ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) স্নাতকোত্তরে তাদের নিয়মিত শিক্ষার্থী ছাড়াও অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে আসা শিক্ষার্থীদের ভর্তির সুযোগ দিচ্ছে—এমন একটি নীতিমালা গ্রহণ করেছে। ঘোষিত নীতিমালা অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অধীনে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে স্নাতক পাস করারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোতে তাদের নিয়মিত শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার পর আসন ফাঁকা সাপেক্ষে ‘ভর্তি পরীক্ষার’ মাধ্যমে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাবেন। শুধু তা–ই নয়, আগে যখন নিজ বিভাগে নিয়মিত স্নাতকোত্তর করার বাইরে অন্য কোনো বিভাগে পড়াশোনার সুযোগ পেতেন না, এখন থেকে তাঁরা ইচ্ছা করলে কেবল স্নাতকোত্তরের জন্য বিভাগ পরিবর্তন করতে পারছেন বলে গণমাধ্যমে ভাষ্য দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
নিঃসন্দেহে এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। দেশের বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মটি অনেক দিন ধরে চলে এলেও আমাদের দেশে এটি অধরা ছিল। এ উদ্যোগের ফলে ঢাবির বাইরে পাবলিক কিংবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক শেষ করা একজন শিক্ষার্থীর বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়ার আক্ষেপ দূর হবে। তেমনি আন্তবিভাগীয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞানের নতুন মাত্রা তৈরি হবে। আঞ্চলিক সংস্কৃতিরও আদান-প্রদান ঘটবে। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ বিভাগগুলোর পড়াশোনায় কিছুটা বৈচিত্র্য মিলবে।
শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এমন শিক্ষার্থীহিতৈষী সিদ্ধান্ত আমাদের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে হওয়া উচিত। যদিও সন্ধ্যাকালীন কোর্স নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থীর বাইরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্যিক কোর্স চালু রয়েছে, তবে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্নাতকোত্তরের সুযোগ তৈরি করা সময়ের ব্যাপারমাত্র।
আপনি যদি হাভার্ড, অক্সফোর্ড, ক্যালটেক, ক্যালিফোর্নিয়া কিংবা টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রোফাইলের দিকে তাকান তাহলে দেখবেন, তাঁদের সিংহভাগই শিক্ষক হয়েছেন যাঁরা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগই পাননি। অধিকাংশই এসেছেন র্যাংকিং তলানিতে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিংবা সেই দেশের বাইরের কোনো অখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। অথচ তাঁরা নির্বিঘ্নে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিজেদের সেরাটা দিয়ে পাঠদান করে যাচ্ছেন, গবেষণায় বড় অবদান রেখে চলেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকোত্তরে এমন প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করলেও কয়েক দশক ধরে বিশ্ববিদ্যালয়টি তাদের শিক্ষক নিয়োগে তেমন কোনো কল্যাণমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেনি। বলতে গেলে, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদধারী ছাড়া দেশের অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করাদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ করেছে। যদিও প্রতিটি শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ‘বাংলাদেশি নাগরিকদের কাছ থেকে আবেদনপত্র আহ্বান’ করা যাচ্ছে বলে উল্লেখ করা হলেও এ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা পড়াশোনা করার সুযোগ পাননি, তাঁরা যদি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে সেরাও হয়ে থাকেন, তাহলেও তাঁদের শিক্ষক হওয়ার দৃশ্যমান উদাহরণ আমাদের কাছে নেই।
যদিও বিশ্ববিদ্যালয় কখনো বলে না যে অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঠ চুকিয়ে আসা প্রতিদ্বন্দ্বীরা আবেদন করবেন না, তবে কালের বিবর্তনে অনেকটাই রেওয়াজ হয়ে গেছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে হলে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরধারী হতে হবে এবং তাঁরাই কেবল আবেদন করে প্রতিযোগিতায় লড়ছেন।
শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, বুয়েট অনেকটাই একই কৌশলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে আসছে। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে নিজ ঘরের সন্তানই সেরা, তাঁরা ছাড়া অধীনস্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্তানেরা যোগ্য নয়। যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করারা দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকেন। তবে রংপুর, পাবনা, বরিশাল, শাহজালাল কিংবা নোয়াখালীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে পাস করারা বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করার সাহসই রাখেন না। এমনকি কেউ যদি আবেদনও করেন, তাঁদের প্রধান ওই পাঁচ থেকে ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়া দিবা স্বপ্নের মতো মনে হবে।
দশকের পর দশক ধরে এই শিক্ষক নিয়োগে মোড়ল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিষয়টিকে ঢাল করে আসছে। যার কারণে শিক্ষকদের মধ্য আন্তসাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য তৈরি হয় না। এমনকি জ্ঞান সৃষ্টি বা বিতরণেও সেটা হচ্ছে না। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে ধারণা এগিয়ে যাওয়ার কথা, তা থেকে আমরা অনেকটাই দূরত্ব তৈরি করে দিয়েছি।
বিশ্বের সব বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিক্ষক নিয়োগে যোগ্যতা নিরূপণে বিচিত্রতায় গুরুত্ব দেয়। কে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল, কে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিংবা র্যাংকিংয়ের তলানিতে রইল, সেটি কখনোই তাদের বিবেচ্য নয়। বরং দেখা যাচ্ছে, নিউরোসায়েন্সে নিয়োগ পাচ্ছেন গণিতের লোক, রসায়নের পদার্থবিদ্যার ছেলেরা। আবার রসায়নে নিয়োগ পাচ্ছেন পরিসংখ্যান, বায়োলজি কিংবা ফার্মাসি পাস করারা। এর মূল কারণ, যে বিভাগে যত বৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকা থেকে শিক্ষকেরা আসবেন, সেই বিভাগ জ্ঞানের বিস্তারে তত বেশি বিস্তর হবে, তত বেশি এগিয়ে যাবে।
আপনি যদি হাভার্ড, অক্সফোর্ড, ক্যালটেক, ক্যালিফোর্নিয়া কিংবা টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রোফাইলের দিকে তাকান তাহলে দেখবেন, তাঁদের সিংহভাগই শিক্ষক হয়েছেন যাঁরা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগই পাননি। অধিকাংশই এসেছেন র্যাংকিং তলানিতে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিংবা সেই দেশের বাইরের কোনো অখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। অথচ তাঁরা নির্বিঘ্নে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিজেদের সেরাটা দিয়ে পাঠদান করে যাচ্ছেন, গবেষণায় বড় অবদান রেখে চলেছেন।
কারণ, তাঁদের নিয়োগকর্তারা খুব ভালো করে জানেন, জন্ম হোক যথা তথা, কর্ম হোক ভালো। আপনি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাননি বিধায় আপনার মেধার বিকাশ হবে না, আপনি আপনার স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেননি বলে আপনি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে পারবেন না, তা তো হতে পারে না। আপনার মেধা ও শ্রম যদি আপনাকে সেই পথ তৈরি করে দেয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাঁদের যোগ্যতার মূল্যায়ন করতে ভুল করে না। আর যে কারণে আমাদের দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার সুযোগ হয় না, তখন তাঁরাই দেশের বাইরে পড়াশোনা শেষে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকতার সুযোগ পাচ্ছেন, গবেষণায় সেরাটা দিয়ে যাচ্ছেন।
হ্যাঁ, এ কথা সত্য, দেশের বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে যেসব যোগ্যতা দেখা হয়, সেগুলো আমাদের দেশে অনুসরণ করা হয় না। যেটিকে বাইরের দেশ যোগ্যতার শীর্ষ রাখে, সেটি আমাদের দেশে ‘অতিরিক্ত যোগ্যতা’ হিসেবে দেখা হয়। তাই এ দেশে শিক্ষক নিয়োগের যে অমসৃণ পথ অনুসৃত হচ্ছে, তার প্রেক্ষাপটে ১৯৭৩ অ্যাক্টে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাড়া অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েদের যোগ্য মনে করছে না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভাগগুলোতে অঘোষিত নিয়ম বিরাজ করছে যে এই বিভাগ থেকে পাস করে বের হলে সেখানে শিক্ষক হওয়ার সুযোগ মিলবে। সহকর্মী হিসেবে এমন শিক্ষার্থীদেরই তাঁরা বেছে নিচ্ছেন। যোগ্যতার প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকলেও কেবল ‘নিজ বিভাগের’ ছাত্র/ছাত্রী বিবেচনায় অতিরিক্ত সুবিধা পেয়ে যাচ্ছেন। আর এভাবে শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ করা যায় না। পূর্বপরিচিত মুখের অছিলায় অপরিচিত মুখগুলো হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আইন পরিপন্থী কাজ।
একটি দেশের শিক্ষার মান কতটা এগিয়ে গেল, সেটি বোঝার জন্য কেউ যদি আমাদের শিক্ষক নিয়োগের এ প্যারামিটার হিসেবে ব্যবহার করতে চান, তাহলে সেটিকে আপনি কিছুতেই অস্বীকার করতে পারবেন না। একই সিলেবাসে রংপুরের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর স্নাতকোত্তরের সনদ যদি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয় তখন বুঝে নিতে হয়, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়োগকর্তাদের একধরনের অহম আছে, যা বৈচিত্র্যময় নিয়োগব্যবস্থার পরিপন্থী।
এখন যদি কেউ বলেন, কেন আমাদের শিক্ষক নিয়োগে বৈচিত্র্য প্রয়োজন? কেন প্রান্তিক অঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আনা প্রয়োজন? আদৌও কি সেটি আমাদের শিক্ষার মান বাড়াবে?
এসব প্রশ্নের সহজ উত্তর, আপনি যদি প্রকৃতপক্ষে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন চান, আপনি যদি সত্যি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিশ্ব র্যাঙ্কিং এগিয়ে নিতে চান, তাহলে অবশ্যই আমাদের প্রচলিত শিক্ষক নিয়োগব্যবস্থার পরিবর্তন আনতে হবে। কারণ, একজন ডাইভার্স ফ্যাকাল্টি সদস্য সর্বব্যাপী শিক্ষার ন্যায্য পরিবেশ তৈরিতে বড় সহায়ক হিসেবে কাজ করে। এতে করে শ্রেণিকক্ষে ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত থেকে যেমন বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ মেলে, নতুন নতুন আইডিয়ার বিচার–বিশ্লেষণের সুযোগ মেলে, তেমনি ভিন্ন ধারার গবেষণায় সক্রিয় ভূমিকা রাখে।
আঞ্চলিক বর্ণবাদ ও বৈষম্য আমাদের এগিয়ে যেতে বাধা দেয়, সেটি বোঝার শক্তি আমাদের থাকা উচিত। মনে রাখা উচিত, রাষ্ট্রের সংবিধান সবাইকে সমান অধিকারের কথা বলে। রাষ্ট্র বৈষম্যহীনতার স্বপ্ন দেখে। সেটি যদি আমরা উচ্চশিক্ষায় জিইয়ে রাখি, তাহলে আমাদের গুণগত শিক্ষার মান বাড়বে না, আমাদের মেধা বিকাশের পথ সংকুচিত হয়ে পড়বে।
আমরা চাই, এ সমস্যা দূর হোক। এটি নিঃসন্দেহে একধরনের বর্ণবাদ। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিযোগের ক্ষেত্রে এ বর্ণবাদ দূর হোক। আর সেটির জন্য প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে অন্তত ৩০ শতাংশ সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকুক। এর ফলে নিয়োগে স্বজনপ্রীতি যেমন কমবে, তেমনি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পড়াশোনা করে আসা ছেলে-মেয়েরা কোনো রকম বৈষম্য ছাড়ায় বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাবেন। তাঁদের মধ্যে লেখাপড়ার প্রতিযোগিতাও থাকবে। ফলে তাঁদের জ্ঞানের নতুন নতুন সমাবেশ ঘটবে, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ঘটবে আর সেখান থেকে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে। শিক্ষক নিয়োগে আমাদের নিয়োগকর্তাদের মনের অন্ধত্ব ঘুচুক, শিক্ষার আলোয় আলোকিত হোক আমাদের বাংলাদেশ।
ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়।
ই–মেইল: nadim.ru@gmail.com