মুক্তিযুদ্ধের সময় ফারুক আজিজ খান ছিলেন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একান্ত সচিব। সেই সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি Spring 1971 নামে একটি বই লিখেছেন। আসজাদুল কিবরিয়ার অনুবাদে বসন্ত ১৯৭১: মুজিবনগর সরকারের কেন্দ্র থেকে দেখা মুক্তিযুদ্ধ নামে বইটি প্রকাশ করেছে প্রথমা। বিজয়ের মাসে সেই বইয়ের কিছু চুম্বক অংশ দুই পর্বে প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হচ্ছে। আজ প্রকাশিত হলো প্রথম পর্ব।
একদা অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের বিলাসবহুল ভবনটি অবশ্য কোনো সরকারের সচিবালয়ের জন্য যথেষ্ট বড় ছিল না। তারপরও বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামারুজ্জামান এই ভবনেই তাঁদের কার্যালয় স্থাপন করে কাজ চালিয়ে গেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ অবশ্য চাতুর্যের সঙ্গে নিজেকে আলাদা করে নেন এবং ৯ নম্বর সার্কাস অ্যাভিনিউয়ে হাইকমিশন ভবনে কার্যালয় স্থাপন করেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান কর্নেল এম এ জি ওসমানীরও কার্যালয়সহ আবাসন ছিল এই ভবনে (তিনি চিরকুমার ছিলেন)। প্রত্যেকেই স্থানাভাবে ভুগছিলেন। আর প্রতিদিনই এই ভবন প্রাঙ্গণে ভিড় লেগে থাকত শত শত মানুষের, যাদের বেশির ভাগই দুর্বিষহ অবস্থার শিকার। হাইকমিশন ভবনে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হলেও ৮ নম্বর থিয়েটার রোড ভবনে কোনো পতাকা উত্তোলন করা হয়নি। কেননা ভারত ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বরের আগপর্যন্ত বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি।
...
জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে অনেকটা আকস্মিকভাবেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। বাংলাদেশ সরকারের অর্থসচিব খন্দকার আসাদুজ্জামান আমাকে তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। মাত্র পাঁচ মিনিটের ছোট্ট আলাপচারিতায় আমি উপলব্ধি করি যে তাজউদ্দীন অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ ব্যক্তিত্ব। তাঁর সামনে যে কঠিন দায়িত্ব, সে বিষয়ে তাঁর মনে কোনোই অস্পষ্টতা নেই। একইভাবে তিনি জানেন যে যুদ্ধে সহজে জয়লাভ করার কোনো উপায়ই নেই। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমি খুবই আনন্দিত হলাম। কাপ্তাই থেকে পালিয়ে আসার পর আবার উপলব্ধি করলাম, মুক্তিসংগ্রামে আমিও সম্পৃক্ত হয়েছি।
এর কয়েক দিন পর একটা কথা আমার কানে এল। আমি নাকি প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব হতে যাচ্ছি! আমার জন্য এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন ছিল। এ ধরনের কাজে আমি কখনোই সম্পৃক্ত ছিলাম না। তা ছাড়া প্রশাসন ক্যাডারের অভিজ্ঞ অনেক লোকই ছিলেন। সে ক্ষেত্রে আমাকে এই কাজের জন্য বিবেচনা করা নিতান্ত বেমানান। অন্তত খুবই বিরল ব্যাপার।
...
যেকোনো নির্বাসিত বা প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে অনেক সমস্যা মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। তাজউদ্দীন সাহেবকে বোধ হয় তার চেয়ে বেশি সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হওয়ায় পুরো যুদ্ধ সংগঠিত করা ও নেতৃত্ব দেওয়ার দায়দায়িত্ব তাঁর ওপর বর্তায়। প্রবাসের একটি শহর কলকাতায় বসে জনসমর্থন ব্যতীত অন্য কোনো সম্পদ ছাড়া দুই হাজার কিলোমিটার সীমান্তজুড়ে তাঁকে গেরিলাযুদ্ধ সংগঠিত করতে হচ্ছিল। আর এমন এক বাহিনীর বিরুদ্ধে এ যুদ্ধ করতে হচ্ছিল, যে বাহিনী অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত, প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ। প্রথম দিকে তো পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ ছিল অসম্ভব ব্যাপার। আর প্রতিটি পদক্ষেপে ভারত সরকারের সঙ্গে মতৈক্য ছিল অপরিহার্য। ভারতের দিক থেকেও বাংলাদেশের সমস্যাটি ছিল গুরুতর ও বহুমাত্রিক। ভারত নিজস্ব নিরাপত্তাঝুঁকির মধ্যে ছিল। আমেরিকা, চীন ও বেশির ভাগ মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতের বিপক্ষে অবস্থান নেয়।
...
বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও আওয়ামী লীগের এমএলএ কফিলউদ্দিন চৌধুরী ভগ্নস্বাস্থ্য ও বয়সের ভার নিয়েও সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। তাঁর পক্ষে দেশের ভেতরে থাকা কোনোভাবেই নিরাপদ ছিল না। তিনিও তাজউদ্দীনের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তিনি দ্রুত উপলব্ধি করলেন যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতার বিরোধ রয়েছে, যাঁরা কোনোভাবেই তাঁকে সহযোগিতা করছেন না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে চৌধুরী সাহেব হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন। কিন্তু তিনি হাসপাতালে বা ক্লিনিকে যেতে অস্বীকার করেন। তাই লিটন হোটেলে তাঁর কক্ষেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। তাতেই তিনি সেরে ওঠেন। তাঁর ছেলে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী ছিলেন একজন মেধাবী চিকিৎসক। তাঁর বাবার আগেই তিনি কলকাতায় আসেন ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁকে বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্যসচিব হিসেবে যোগ দেওয়ার জন্য বলা হয়েছিল। তবে বদরুদ্দোজা চৌধুরী তা করতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি স্বেচ্ছাসেবকের কাজে যোগ দেন।
ন্যাপের রাজনীতিক ও সাংবাদিক মঈদুল হাসান প্রধানমন্ত্রীর পুরোনো বন্ধু এবং তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। ভারত সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে মঈদুল হাসানের ভালো যোগাযোগ ছিল। ইন্দিরা গান্ধীর দুজন উপদেষ্টা পি এন হাকসার এবং ডি পি ধরের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ রক্ষা করতেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর লেখা মূলধারা ’৭১ বইটি একটি চমৎকার ও দালিলিক গ্রন্থ। ১৯৭১ সালে নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি এটি লিখেছেন। তাজউদ্দীনের আরেক বন্ধু কবি সিকান্দার আবু জাফর তরুণ বয়স থেকেই বিপ্লবী। হাঁপানি নিয়েই তিনি কলকাতায় গিয়েছিলেন। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। কলকাতায় তাঁর অবস্থান ছিল অনেকটাই নীরব।
দিনের বেলা অফিস চলার বেশির ভাগ সময়ই প্রধানমন্ত্রী ব্যস্ত থাকতেন তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীদের সঙ্গে সাংগঠনিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনায়। ফলে আমি দিনের নিয়মিত কাজ নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ কম পেতাম। সাধারণত দুপুরের খাবারের সময় কথাবার্তা হতো। আর সন্ধ্যার পরপর মাঝেমধ্যে আলাপ হতো। কখনো কখনো পুরোনো একটা অ্যাম্বাসেডর গাড়িতে চেপে প্রধানমন্ত্রী ও আমি কলকাতার ময়দানের ওপর দিয়ে গঙ্গার পাড়ে যেতাম। গাড়িতে বসেই তিনি গুরুতর পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতেন। প্রতিদিন যে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, এ জন্য তিনি মর্মাহত হতেন। বলতেন, ‘আর কত দিন আমরা এভাবে বয়ে বেড়াব? কত দিন আমাদের ছেলেরা প্রাণ হারাবে? আমি তো কোনো দ্রুত সমাধান দেখছি না। আরও অনেক প্রাণহানি হবে। বাংলাদেশের ভেতরের অবস্থা তো খুবই খারাপ। আমি সত্যিই জানি না, কত দিন এ রকম চলবে।’ তিনি অবশ্য প্রায়ই বিড়বিড় করে নিজের মনে কথা বলতেন। তাঁর দুঃখভারাক্রান্ত মনকে সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো ভাষা বা উপায় আমার জানা ছিল না। তবে অন্যদের মতো আমিও তাঁর অনুভূতি ও বেদনার শরিক ছিলাম। আমার পরিবার, আমার প্রায় সব আত্মীয়স্বজন এবং সাড়ে ছয় কোটি বাঙালি বাংলাদেশের ভেতর ইয়াহিয়ার নির্যাতন-শিবিরে বন্দী। প্রতিমুহূর্তে তারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা ও বর্বরতার মুখোমুখি হচ্ছে।
...
বিদেশ থেকে বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছিলেন, যেমনটা এ রকম ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ভারতের সমাজতান্ত্রিক নেতা জে পি নারায়ণ, নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বি পি কৈরালা এবং হেলসিংকিভিত্তিক সোভিয়েত ইউনিয়ন-সমর্থিত ওয়ার্ল্ড পিস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান রমেশ চন্দ্র। সৌজন্য সাক্ষাৎ করে তাঁরা আমাদের মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন। আমার অবশ্য মনে হয়েছিল, এ রকম গুরুত্বপূর্ণ দর্শনার্থীরা একটি নির্বাসিত সরকারের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলেন। হয়তো দেশে ফিরে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবকে বলেছেন, কলকাতা শহরের ব্যস্ত এলাকায় একটি স্বাধীনতাসংগ্রামে লিপ্ত সরকারের কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে। এর চেয়ে জঙ্গলে কোনো গোপন স্থানে সাক্ষাৎ হলে তাঁরা হয়তো এ রকম অনুভূতি নিয়ে ফিরতেন যে তাঁরা ফিদেল কাস্ত্রোর মতো কোনো সত্যিকারের বিপ্লবীর সঙ্গে দেখা করেছেন। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে তা সম্ভব ছিল না। সীমান্ত এলাকায় জঙ্গলের ভেতরে গোপন সরকারের ঘাঁটি স্থাপনের কোনো জুতসই জায়গা ছিল না, যেখান থেকে সরকার পরিচালনা করা যায়। থিয়েটার রোডের কার্যালয়ের নিরাপত্তাও তেমন ছিল না। বস্তুত, আমাদের অনেকেই চেয়েছেন যে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের ভেতরে গোপন কোনো স্থান থেকে সরকার পরিচালনা করুন। তবে এতে কোনোই সন্দেহ নেই যে মুজিবনগর সরকার একটি বিপ্লবী সরকার ছিল। তাজউদ্দীন নিজে এবং আমরা অনেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিয়ে এসে আবার একত্র হয়েছি এবং বিপ্লবে যোগ দিয়েছি। এটা ছিল আমাদের জন্য একধরনের লংমার্চ। তাজউদ্দীনের তরুণ ভক্ত ও গুণগ্রাহীরা তো তাঁর নাম দিয়েছিল ‘তাও’ (সে-তুং)।
...
বাংলাদেশ যে স্বাধীন হবে, সে বিষয়ে তাজউদ্দীন আহমদ বিশ্বাসী ছিলেন। তবে দেশ কতটা বাসযোগ্য হবে, সে নিয়ে তাঁর সন্দেহ ছিল। তিনি যখন বিষণ্ন থাকতেন, তখন মাঝেমধ্যেই আমাকে বলতেন, ‘আমি জানি না, তুমি দেশে বাস করতে পারবে কি না।’ আমি তাঁকে বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু তাতে সফল হইনি। ‘তুমি দেখে নিয়ো’ বলেছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে তিনি যেভাবে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন, আসলেই সেটা খুব কঠিন কাজ ছিল। চার দশক পর দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেক বাঙালিকে একই মনোভাব পোষণ করতে দেখি। তাদের এই মনোভাবের কারণ হয়তো ভিন্ন।
তবে প্রধানমন্ত্রীর সবচেয়ে বড় হুমকি ছিলেন শেখ মুজিবের ভাগনে শেখ ফজলুল হক মনি। বয়সে তরুণ হলেও তিনি অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী ছিলেন। তিনি মনে করতেন, বঙ্গবন্ধুর ভাগনে হিসেবে নির্বাসিত সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার অধিকার কেবল তাঁরই আছে। মনি অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রীর জীবনের ওপর হুমকি তৈরি করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রাণনাশের জন্য একজন সশস্ত্র তরুণকে পাঠানো হয়েছিল। সে অবশ্য এসে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ মনির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে অস্বীকৃতি জানান। শেখ মনি তাঁর সহযোগীদের নিয়ে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের (র) সহায়তায় গঠন করেন বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট (বিএলএফ)। তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে ছিলেন তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক এবং সিরাজুল আলম খান, যাঁকে একজন মার্ক্সীয় তাত্ত্বিক বলা হয়। এর মানে কী, আমি ঠিক জানি না। একধরনের রহস্যময় ব্যক্তিত্বের অধিকারী সিরাজুল আলম ‘কাপালিক’ নামে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছিলেন (কাপালিক মানে হলো হিন্দুধর্মের বিশেষ কোনো দেবীর বিশেষ পূজারি)। তাঁকে অনেকে বলতেন ‘রাসপুতিন’ (রাশিয়ার জারের শাসনামলে জেরিনা আলেকজান্দ্রার ওপর শয়তানি শক্তির প্রভাব বিস্তারকারী আধ্যাত্মিক সাধক)।
বিএলএফ পরিচিত হয়েছিল ‘মুজিব বাহিনী’ নামে। মুক্তিবাহিনীর চেয়ে অনেক ভালোভাবে প্রশিক্ষিত ও অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করা হয়েছিল এই বাহিনীর সদস্যদের। অনেক সময়ই মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়েছে। আমাদের কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে, ‘র’ এই মুজিব বাহিনী গঠন করেছিল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশে বামপন্থী শক্তির উত্থান ঠেকাতে। তাজউদ্দীন সাহেবের ধারণা ছিল, সিরাজুল আলম খানের মাধ্যমে তিনি মুজিব বাহিনীর নেতাদের কিছুটা সংযত করতে পারবেন। আর তাই তাঁর সঙ্গে গোপনে সাক্ষাৎ করতে চান, যেন মুজিব বাহিনীর অন্যরা সেটা জানতে না পারে। আমি জানি না, কীভাবে এই বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছিল। তবে এক রোববার থিয়েটার রোডে সিরাজুল আসেন। প্রধানমন্ত্রীর কক্ষে দুজনের দীর্ঘ আলোচনা হয়। তাঁরা যখন কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন, তখন মনে হলো যে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। এমনকি সিরাজুল যখন ভবন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন, তখনো নিচু স্বরে দুজন কথা বলছিলেন। সেখানে একমাত্র তৃতীয় ব্যক্তি ছিলাম আমি। তবে তাঁদের দুজনের কথাবার্তার গোপনীয়তা যেন লঙ্ঘিত না হয়, সে জন্য দূরে দূরে ছিলাম। এরপর তাঁর বিশাল ছাতাটা মেলে ধরে সিরাজুল বেরিয়ে গেলেন। বাইরে তখন বৃষ্টি খানিকটা ধরে এসেছে। আমি তাঁদের আলোচনার সারবস্তু জানতে পারিনি। তবে প্রধানমন্ত্রীর স্বস্তিদায়ক ভঙ্গি থেকে নিজের মতো উপসংহার টেনেছিলাম।
ভারত সরকারের সহযোগিতায় বিএলএফের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারকে অনেক সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গঠিত ‘রক্ষীবাহিনী’র বীজ রোপণ করা হয়েছিল বিএলএফের মাধ্যমেই। বহুল বিতর্কিত রক্ষীবাহিনী তার নিষ্ঠুরতার জন্য আজও কুখ্যাত হয়ে আছে। এটা আমাদের ইতিহাসের একটি দুঃখজনক অধ্যায়। এই ক্ষত সারতে অনেক সময় লাগবে।...
ফারুক আজিজ খান মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একান্ত সচিব ও বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান।