৭ অক্টোবর রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের ৭০তম জন্মবার্ষিকী গেল। বেশি আনন্দদায়ক ছিল না এবার দিনটি তাঁর জন্য। ওই দিনই ক্রিমিয়ার একটা বিখ্যাত সেতু নাশকতার শিকার হয়। ২০১৮ সালে সেতুটি তিনি ধুমধামের সঙ্গে উদ্বোধন করেছিলেন দখলকৃত অঞ্চলটি রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করতে।
তবে ১৯৯৯ থেকে ২৩ বছর ধরে প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি জন্মদিন উদ্যাপন করছেন। নিন্দুকেরা যতই স্বৈরশাসক বলুক, এটা ব্যক্তিগত সফলতার দিক অবশ্যই।
১৯৯৯ সালের জন্মবার্ষিকী উদ্যাপনের সঙ্গে এবারের একটা বড় মিল—সে সময় রাশিয়ায় কেউ ভাবতে পারেনি সাধারণ এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা দুই যুগ ধরে তাদের একচেটিয়া ভাগ্যবিধাতা হয়ে থাকবেন। এবারও রাশিয়ার মানুষ বুঝতে পারছে না, পুতিনের পরবর্তী পরিণতি কী? জোসেফ স্তালিনের পর তিনিই দীর্ঘ সময় দেশটি শাসন করছেন। আর ছয় বছর হলে তিনি স্তালিনের রেকর্ড ভাঙতে পারবেন। কিন্তু রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের অলক্ষুণে খবরাখবর পুতিনের সেই সম্ভাবনায় কালো ছায়া ফেলছে।
২০২২-এর ২৪ ফেব্রুয়ারি পুতিন ইউক্রেনে সৈন্য পাঠান। সেই হিসাবে এ যুদ্ধের বয়স প্রায় আট মাস হলো। পুতিনের বাহিনী সীমান্ত এলাকার রুশভাষীদের প্রাধান্যপূর্ণ চারটি অঞ্চল গণভোটের মাধ্যমে দখলে আনা ছাড়া তেমন চমকদার কোনো সফলতা দেখাতে পারেনি। তবে এ যুদ্ধের এখনকার কৌতূহলজনক দিক—রুশদের বিজয়ের চেয়েও ইউক্রেনে তাদের পরাজয়ের শঙ্কা বিশ্ববাসীকে বেশি উদ্বিগ্ন করছে। বিশেষ করে পুতিনের তরফ থেকে পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের বিশ্বাসযোগ্য হুমকির পর।
রাশিয়ায় পুতিনের শাসনের ধরন এমন যে ইউক্রেনে আগ্রাসনের আগে তাঁকে জনমতের তোয়াক্কা করতে হয়নি। হামলার পক্ষে দেশটিতে জাতীয়তাবাদী পক্ষপাতও ছিল। সেটা এখন কিছুটা স্তিমিত। আট মাসের যুদ্ধে প্রচুর সৈনিকের মৃতদেহ দেশে ফিরেছে। যুদ্ধে দেশ ঠিক কী অর্জন করতে পারল, সে বিষয়েও হাতে–কলমে কিছু শনাক্ত করতে পারছে না রুশরা।
আবার ২১ সেপ্টেম্বর ‘রিজার্ভ ফোর্স’ থেকে নতুন করে তিন লাখ জনবল চেয়ে ডিক্রি জারির পর সমাজে জীবন-মৃত্যুর টানাপোড়েন সেনানিবাসের বাইরেও আতঙ্ক আকারে হাজির হয়েছে। ‘রিজার্ভ’ তলবের পর ইউক্রেনের জমিনে প্রত্যাশামতো সফলতা না পাওয়ায় রুশ জেনারেলদের সমালোচনা বেড়েছে। সামনে একই রকম অসন্তোষ দ্রুত পুতিনের দিকেও ধেয়ে আসতে পারে—রাজপথের বিক্ষোভে কড়া নিষেধাজ্ঞার পরও।
প্রকাশ্য যুদ্ধ ইউক্রেন বনাম রাশিয়া হলেও এ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও তার অনেক মিত্র যে ব্যাপকভাবে যুক্ত, সে সত্যে কোনো রাখঢাক নেই আর। ওয়াশিংটন খোলাখুলিভাবে যে পুতিনের বিরুদ্ধে নেমেছে, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই আর। এ যুদ্ধে তারা পুতিনের পরাজয় দেখতে চায়।
পুতিনের যুদ্ধ নিয়ে সবচেয়ে মুশকিলে আছে বিশ্ব পুঁজিতন্ত্র। যদিও এ যুদ্ধ সমরশিল্পকে প্রবৃদ্ধির স্থায়ী এক সুযোগ দিয়েছে, কিন্তু তাতেও বৈশ্বিক মন্দা এড়ানো যাচ্ছে না। ৪ অক্টোবর বিশ্বব্যাংক যে ‘ইকোনমিক আপডেট’ প্রকাশ করেছে, তাতে স্পষ্ট—মহামারির কারণে বিশ্ব অর্থনীতি যে বিপর্যয়ে পড়েছিল, তা থেকে উদ্ধার পাওয়া যাচ্ছে না ইউক্রেন সংকটের কারণে।
কিন্তু সে রকম কোনো পরাজয় নিয়ে পুতিনের পক্ষে ক্ষমতায় থাকা কঠিন, এমনকি স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকাও দুরূহ। কারণ, এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে রাশিয়ার ইজ্জতের প্রশ্ন। এ যুদ্ধে জিতলে তার পুরো কৃতিত্ব যেমন পুতিনের হতো বা হবে, তেমনি পরাজয়ের শতভাগ দায় তাঁকেই বইতে হবে।
ইউক্রেনে যে তাঁর জন্য ফাঁদ পাতা আছে, সেটা পুতিন হয়তো বুঝতে পারেননি, যেভাবে ওয়াশিংটন আফগান ফাঁদের পূর্বাভাস আমলে নেয়নি সময়মতো। আফগানরা মোটেই ইরাকিদের মতো নয়, যেভাবে জর্জিয়া আর ইউক্রেন এক রকম নয়। ইতিমধ্যে এটা স্পষ্ট, রুশদের ইউক্রেন অভিযান মোটেই ২০০৮–এর জর্জিয়া অভিযানের মতো হচ্ছে না এবং তার জন্য প্রতিরক্ষামন্ত্রী সার্গেই শোইগু নন, পুতিনকেই দায়িত্ব নিতে হচ্ছে এবং যুদ্ধ যে ইউক্রেন ছাড়িয়ে রুশনিয়ন্ত্রিত অঞ্চলেও ঢুকবে, ক্রিমিয়ায় সেতু ধ্বংস তার স্পষ্ট আলামত।
চারদিকে কৌতূহল, পুতিন এখন কী করবেন? প্রচলিত যুদ্ধে কিয়েভের যে পতন ঘটছে না, সেটা প্রায় নিশ্চিত। রিজার্ভ ফোর্স খোঁজ করে পুতিন যোদ্ধা-সংকটের ইঙ্গিত দিয়েছেন। তবে রুশ রাজনৈতিক ভাষ্যকার আলেক্সি চাদাইয়েভ ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পলিটিকো ম্যাগাজিনে বলেছেন, ‘রুশদের সমস্যা অবশ্যই জনবল, অস্ত্রশস্ত্র বা সরবরাহ লাইন নয়; বরং কৌশলগত চিন্তার দুর্বলতা।’ এ রকম মন্তব্য পুতিনকে খাটো করে। কিন্তু তা মিথ্যা নয়। কেবল পর্যাপ্ত সংখ্যায় রুশ সৈনিক নয়, পুতিন পাচ্ছেন বিপুল ভাড়াটে চেচেন। তাঁর সামনে বিকল্পগুলো বেশ স্পষ্ট, যদিও সেগুলো সংখ্যায় বেশি নয়।
যুদ্ধের সিদ্ধান্ত যেহেতু তিনি একাই নিয়েছেন, সে কারণে এর সমাপ্তিও তাঁকেই টানতে হবে। তাঁকে হয় পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগ করতে হবে, নাহয় বিদায় নিতে হবে। তবে ‘বিদায়’ ধারণারও অনেক ধরন আছে। পরাজিত সর্বাধিনায়কদের বিদায় কখনোই স্বচ্ছন্দ বা স্বাভাবিকভাবে হয় না। বিশেষ করে রাশিয়ার কুলীনরা ইতিমধ্যে এ যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত, ফলে পুতিনকে এখন তাদের সন্তুষ্ট করে কোনো সমাধান চিন্তা হাজির করতে হবে। জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাহীন সমাজে এই অভিজাতরাই তাঁর কর্তৃত্বের মূল শক্তি।
রুশ অভিজাত শ্রেণির প্রাথমিক আশা ছিল, এ যুদ্ধ স্বল্পস্থায়ী হবে এবং রাশিয়ার বিজয় শেষে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পুতিনের মতো তাদেরও দাপট বাড়বে। জাতীয়তাবাদী এই অভিজাতরা ইতিহাসে বিলীন হয়ে যাওয়া সোভিয়েত আমলের মতো ‘পরাশক্তি’ হিসেবে দেখতে চায় নিজেদের। পুতিনের প্রতি সে জন্য তাদের কৌশলগত সমর্থন ছিল। কিন্তু ইউক্রেন থেকে তাদের প্রত্যাশামতো সুসংবাদ আসছে না।
অথচ যুদ্ধের অর্থনৈতিক মাশুলের বড় অংশ জোগাতে হচ্ছে তাদের। এটা যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলেরও একাংশ, পুতিনের সঙ্গে রাশিয়ার অর্থনৈতিক অভিজাতদের মনোমালিন্য বাড়াতে চায় তারা। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা সেভাবেই জারি হয়ে চলেছে। অর্থাৎ পুতিনের জন্য যুদ্ধফ্রন্ট আসলে দুটি এখন। বড় যুদ্ধটা ধেয়ে আসছে তাঁর জন্য ঘরের ভেতর থেকে।
যেকোনো যুদ্ধই সামরিক আমলাতন্ত্রকে বাড়তি উত্তেজনা জোগায়। সেই সূত্রে প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগুর সঙ্গে অভিজাত গোষ্ঠীর যেকোনো রাজনৈতিক বোঝাপড়া পুতিনের জন্য দূরবর্তী বাজে শঙ্কা হিসেবে মাঠে আছে। আর রুশ রাজনৈতিক ঐতিহ্যও হলো ঘরের ভেতরকার ‘সহযোগী’দের দ্বারা ‘পরিবর্তন’।
১৯৯৯-এ পুতিনও সেভাবেই রাজনীতির পরিমণ্ডলে প্রবেশ করেছিলেন। তাঁর গুরু ইয়েলৎসিনও একই কায়দায় এসেছিলেন। সের্গেইকে নিয়ে তাই বাজি ধরা যায়। তবে ঘরের উদীয়মান উদ্বেগ সামলাতে পুতিন দ্বিতীয় ফ্রন্টে পারমাণবিক বোমাকে বিকল্প হিসেবে বেছে নিলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের জন্য খেলার ছক পাল্টে যাবে। ছদ্মযুদ্ধের পর্দা সরিয়ে তাদের সরাসরি সামনে আসতে হবে তখন, নিতে হবে আরও শরণার্থী।
পুতিন ইউরোপের দ্বিধাবিভক্তির সুযোগ নিয়েছেন এত দিন। পারমাণবিক বোমার ব্যবহার শুরু করলে সেটা আর না–ও পেতে পারেন। জার্মান ও ফরাসিরা তখন যাবতীয় দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে আরও বেশি সহায়তা দিতে পারে পুতিনকে মোকাবিলায়। আর ওয়াশিংটনও তখন সরাসরি যুদ্ধে নামার নৈতিক সমর্থন পাবে বিশ্বব্যাপী।
ইউক্রেনের মাটিতে পুতিনের সৈনিকদের চূড়ান্ত পরিণতি যা–ই হোক, তার সঙ্গে ইতিমধ্যে বিশ্বভাগ্য জড়িয়ে গেছে। যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যখনই ইউক্রেন কোনো সফলতা পাচ্ছে, তখনই বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক বাড়ছে। এ আতঙ্ক পুতিনের পরবর্তী পদক্ষেপের অনিশ্চয়তা নিয়ে। তিনি পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগ করবেন কি না, এ নিয়ে তুমুল উদ্বেগ এখন ইউরোপের সীমানা ছাড়িয়ে বাংলাদেশের মতো প্রান্তিক অঞ্চলেও পৌঁছেছে।
পুতিনের যুদ্ধ নিয়ে সবচেয়ে মুশকিলে আছে বিশ্ব পুঁজিতন্ত্র। যদিও এ যুদ্ধ সমরশিল্পকে প্রবৃদ্ধির স্থায়ী এক সুযোগ দিয়েছে, কিন্তু তাতেও বৈশ্বিক মন্দা এড়ানো যাচ্ছে না। ৪ অক্টোবর বিশ্বব্যাংক যে ‘ইকোনমিক আপডেট’ প্রকাশ করেছে, তাতে স্পষ্ট—মহামারির কারণে বিশ্ব অর্থনীতি যে বিপর্যয়ে পড়েছিল, তা থেকে উদ্ধার পাওয়া যাচ্ছে না ইউক্রেন সংকটের কারণে।
বরং জ্বালানির উচ্চ মূল্য, ভোগ্যপণ্যের উচ্চ মূল্য এবং সাপ্লাই চেইনে ঝামেলা বৈশ্বিক পুঁজিতন্ত্রের প্রবৃদ্ধিকে টেনে নিচে নামাচ্ছে। খোদ ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার অর্থনীতি এ বছর অন্তত দশমিক ২ শতাংশ সংকুচিত হচ্ছে।
এ পরিস্থিতি পুতিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমর্থক চীনের জন্যও দুশ্চিন্তার কারণ। পুতিনের যুদ্ধে প্রাথমিকভাবে তারা উৎসাহ দেখিয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে বিশ্ব অর্থনীতির অস্থিতিশীলতা সরাসরি চীনের বিপক্ষে যাচ্ছে। বৈশ্বিক মন্দার পদধ্বনি তার রপ্তানি খাতের জন্য অশনিসংকেত।
এ যুদ্ধে রুশদের কাবু দশা যুক্তরাষ্ট্রকে যেভাবে উদ্দীপনা জোগাবে, সেটা বেইজিংয়ের চাওয়া নয়। ছোট দেশগুলো তখন আন্তর্জাতিক পরিসরে বেইজিংকে মিত্র হিসেবে বেছে নিতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যাবে। বাংলাদেশও কি সেই তালিকায় থাকতে পারে? পুতিনের পরবর্তী জন্মদিনের আগেই হয়তো সেটা জানা যাবে।
আলতাফ পারভেজ ইতিহাস বিষয়ে গবেষক