বিষয় হিসেবে ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ বুঝতে এখন বেশি বেগ পেতে হচ্ছে না। ইউক্রেন যুদ্ধের পর তার ছায়া পড়েছে দুনিয়াজুড়ে রান্নাঘর পর্যন্ত। অনেকের শঙ্কা, ব্রাজিলের আসন্ন নির্বাচন চলতি ঠান্ডা যুদ্ধ আরেক দফা উসকে দেবে। এ রকম শঙ্কার মূলে আছে লুলা ডি সিলভার ফিরে আসা। ২ অক্টোবর সেখানে যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে, তার দিকে বৈশ্বিক মনোযোগ বাড়ার বড় কারণ তিনি। অনেকের বিবেচনায়, লুলাকে ঘিরে ‘আমেরিকা বনাম অন্যান্য’ ম্যাচ হয়ে উঠতে পারে এ নির্বাচন।
লুলাকে দেখা হয় বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় বিরোধী দলের নেতা হিসেবে। সম্ভবত বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় বামপন্থী নেতাও তিনি। ব্রাজিলে তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট হতে চাইছেন তিনি।
লুলার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা অপর প্রার্থী লিবারেল পার্টির বলসোনারোর জন্য রেড নোটিশের মতো। প্রতিটি মতামত জরিপ দেখাচ্ছে, তাঁরা উভয়ে প্রার্থী হলে বলসোনারোর চেয়ে লুলা বড় ব্যবধানে জিতবেন। এ বিজয় সাধারণভাবে ব্রাজিলের জন্য এবং বিশেষভাবে দেশটির দরিদ্র মানুষের জন্য দরকার।
অতীতে ক্ষমতায় থাকার দিনগুলোতে ‘বলসা ফ্যামিলিয়া’ নামে লুলা যে কর্মসূচি চালু করেন, ব্রাজিলের দরিদ্ররা সে রকম উদ্যোগ আরও চায়। বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়া ও টিকার বিনিময়ে দরিদ্র পরিবারগুলোকে অর্থসহায়তা দেওয়া হতো বলসা ফ্যামিলিয়া কর্মসূচিতে। প্রতিটি শিশুর পেছনে এ কাজে রাষ্ট্রের মাসে খরচ হতো ১২ ডলার। তাতে ব্রাজিলের দরিদ্র পল্লিগুলোতে রাতারাতি শিক্ষার হার বাড়ে, শিশুশ্রম কমে, প্রাথমিক স্বাস্থ্যেও উন্নতি হয়।
এ রকম পরিবারগুলোর খাদ্যনিরাপত্তা বাড়াতে লুলা ‘ফমি-জিরো’ নামে যে প্রোগ্রাম চালু করেন, সেটাও ভালো ফল দেয়। ফমি-জিরো মানে, ক্ষুধার্ত থাকার ঘটনা শূন্যে নামিয়ে আনা। লুলা বরাবরই বলেন, ব্রাজিলের সবাই দিনে তিন বেলা খেতে পাচ্ছে, এটা দেখতে পেলেই তিনি সন্তুষ্ট। নিজের শাসনামলে তিনি দেখাতে চেয়েছেন, পুঁজিতন্ত্রও অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে পারে। এ দাবি নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে দরিদ্রদের মধ্যবিত্তের কাতারে এনে ব্রাজিলের পুঁজিতন্ত্রকে চাঙা করতে তৎপর ছিলেন লুলা ক্ষমতার দিনগুলোতে।
বিশ্বে যেসব দেশে সামাজিক অসাম্য প্রবল, তার মধ্যে ব্রাজিলের অবস্থান এখনো ওপরের দিকে। এখানে নিচুতলার ৯০ ভাগ মানুষের মাসিক আয় গড়ে ৫৫০ ডলারের নিচে। ওপরতলার ১০ ভাগের হাতে রয়েছে দেশটির সম্পদের ৭৫ ভাগ। এসবই আমূল অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তাকে জ্বালানি জোগাচ্ছে। তবে দরিদ্ররা যতই আগ্রহী হোক, লুলার অগ্রযাত্রা নির্বিঘ্ন না-ও হতে পারে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট দক্ষিণপন্থী বলসোনারো সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে নির্বাচনকে কিংবা নির্বাচনে দেওয়া জনগণের মতামত পাল্টে দিতে পারেন। বহুদিন থেকে সেনাবাহিনীকে রাজনীতিকীকরণ করে চলেছেন তিনি। বেসামরিক অনেক পদে বিপুল হারে সেনা কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাঁর আমলে। একনায়কতান্ত্রিক শাসনপদ্ধতির প্রতিও বহুবার তিনি প্রকাশ্যে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। নির্বাচনে হারলে সেটা প্রতিরোধ করতে সমর্থকদের প্রস্তুত থাকারও আহ্বান জানিয়ে রেখেছেন বলসোনারো। করোনার সময় এ রকম ঔদ্ধত্য এবং একরোখা মনোভাবের বলি হতে হয়েছে ব্রাজিলের প্রায় চার লাখ মানুষকে।
বলসোনারোর কারণেই লুলা এবং ব্রাজিল, উভয়ের জন্য আগামী নির্বাচন কেবল একটা ডিনারের আসর হবে না; বরং বলা যায়, ব্রাজিলের গণতন্ত্র একটা বড় পরীক্ষায় পড়বে অক্টোবরে কিংবা তারও আগে। সে জন্যই বিশ্বের অনেকের নজর এখন ওদিকে।
সব মিলিয়ে ‘লুলাইজম’ ব্রাজিল ছাড়িয়ে দক্ষিণ আমেরিকাজুড়ে ওয়াশিংটনের জন্য একটা ‘বাজে হেজিমনি’ তৈরি করবে! জেলজীবনের অভিজ্ঞতার পর লুলাও এ বিষয়ে সতর্ক আছেন। সংবাদ সংস্থা রয়টার্স খবর দিয়েছে, তাঁকে নিয়ে ওয়াশিংটনের উদ্বেগ কমাতে লুলা তাদের সঙ্গে নির্বাচনের আগেই পরোক্ষ যোগাযোগ গড়ে তুলতে পদক্ষেপ নিয়েছেন। এ রকম ‘যোগাযোগ’ আবার ব্রাজিলের দরিদ্রদের জন্য উদ্বেগজনক!
আন্তর্জাতিক মহলে ব্রাজিলের গুরুত্ব অনেক কারণে। মাত্র ১৫ থেকে ১৬ কোটি ভোটারের নির্বাচন হলেও ১৯৮৫ থেকে দক্ষিণ আমেরিকায় ব্রাজিলের গণতন্ত্র পুরো অঞ্চলের জন্য আশার প্রদীপের মতো। রাজনৈতিক-অর্থনীতি এবং বৈশ্বিক পুঁজিতন্ত্রের জায়গা থেকেও দেশটির কদর আছে। দক্ষিণ আমেরিকার প্রধান অর্থনীতি তারা। বিশাল এক মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হচ্ছে এখানে।
আবার চীন, রাশিয়া, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা মিলে ‘ব্রিকস’ জোটের সদস্য হওয়ার কারণেও বিশ্বের ঠান্ডা যুদ্ধের সমীকরণে ব্রাজিল গুরুত্বপূর্ণ দেশ। বিশ্ব জনসংখ্যার ৪২ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করছে ব্রিকস। দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়া বাকি চার দেশ বিশ্বের সেরা ১০ অর্থনীতির তালিকায় আছে।
এসব কারণ মিলেই ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে আগে ব্রাজিলে হঠাৎ লুলার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তাঁকে ভোটের আসর থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। গত বছর মার্চে নির্দোষ সাব্যস্ত হয়ে কারাগার থেকে বের হলেও ইতিমধ্যে লুলা ৫৮০ দিন জেল খেটেছেন। কিন্তু তারপরও তাঁর পুরোনো জনপ্রিয়তা নিয়ে প্রত্যাবর্তন দেখে মনে হচ্ছে, আমেরিকা আরেক দফা ব্রাজিলকে নিয়ে দুর্ভাবনায় পড়ল।
বিশ্বরাজনীতিতে ব্রিকস জোট এ মুহূর্তে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ইউক্রেন ঘিরে চীন, রাশিয়া কাছাকাছি আছে। দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারত মধ্যপন্থার ভঙ্গি নিয়ে থাকলেও তাদের ওপর নির্ভর করতে পারছে না ওয়াশিংটন। ব্রিকস জোটে তাদের ভরসা ছিলেন কেবল ব্রাজিলের বলসোনারো।
কিন্তু তাঁর জায়গায় লুলা ব্রাজিলের প্রতিনিধি হলে ব্রিকস পুরোই ওয়াশিংটনের মাথাব্যথার কারণ হতে পারে। ইতিমধ্যে টাইম-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে (৪ মে) লুলা ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য পুতিনের পাশাপাশি জেলেনস্কি, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউকেও অনেকখানি দোষারোপ করেছেন। এ রকম কথা জো বাইডেনের উপদেষ্টাদের পছন্দ হওয়ার নয়।
ব্রাজিলের নির্বাচনের এখনো কয়েক মাস দেরি আছে। তবে দক্ষিণ আমেরিকা ও উত্তর আমেরিকার কাগজগুলোতে নিয়মিত এই নির্বাচন নিয়ে প্রতিবেদন বের হচ্ছে। এ রকম কোনো প্রতিবেদনে বলসোনারোকে বিজয়ী দেখানো যায়নি। এর বড় কারণ, লুলার বিগত দুই দফা শাসনের ইতিবাচক স্মৃতি।
২০০৩ থেকে সাত বছর ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। এক যুগ আগে যাঁরা লুলার শাসন দেখেছিলেন, তাঁরা আবার একই রকম সরকার চাইবেন, এটা অস্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে ব্রাজিলের দরিদ্ররা। লুলার সম্ভাব্য বিজয়ের পক্ষে আরেক বড় কারণ, ওয়ার্কার্স পার্টি। দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে সুসংগঠিত রাজনৈতিক কাঠামো এটা। ব্রাজিলের সমাজের সব প্রান্তে যে এদের সংগঠন রয়েছে, তার প্রমাণ লুলা নিজে। সাধারণ এক ট্রেড ইউনিয়নের নেতা থেকে পার্টি তাঁকে জাতীয় মঞ্চে ঠেলে দিয়েছে।
সাম্যবাদী না হলেও লুলা এবং ওয়ার্কার্স পার্টি অর্থনীতিতে দরিদ্রমুখী সংস্কারের বিষয়ে আন্তরিক। লুলার বিগত শাসনে দেশটির অর্থনৈতিক অগ্রগতিও ছিল নজরকাড়া। সে জন্য ধনীদের একাংশও তাঁকে ‘স্থিতিশীলতা’র জন্য জরুরি মনে করছে। বিশেষ করে বলসোনারোর হাতে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রায় স্থবির হয়ে যাওয়ার পর। ধনিকগোষ্ঠীতে বলসোনারোকে নিয়ে দ্বিধাবিভক্তি লুলাকে কৌশলগত সুবিধা দিচ্ছে।
করপোরেটদের একাংশে অবশ্য ওয়ার্কার্স পার্টিকে নিয়ে অস্বস্তিও আছে। কারণ, এ দলের মধ্যে সম্পদ পুনর্বণ্টনের চেতনা প্রবল। আবার ব্রাজিলের বামপন্থীদের জন্য লুলাও এক দুর্বলতার নাম। কারণ, দক্ষিণপন্থীদের মোকাবিলায় তাদের হাতে এখনো লুলার বিকল্প নেই। অথচ তাঁর বয়স ৭৫ হয়ে গেছে। তবে সবকিছু ছাড়িয়ে এই নির্বাচনে আমেরিকার মনোভাবই বুঝতে চাইছে সবাই। ওয়াশিংটনের বৈশ্বিক স্বার্থের দিক থেকে ব্রাজিলকে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি দরকার।
কিন্তু লুলার প্রত্যাবর্তন দেশটিকে প্রতিপক্ষ শিবিরের দিকে নিয়ে যেতে পারে বলে উদ্বিগ্ন তারা। আমেরিকার এই উদ্বেগকে লুলাও অগ্রাহ্য করতে পারেন না। কারণ, ২০১৮-তে তিনি টের পেয়েছেন, ওয়াশিংটনের হাত কত লম্বা। সে সময় নির্বাচনের আগে তাঁকে যে জেলে ঢোকানো হয়, তাতে ব্রাজিলে আমেরিকার বড় বিনিয়োগকারীদের হাত ছিল বলে লুলার অনেক সমর্থক মনে করেন। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলাটা অনেকখানিই আন্তমহাদেশীয় স্তরে পরিকল্পিত ছিল।
লুলাকে নিয়ে আমেরিকার উদ্বেগের তালিকায় আছে কিউবা, ভেনেজুয়েলা ও নিকারাগুয়াও। এই তিন দেশের সঙ্গে ওয়াশিংটনের আদর্শিক রেষারেষি আছে। কিন্তু লুলার বিজয়ে নৈতিকভাবে চাঙা বোধ করবেন ওই তিন দেশের শাসকেরাই। তাঁদের অনেকের সঙ্গে আবার বন্ধুত্ব আছে ইরানের।
সব মিলিয়ে ‘লুলাইজম’ ব্রাজিল ছাড়িয়ে দক্ষিণ আমেরিকাজুড়ে ওয়াশিংটনের জন্য একটা ‘বাজে হেজিমনি’ তৈরি করবে! জেলজীবনের অভিজ্ঞতার পর লুলাও এ বিষয়ে সতর্ক আছেন। সংবাদ সংস্থা রয়টার্স খবর দিয়েছে, তাঁকে নিয়ে ওয়াশিংটনের উদ্বেগ কমাতে লুলা তাদের সঙ্গে নির্বাচনের আগেই পরোক্ষ যোগাযোগ গড়ে তুলতে পদক্ষেপ নিয়েছেন। এ রকম ‘যোগাযোগ’ আবার ব্রাজিলের দরিদ্রদের জন্য উদ্বেগজনক!
আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ের গবেষক