আবারও গণতান্ত্রিক বিশ্ব ইউরোপ ও এশিয়ার দুই স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরক্ষা নিয়ে বিস্তর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিনদের কৌশলগত মহাপরিকল্পনা সোভিয়েত ইউনিয়নের দিক থেকে আসা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তৈরি করা হয়েছিল। ১৯৫০ সালে এক নিবন্ধে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা পল নিৎসে তাঁর যুগের আন্তর্জাতিক ঘটনাবলির অভিজ্ঞতার আলোকে এটি ব্যাখ্যা করেছেন, ‘গত ৩০ বছরের মধ্যে বিশ্ব দুটি বিশ্বযুদ্ধের অবর্ণনীয় সহিংসতার অভিজ্ঞতা দেখেছে। রাশিয়া ও চীনে দুটি বিপ্লব প্রত্যক্ষ করেছে। অটোমান, অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান, জার্মান, ইতালীয় ও জাপানি—এই পাঁচ সাম্রাজ্য ধসে যেতে দেখেছে এবং ব্রিটিশ ও ফ্রান্স—এই দুটি প্রধান সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা বিশাল ক্ষয় হতে দেখেছে।’

চীন ও রাশিয়া এশিয়া ও ইউরোপে যে ভৌগোলিক অবস্থান ধরে রেখেছে, সেটাই চীন-সোভিয়েত মৈত্রীর আদি ভূগোল। স্তালিন একসময় চীনের কমিউনিস্ট পার্টির উদ্দেশে যেমনটা বলেছিলেন, ‘আমাদের মধ্যে একটা শ্রমবিভাজন থাকা উচিত...প্রাচ্যে কাজ করার ক্ষেত্রে তোমাদের আরও দায়িত্ব নেওয়া উচিত...পাশ্চাত্যে কাজ করার ক্ষেত্রে আমরা আরও দায়িত্ব নেব।’

ঠান্ডা যুদ্ধের কৌশলগত প্রাথমিক নথি এনএসসি-৬৮ প্রণেতাদের একজন ছিলেন পল নিৎসে। তাঁর পর্যবেক্ষণ ছিল, ‘আন্তর্জাতিক ক্ষমতার বিন্যাস মৌলিকভাবে পরিবর্তিত হতে চলেছে।’ বৈশ্বিক ক্ষমতার বিন্যাস পরিবর্তনের পেছনে রুশ ও চীনাদের দুটি বিপ্লব যে বড় কারণ, সেটা খুব বুদ্ধিমানের মতো স্বীকার করে নিয়েছিলেন নিৎসে।

দুই বিপ্লবের অভিঘাত যে এখনো পুরোপুরি অবসান হয়নি, সেটা আমাদের উপলব্ধিতে আসা প্রয়োজন। একটি বিষয় আমাদের স্মরণে রাখা উচিত যে একুশ শতকে এসে রাশিয়া ও চীন যে শাসকেরা চালাচ্ছেন, তাঁরা খাঁটি রুশ ও চীনা বিপ্লবের পণ্য। নিৎসে তাঁর জীবদ্দশায় সঠিকভাবেই বুঝেছিলেন, দুই বিপ্লব বিশ্ব ইতিহাস ও ভূরাজনীতিকে নতুনভাবে বিন্যস্ত করবে।

মার্কিন গোয়েন্দা কারিগর হিসেবে পরিচিত জ্যাক ডিভাইন বের করেছেন, পূর্ব জার্মানির ড্রেসডেনে পুতিনের ক্যারিয়ার বিকশিত হয়েছিল। আর সোভিয়েত সাম্রাজ্যের পতনকে পুতিন বলেছিলেন, ‘বিশ শতকের সবচেয়ে বড় ভূরাজনৈতিক বিপর্যয়।’

চীনের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান সি চিন পিং ‘চীনা জাতির মহান নবজীবনের’ উত্তরাধিকার। মাও সে–তুঙের ‘নতুন চীন’ এবং ১৯৪৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিষ্ঠা থেকে পার্টির মধ্যে জন্ম নেওয়া নানা তত্ত্বের মেলবন্ধন ঘটেছে এই প্রকল্পে। সি চিন পিং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছেন। তিনি নতুন বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চান, যে ‘বিশ্বের কেন্দ্রে’ থাকবে চীন। এই অভিযাত্রায় পুতিনের রাশিয়া চীনের প্রধান সহযোগী এবং ‘কৌশলগত অংশীদার’।

বিশ শতকে কর্তৃত্ববাদী কমিউনিস্ট রাষ্ট্র রাশিয়া ও চীন, বিশ্বের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ওপর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল এবং তাদের মতো করে বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট ছিল। চীন-সোভিয়েত মৈত্রী এক দশক ধরে কোরিয়ান যুদ্ধ ও তাইওয়ানে বহুমুখী সংকট সৃষ্টির পেছনে দায়ী ছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের জন্য দুই মঞ্চে কৌশলগত চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছিল এই মৈত্রী। যুক্তরাষ্ট্র সে সময় সবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে লড়াই করেছিল। সম্ভবত সে কারণে দুই মঞ্চে লড়াই করার সক্ষমতা দেখিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।

পুতিনের ইউক্রেন যুদ্ধ কেবল একটা সংঘাত নয়, এই যুদ্ধ নতুন অক্ষ জোটের জন্ম দিতে পারে।

আবার সমাজতান্ত্রিক চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নে একই সময়ে সংকট তৈরি হওয়ায় দেশ দুটি তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষায় লাগাম টেনে ধরতে বাধ্য হয়। ঘটনাক্রমে চীন-সোভিয়েত সম্পর্ক অটেকসই হয়ে পড়ে এবং এ সম্পর্কে ফাটল সৃষ্টি হয়। কেননা মাও সে–তুং চীনকে বিশ্বে এমন এক অবস্থানে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, যারা বিশ্বের কেন্দ্রীয় শক্তি হবে। মস্কোর ছোট ভাই হিসেবে বেইজিং আর ভূমিকা পালন করতে চাইল না।
আজ অবশ্য সেই ভূমিকা বদলে গেছে। চীন-রাশিয়ার পুরোনো সেই আকাঙ্ক্ষা আবার ফিরে এসেছে। কিন্তু কমিউনিস্ট মতাদর্শের নামে নয়; আগ্রাসন ও সামরিক জাতীয়তাবাদের আলোকে সেটা ফিরেছে।

সি চিন পিং ও ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের মাত্র এক সপ্তাহ আগে বেইজিং অলিম্পিকে দুই দেশের সম্পর্কের দার্শনিক গভীরতা ও সীমারেখা নিয়ে তাঁদের যৌথ ইশতেহার ঘোষণা দেন। কিন্তু দুই দেশের কৌশলগত সম্পর্ক আরও আগের বিষয়। ২০১০-এর দশকজুড়ে চীন ও রাশিয়া তাদের সামরিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বাড়াতে যৌথভাবে কাজ করে। বেইজিং অলিম্পিকের যৌথ ইশতেহারে চীন ও রাশিয়া পরস্পরের ‘কেন্দ্রীয় স্বার্থগুলো’ সমর্থন জানিয়ে যাবে বলে অঙ্গীকার করে।

তাইওয়ানের ওপর চীনের দাবির প্রতি সমর্থন জানায় রাশিয়া। মস্কো অঙ্গীকার করে, ‘তাইওয়ান চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।’ অন্যদিকে বেইজিংয়ের অঙ্গীকার হলো, ‘দুই পক্ষই ন্যাটোর সম্প্রসারণের বিরোধিতা করবে এবং ন্যাটোকে ঠান্ডা যুদ্ধকালীন আচরণ পরিত্যাগ করার আহ্বান জানায়।’ ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর থেকে পারমাণবিক সক্ষমতাসমৃদ্ধ বোমার যৌথ মহড়া; স্থল ও নৌবাহিনীর যৌথ মহড়া; জ্বালানি ও প্রযুক্তি খাতে বাণিজ্য বৃদ্ধি; মস্কোর সমর্থনে চীনের প্রোপাগান্ডা—এই সবকিছুই দুই দেশের সম্পর্কে নতুন মাত্রা দিয়েছে।

চীন ও রাশিয়া এশিয়া ও ইউরোপে যে ভৌগোলিক অবস্থান ধরে রেখেছে, সেটাই চীন-সোভিয়েত মৈত্রীর আদি ভূগোল। স্তালিন একসময় চীনের কমিউনিস্ট পার্টির উদ্দেশে যেমনটা বলেছিলেন, ‘আমাদের মধ্যে একটা শ্রমবিভাজন থাকা উচিত...প্রাচ্যে কাজ করার ক্ষেত্রে তোমাদের আরও দায়িত্ব নেওয়া উচিত...পাশ্চাত্যে কাজ করার ক্ষেত্রে আমরা আরও দায়িত্ব নেব।’

পুতিনের ইউক্রেন যুদ্ধ কেবল একটা সংঘাত নয়, এই যুদ্ধ নতুন অক্ষ জোটের জন্ম দিতে পারে। ঠান্ডা যুদ্ধোত্তর বিশ্বে গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমে চীন এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে তারা গণতান্ত্রিক বিশ্বকেই চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।

বিশ শতকের সেই পুরোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিশ্বে আবার ফিরে এসেছে। সত্যিকার অর্থে সেটা বিদায় নেওয়ার নয়।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

  • জনাথন ডি টি ওয়ার্ড অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর চেঞ্জিং ক্যারেক্টার অব ওয়্যারের গবেষণা সহযোগী