এখন মুখ বন্ধ করে আছে পশ্চিমারা। হামাসের হামলায় যখন ইসরায়েলিরা মারা খাচ্ছিল, তখন তারা ছিল ভয়ানক সরব। এখন ইসরায়েলিদের পাল্টা হামলায় যখন গাজা উপত্যকার মানুষ রক্তাক্ত-বিধ্বস্ত, তখন তারা নীরব।
ইউরোপীয় নেতাদের মুখেও কুলুপ আঁটা। বিশ্বজুড়ে তাঁরা মানবাধিকারের ফেরি করেন। কিন্তু ইসরায়েলের বিষয়ে কিছু বলতে মানা। ইউরোপের পত্রিকা বা টেলিভিশনে সশস্ত্র সংগঠন হামাসের সন্ত্রাসের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু খুব কম মিডিয়াতেই গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলিদের পাল্টা হামলার মুখে সেখানকার মানুষের মানবেতর অবস্থার কথা আসছে।
নিকট অতীতে ইউরোপ বা জার্মানিতে জায়নবাদের এবং ইসরায়েলের আগ্রাসী ভূমিকা নিয়ে যিনিই জার্মানিতে আলোচনা করতে চেয়েছেন, তিনিই চরমভাবে সমালোচিত হয়েছেন। এখনো সেই প্রথাগত অভ্যাস রয়ে গেছে।
শত বছর পার হয়নি, পশ্চিমারা কি নিজ মহাদেশে ইহুদি নির্যাতনের সেই ‘ক্রিস্টাল রাত্রির’ কথা ভুলে গেছে। ১৯৩৮ সালের ৯ নভেম্বর হিটলারের নাৎসি পার্টির স্বেচ্ছাসেবক, সংগঠিত গুন্ডারা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো জার্মানিজুড়ে ইহুদি উপাসনালয় সিনাগগগুলো পুড়িয়ে দিয়েছিল। সেই রাত থেকে জার্মানিজুড়ে ইহুদি আর প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের ওপর অত্যাচারের বিভীষিকা নেমে আসে।
বার্লিনের বিখ্যাত ওরিয়েন বুর্গার ইহুদি উপাসনালয়সহ ২৬৭টি উপাসনালয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। প্রায় ১৭ হাজার লোককে একই রাতে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাঁদের বুখেনভাল্ড, ডাখাউ, সাক্সেন হাউসেনের বন্দিশিবিরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সারা জার্মানিজুড়ে ইহুদিদের সাত হাজার দোকানপাটে লুটপাট চালানো হয়।
এখনো ইহুদিরা ‘ক্রিস্টাল রাত্রি’ স্মরণ করে। সেই রাতটি ছিল ইহুদি জাতিসত্তার ওপর ইতিহাসের নিকৃষ্টতম গণহত্যার আনুষ্ঠানিক সংকেত। নাৎসি জার্মানি অধিকৃত হল্যান্ড, বেলজিয়াম, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া, সাবেক চেকোস্লাভাকিয়া, ইউক্রেন থেকে দলে দলে ইহুদি জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের ধরে এনে নানা বন্দিশিবিরে হত্যা করা হয়েছিল। ইতিহাসে এই গণহত্যা হলোকাস্ট নামে পরিচিত।
আসলে হত্যা, ধ্বংসলীলা আর নিধন করে কোনো জাতিসত্তাকে মুছে ফেলা যায় না। তা ছাড়া নাৎসি বাহিনী শুধু ইহুদি নিধনই নয়, জার্মানির প্রতিবেশী সব জাতিকেই ধ্বংসের অথবা করায়ত্তের চেষ্টা করেছিল।
হিটলার নিজের জাতির মধ্যেও শুদ্ধিকরণের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। শুধু ৬০ লাখ ইহুদি নিধনই নয়; নাৎসি বাহিনী হত্যা করেছিল অন্য ধর্ম বা বর্ণের মানুষদের, সামাজিক গণতন্ত্রী, বাম প্রগতিশীল রাজনীতিক, জিপসি জাতিসত্তা, সমকামী, শারীরিকভাবে বিকলাঙ্গ মানুষসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর অসংখ্য যুদ্ধবন্দীদের।
কিন্তু ইতিহাসের সেই করুণ অভিজ্ঞতা থেকে বেশির ভাগ ইসরায়েলি রাজনৈতিক নেতারা কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেননি। ইসরায়েল রাষ্ট্র জন্মের ৭৫ বছর পরও তারা একইভাবে ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর ওপর দমন-পীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে।
হত্যা, নির্যাতন কোনো সমাধান নয়। তা গাজা সীমান্তের কাছে সুপারনোভা সংগীত উৎসবে হামাসের হামলা ও হত্যাকাণ্ড হোক বা গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি সেনাদের বর্বরতা হোক। একটি হত্যা দিয়ে আরেকটি হত্যা মুছে ফেলা যায় না।
মানবিকতা অন্য বিষয়, তা আধুনিক সভ্যতার দাবিদার জার্মানি বা ইউরোপীয়দের বুঝতে হবে। কিন্তু তারা তা জেনেবুঝেও না দেখার ভান করে বা মুখ বন্ধ করে রাখে। কেউ কিছু বলতে গেলে তাকে একঘরে করার চেষ্টা চলে নতুবা অ্যান্টি-সেমিটিজম বা ইহুদিবিরোধী ঘরানায় ফেলা হয়।
৮ অক্টোবর ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত শুরু হওয়ার পরের দিন ট্যাক্সি করে বার্লিন রেলওয়ে স্টেশনে যাচ্ছিলাম। কথা প্রসঙ্গে চালকের নাম জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বলেন, তাঁর নাম হিশাম। বছর ২০ আগে এই ফিলিস্তিনি নাগরিক হিশাম লেবানন থেকে বার্লিনে এসে থিতু হয়েছেন। আগের দিন হামাসের হামলা ও বার্লিন শহরের সোনেএ্যালিতে, ফিলিস্তিনি পতাকা নিয়ে হামাস সমর্থকদের উচ্ছ্বাস উদ্যাপনে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলাম।
হিশাম বললেন, দক্ষিণ বৈরুতের সাবরা এবং শাতিলা ফিলিস্তিন শরণার্থীশিবিরে গণহত্যা হয়েছিল। তিনি সাবরা শিবিরে ছিলেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ছয় বছর। চারদিকে ইসরায়েলি সৈন্যদের দ্বারা বেষ্টিত ছিল। ১৯৮২ সালের ১৬ থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর সেই লেবাননের গৃহযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে ৩ হাজার ৩০০ ফিলিস্তিনি শরণার্থীকে হত্যা করা হয়। যাদের অধিকাংশই ছিলেন নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ বেশির ভাগ বেসামরিক নাগরিক। শরণার্থীশিবির জুড়ে ছিল রক্তের বন্যা। সেই হত্যাযজ্ঞে মা আর বোনকে হারিয়েছিলেন হিশাম।
হিশাম এটুকু বলার পর তাঁকে আর আমার আর কিছু জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা হলো না। তবে হিশাম বলতে থাকেন, কিছু হামাস সমর্থক বার্লিনের রাস্তায় ফিলিস্তিনি পতাকা নিয়ে উচ্ছ্বাস করেছে, তার সমালোচনাতে জার্মানির সংবাদমাধ্যম সরব। তারা সেটাই দেখে, ফিলিস্তিনিদের অন্তরটা দেখে না।
১৯৯৮ সালের ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন সাহিত্যিক মার্টিন ভালসার। ১১ অক্টোবর ফ্রাঙ্কফুর্টের পাউল গির্জায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মূল বক্তা ছিলেন তিনি। সেখানে তিনি বলেছিলেন, বিশ্বযুদ্ধের অপরাধবোধ থাকলেও কথায় কথায় ইহুদি নির্যাতনের বিষয়টি সামনে টেনে আনা এবং বার্লিন শহরের মধ্যখানে বিশ্বযুদ্ধের সময় নিহত ইহুদিদের স্মরণে স্টেডিয়ামসম এলাকাতে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের বিষয়টি তাঁর বোধগম্য নয়। এ বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যিক মার্টিন ভালসার সমালোচকদের তোপের মুখে পড়ে যান।
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বরেণ্য জার্মান সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাস ২০১২ সালের ৪ এপ্রিল বনেদি জার্মান দৈনিক সুদ ডয়েচে যাইটুংয়ের সাহিত্য পাতায় ৬৯ লাইনের ‘যে কথা বলতে হবে’ শিরোনামে একটি কবিতা লেখেন। কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জার্মানিজুড়ে সমালোচনা শুরু হয়ে যায়। সেই কবিতায় তিনি লিখেছিলেন, ‘ইসরায়েল যে বিশ্ব শান্তির অন্তরায়, আমি তা বলব। ইসরায়েলকে নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের ভণ্ড কপটতায় ভরা রাজনীতিতে ক্লান্ত আমরা, আর দেরি নয়, এখনই তা বলতে হবে।’
মধ্য ইউরোপ তথা জার্মানিতে জ্ঞানচর্চা আর মুক্ত বুদ্ধির বিকাশের জন্য ফ্রাঙ্কফুর্টে যে বইমেলা শুরু হয়েছিল, এ বছর তার ৭৫তম বর্ষপূর্তি। বইমেলায় নানা পুরস্কারের মধ্য লিবারেট প্রাইজ নামের পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছিল প্যালেস্টাইন বংশোদ্ভূত লেখিকা আদানিয়া শিবলীকে তাঁর ‘এ মাইনর ম্যাটার’ উপন্যাসের জন্য।
এটি ‘গ্লোবাল সাউথ’ অংশ থেকে লেখকদের জন্য একটি পুরস্কার। ফ্রাঙ্কফুর্টের বইমেলায় পুরস্কারটি ২০ অক্টোবর দেওয়ার কথা থাকলেও ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত শুরু হওয়ার কারণে এখন তা স্থগিত করা হয়েছে।
এই হলো ইউরোপ তথা জার্মানিতে জ্ঞানচর্চা আর মুক্তবুদ্ধি বিকাশের নমুনা ও নৈতিকতা।
সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি
Sharaf.ahmed@gmx.net