আইন–আদালতও কেন পরিবেশদূষণ থামাতে পারছে না

পরিবেশ রক্ষায় দেশে একাধিক আইন রয়েছে, রয়েছে পরিবেশ আদালতও। তারপরও কেন পরিবেশদূষণ কমছে না? এই লেখায় সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন মোহাম্মদ গোলাম সারোয়ার

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকগুলোতে যে কয়টি খবর নিত্যদিন প্রকাশিত হয়, তার মধ্যে পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি–সংক্রান্ত খবর অন্যতম। পত্রিকা খুললেই নিয়মিত বায়ুদূষণে ঢাকার শীর্ষস্থান ধরে রাখার খবর পাওয়া যায়। এ ছাড়া নদীনালা–খাল দূষণ ও দখল, জলাভূমি ভরাট, পাহাড় কাটা, গাছ ও বন উজাড় করার খবর নিয়মিতভাবে দেখা যায়। জলবায়ুসংকটে অত্যন্ত ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি দেশ বাংলাদেশ। এরপরও যেভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংস করা হচ্ছে, তা অকল্পনীয় ও অত্যন্ত উদ্বেগের।

বৈশ্বিক পরিবেশ সূচক (এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেক্স-ইপিআই) ২০২২ প্রতিবেদনে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৭তম। বৈশ্বিক বায়ুমান প্রতিবেদন (আইকিউ এয়ার) ২০২৩ অনুসারে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এ ছাড়া শব্দদূষণ ও নদী/পানিদূষণের চিত্রও ভয়াবহ। গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, দখল, দূষণ, উপকূলীয় বাঁধ ও অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণের ফলে গত ৫৭ বছরে ১৫৮টি নদী শুকিয়ে গেছে বা বিলুপ্তির পথে রয়েছে। (প্রথম আলো, ১৫ মার্চ ২০২০)

রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের গবেষণা অনুযায়ী, দেশের ৫৬টি নদী অতিমাত্রায় দূষণের শিকার, যার বেশির ভাগই শিল্পকারখানার বর্জ্য থেকে নির্গত দূষণ। দেশের ২২৯টি নদী দখল ও দূষণের কবলে পড়ে সংকটাপন্ন অবস্থায় পৌঁছে গেছে। (প্রথম আলো, ২৬ মে ২০২৪) 

পরিবেশদূষণের প্রভাব ও ক্ষতি

পরিবেশদূষণের বহুমাত্রিক প্রভাব রয়েছে। বায়ুদূষণের কথাই ধরা যাক। ঢাকার প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণার (পিএম ২.৫) উপস্থিতি রয়েছে ৭৯ দশমিক ৯ মাইক্রোগ্রাম, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বেঁধে দেওয়া মানদণ্ডের চেয়ে ১৬ গুণ বেশি। সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে, ঢাকার বাতাসে ক্যানসার সৃষ্টিকারী আর্সেনিক সিসা ও ক্যাডমিয়ামের পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মাত্রার প্রায় দ্বিগুণ। (দ্য ডেইলি স্টার, ১১ মে ২০২৪)

বায়ুদূষণের সবচেয়ে ভয়াবহ দিকটি হলো দূষিত বায়ুতে থাকার কারণে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় সাত বছর কমে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বায়ুদূষণসহ অন্যান্য পরিবেশদূষণে বছরে ২ লাখ ৭২ হাজার মানুষের অকালমৃত্যু হচ্ছে। পরিবেশদূষণের স্বাস্থ্যগত, প্রকৃতিগত ও সামাজিক ক্ষতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক ক্ষতিও কম নয়।

পরিবেশ রক্ষা সাংবিধানিক দায়িত্ব

দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৮ ক অনুযায়ী বাংলাদেশ রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্য প্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দায়বদ্ধ। তবে এই অনুচ্ছেদ সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এবং সুস্থ ও নিরাপদ পরিবেশের অধিকার মৌলিক অধিকার হিসেবে সরাসরি স্বীকৃত না হওয়ায় এটি বিচারিকভাবে বলবৎযোগ্য (জুডিশিয়াল এনফোর্সেবল) নয়। তবে উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী সংবিধানের ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত জীবনের অধিকারের মধ্যে সুস্থ ও নিরাপদ পরিবেশের অধিকারও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

■ দূষিত বাতাসে বসবাসের কারণে মানুষের গড় আয়ু কমে যাওয়ার বিষয়টি সুস্থ ও নিরাপদ পরিবেশে বাঁচার অধিকারকে লঙ্ঘন করে বলে বিবেচিত হতে পারে। 

■ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনটিতে এমন কিছু ত্রুটি ও অসংগতি রয়েছে, যা এই আইনের যথাযথ বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।

বাংলাদেশের আইনের ইতিহাসে বিখ্যাত একটি মামলার (ড. মহিউদ্দিন ফারুক বনাম বাংলাদেশ, ৪৯ ডিএলআর এডি ১৯৯৭) রায় অনুযায়ী, বায়ু ও পানিদূষণমুক্ত ভারসাম্যপূর্ণ ও নিরাপদ পরিবেশের অধিকার ও একটি মৌলিক অধিকার, যা ছাড়া জীবনের অধিকারকে পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এই রায়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ঢাকার দূষিত বাতাসে বসবাসের কারণে মানুষের গড় আয়ু কমে যাওয়ার বিষয়টি সুস্থ ও নিরাপদ পরিবেশে বাঁচার অধিকারকে লঙ্ঘন করে বলে বিবেচিত হতে পারে। এ জন্য রাষ্ট্রকে আইনিভাবে জবাবদিহির আওতায় আনার সুযোগ রয়েছে।

আইন যখন পরিবেশের ক্ষতিকে অনুমোদন দেয়

পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের বিভিন্ন ধারা বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হয় যে আইনটি সক্রিয় (প্রো–অ্যাকটিভ) ব্যবস্থা বা পদক্ষেপের চেয়ে বেশি (রি–অ্যাকটিভ) প্রতিক্রিয়াশীল ও নিয়ন্ত্রণমূলক। আইনে পরিবেশ অধিদপ্তরকে যে অবারিত ক্ষমতা ও এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে, তাতে পরিবেশের অবক্ষয় ও দূষণ ঠেকিয়ে সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে আইনটিতে ‘ইনজুরি থেরাপি’ মডেলের প্রতিফলন রয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পরিবেশের ক্ষতি ঠেকাতে একদিকে যেমন পাহাড় কাটা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, অন্যদিকে জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে পাহাড় কাটার অনুমতির বিধানও রাখা হয়েছে আইনটিতে। এ ছাড়া জলাধার (নদী, খালবিল, হাওর) ভরাটকে একদিকে নিষিদ্ধ করে, অন্যদিকে জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে জলাধার ভরাটের অনুমতির বিধান রয়েছে। (ধারা ৬: খ, ঙ)

জাতীয় স্বার্থ বলতে কী বোঝায় তার কোনো সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা এ আইনে দেওয়া নেই। স্বভাবতই জাতীয় স্বার্থ শব্দ দুটি এত বিস্তৃত ও অস্পষ্ট হওয়ার কারণে পক্ষপাতদুষ্ট ও খেয়ালখুশিমতো ব্যাখ্যার অবকাশ রয়েছে। এর ফলে আইনের অপব্যবহার নয়, বরং আইনসিদ্ধভাবেই জলাধার ভরাট বা পাহাড় কাটার মতো অপরাধ করার সুযোগ রয়েছে। সড়ক–মহাসড়ক বিস্তৃত করার নামে হাজার হাজার গাছ কাটার ঘটনাও তেমন একটি বিষয়।

সর্বোচ্চ আদালত বাংলাদেশের নদ–নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। একই সঙ্গে দেশের সব নদ–নদী দূষণ ও দখলমুক্ত করে সুরক্ষা, সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য নদী রক্ষা কমিশনকে আইনগত অভিভাবক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তাই পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের জাতীয় স্বার্থে জলাধার ভরাট ও পাহাড় কাটার বিধানটি উচ্চ আদালতের রায়ের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। যেহেতু জলাধার (নদী) একটি আইনি সত্তা, তাই জাতীয় স্বার্থের দোহাই দিয়ে তার ক্ষতি বা দখল করা আদালতের রায়ের লঙ্ঘন।

কর্তৃপক্ষের জবাবদিহির অভাব 

পরিবেশ আইনে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে পরিবেশের ক্ষতি ও দূষণ ঠেকাতে এবং পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য একটি দীর্ঘ কার্যতালিকা বাস্তবায়নের জন্য অবারিত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে জবাবদিহিমূলক কোনো বিধান রাখা হয়নি। অর্থাৎ পরিবেশের ক্ষতি ও দূষণ ঠেকাতে মহাপরিচালক যদি ব্যর্থ হন বা অবহেলা করেন, তাহলে তার জবাবদিহির কোনো বিধান আইনে রাখা হয়নি। এই আইন বাস্তবায়নে সরল বিশ্বাসে গৃহীত সব কার্যক্রমের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। সরল বিশ্বাসে গৃহীত কাজের কোনো ব্যাখ্যা না থাকায় পরিবেশদূষণ–সংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও সুরক্ষা এই বিধানের আওতায় এনে দায়মুক্তির অবকাশ রয়েছে।

পরিবেশ আদালতের সীমিত এখতিয়ার 

পরিবেশ আদালত আইন অনুযায়ী, পরিবেশ আদালতের এখতিয়ার হচ্ছে, পরিবেশ আইনে বর্ণিত অপরাধের বিচার নিশ্চিত করা। এখানে পরিবেশ আইন বলতে বোঝাবে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫; পরিবেশ আদালত আইন, ২০১০; এবং সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা নির্ধারিত অন্য কোনো আইন ও বিধিমালা।

উল্লেখ্য, অদ্যাবধি বাংলাদেশ সরকার উপরিউক্ত দুটি আইন ছাড়া শুধু ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপনকে (নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৩) সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা পরিবেশ আইন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তার মানে দাঁড়াল পরিবেশসংক্রান্ত অন্যান্য বিষয় যেমন বন, জীববৈচিত্র্য, বন্য প্রাণী, পানি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদসংক্রান্ত অপরাধের বিচার করার এখতিয়ার পরিবেশ আদালতের নেই। এর ফলে পরিবেশগত অপরাধের বিচার বিশেষায়িত পরিবেশ আদালতে না হয়ে অন্য সাধারণ আদালতে হচ্ছে, যা পরিবেশগত ন্যায়বিচারের পথে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা।

সরাসরি আদালতে মামলা করতে না পারা

পরিবেশ আদালত আইন অনুযায়ী, পরিবেশগত অপরাধের বিচার ও প্রতিকার চেয়ে সাধারণ মানুষ বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি সরাসরি আদালতে মামলা করতে পারেন না। এ–সংক্রান্ত মামলার এখতিয়ার পরিবেশ অধিদপ্তরকে দেওয়া হয়েছে।

ভুক্তভোগী ব্যক্তি প্রথমে পরিবেশ অধিদপ্তরে অভিযোগ দায়ের করবেন, এরপর অধিদপ্তরের একজন পরিদর্শক সেটি অনুসন্ধান করে তাঁর তদন্ত প্রতিবেদন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাবেন। এরপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে মামলা দায়েরের প্রয়োজন রয়েছে কি না।

বিচারিক কার্যক্রম বা পরিবেশ আদালতে সরাসরি মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে শর্ত আরোপ করে যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে, তা আইনিভাবে মানুষকে আদালতে প্রবেশাধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। পরিবেশ আদালতের সীমিত এখতিয়ার, পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রশাসনিক জটিলতা, অদক্ষতা ও দীর্ঘসূত্রতা পরিবেশ আদালতের যথাযথ ও আশানুরূপ কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

এর ফলে পরিবেশসংক্রান্ত অনাচার ও অপরাধের বেশির ভাগ ঘটনা বিচারিক কার্যক্রমের বাইরে থেকে যাচ্ছে। এ কারণে পরিবেশদূষণের বহু ঘটনা ঘটলেও পরিবেশ আদালতে মামলার সংখ্যা খুবই কম। এ থেকে স্পষ্ট, পরিবেশদূষণ–সংক্রান্ত অনেক অপরাধ সংঘটিত হলেও তার বেশির ভাগই প্রতিকারহীন থেকে যাচ্ছে।

জনবল, আর্থিক সংকটসহ আরও বিভিন্ন কারণে পরিবেশ অধিদপ্তরও প্রয়োজন অনুযায়ী মামলা করতে পারে না অথবা আগ্রহ দেখায় না। তবে পরিবেশ অধিদপ্তর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় বেশি আগ্রহী। ভ্রাম্যমাণ আদালতের এখতিয়ার সীমিত হওয়ায় কঠোর সাজা নিশ্চিত করা যায় না। কিছু মামলায় সাজা ও জরিমানা করা হলেও দূষণকারীদের বড় অংশ আপিল করে ছাড় পেয়ে যায়। 

বাংলাদেশ আইন কমিশনের একটি প্রতিবেদনে জানা যায়, ভ্রাম্যমাণ আদালতের ৯৮ শতাংশ মামলার রায় বিচারিক আপিল আদালত কর্তৃক বাতিল হয়ে যায়। আপাতদৃষ্টিতে ছোটখাটো বিষয়ের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কিছুটা ভূমিকা থাকলেও পরিবেশদূষণ ও জলাধার ভরাটের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাঘববোয়ালরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন।

পরিবেশগত আইনের শাসন

জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা (ইউএনইপি) কর্তৃক প্রকাশিত পরিবেশগত আইনের শাসন–সংক্রান্ত প্রথম বৈশ্বিক প্রতিবেদন (২০১৯) অনুযায়ী, পৃথিবীর যে কয়টি দেশে প্রচুর আইন রয়েছে কিন্তু বাস্তবায়ন খুবই কম, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ইউএনইপির প্রতিবেদনটিতে পরিবেশ আইনের অবাধ লঙ্ঘন ঠেকাতে ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আইনের কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পরিবেশগত আইনের শাসন ধারণাটির সংজ্ঞা ও একটি কাঠামো উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে যে মূল বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে:

এক. ন্যায্য, স্পষ্ট ও বাস্তবায়নযোগ্য পরিবেশ আইন। আইনকে অবশ্যই মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হতে হবে। আইন তৈরি ও এর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে ন্যায্যতার সঙ্গে ও বৈষম্যহীনভাবে। পরিবেশ আইনের ভাষা সাধারণ মানুষের কাছে বোধগম্য, স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন হতে হবে।

দুই. পরিবেশ–সংক্রান্ত তথ্যে প্রবেশাধিকার, আইন তৈরিতে সাধারণ জনগণ ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর স্বতঃস্ফূর্ত ও কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ এবং সর্বোপরি পরিবেশগত ন্যায়বিচারে বাধাহীন প্রবেশাধিকার নিশ্চিতকরণ, যা জনগণের পরিবেশের অধিকার বাস্তবায়ন ও পরিবেশগত অপরাধের বিচার ও প্রতিকার নিশ্চিত করবে।

তিন. পরিবেশ আইন বাস্তবায়নকারী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য, স্বচ্ছতা, একাগ্রতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। 

পরিবেশগত আইনের শাসন কেন জরুরি 

পরিবেশগত আইনের শাসনকাঠামোর মূল উপাদানগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের পরিবেশ আইন সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বাংলাদেশের পরিবেশ আইনের বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে, আইনের অস্পষ্টতা ও অসংগতিপূর্ণ বিধান, বাস্তবায়নকারী প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের জবাবদিহির অভাব, পরিবেশগত ন্যায়বিচারে আইনি ও প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতা, আইন তৈরি ও বাস্তবায়নে স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও সাধারণ জনগণের সম্পৃক্ততার অভাব, পরিবেশসংক্রান্ত বিভিন্ন আইনের মধ্যে অসামঞ্জস্যতা ও সমন্বয়হীনতা, বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষের প্রতি জনগণের আস্থাহীনতা ইত্যাদি। 

এই ত্রুটি ও অসংগতিগুলো শুধু পরিবেশ আইন বাস্তবায়নেই প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে না, বরং পরিবেশগত আইনের শাসনকে লঙ্ঘন করছে। পরিবেশ নিয়ে যে সীমাহীন অনাচার, অবাধ দূষণ ও অপরাধ হচ্ছে, তা ঠেকানোর জন্য পরিবেশগত আইনের শাসনকাঠামোর আলোকে পরিবেশ আইনের সংস্কার প্রয়োজন। এটি অনস্বীকার্য যে পরিবেশ আইনের প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে ব্যর্থতা শুধু পরিবেশগত উন্নয়নকেই বাধাগ্রস্ত করে না, বরং একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি টেকসইসহ ন্যায়ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিতের পথে বড় অন্তরায়।

মোহাম্মদ গোলাম সারোয়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক। বর্তমানে যুক্তরাজ্য সরকারের কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে সোয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ে জলবায়ু আইন ও বিকল্প উন্নয়ন বিষয়ে পিএইচডি গবেষণা করছেন।