বিচারবহির্ভূত হত্যা দেখে দেখে বালুচ সমাজ ক্ষুব্ধ ও বিষণ্ন। প্রতিবাদ মানে সেখানে গুম হয়ে যাওয়া। এ রকম একটা জনপদের মানুষদের প্রতিবাদে সংঘবদ্ধ করা যে কত দুরূহ সেটা দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের মানুষ ভালোভাবে জানেন। মাহরাঙ বেলুচ ঠিক সেই কঠিন কাজটিই করেছেন।
তিনি একা নন অবশ্য। তাঁর মতো অনেক বেলুচ নারী অবিশ্বাস্য এক প্রতিবাদের সুনামি তৈরি করেছেন বেলুচিস্তানে। সেখান থেকে ‘লংমার্চ’ করে তাঁরা এসেছিলেন ইসলামাবাদ। যদিও গত বুধবার জলকামানের তোড়ে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়া হলো—কিন্তু নির্বাচনী উত্তেজনা ছাপিয়ে পাকিস্তান জুড়ে বিস্ময়ের ঢেউ তুলেছে বেলুচ নারীদের এই বিশাল কাফেলা।
প্রশ্ন উঠেছে, দমবন্ধ করা একটা সমাজে কীভাবে পারলেন মাহরাঙ হতাশায় ডুবে থাকা লাখো মানুষকে জড়ো করতে—যা দমনপীড়নে ক্লান্ত দক্ষিণ এশিয়ার বহু জায়গায় প্রায় অসম্ভব হয়ে আছে?
মাহরাঙ বেলুচিস্তানের নারী। ‘মাহরাঙ’ অর্থ ‘চাঁদের মতো রঙ’। উর্দু-ফার্সি-বেলুচ সব ভাষাতে শব্দটা আছে এবং নামটা এই নারীর বেলায় যথার্থই। কিন্তু তরুণী মাহরাঙ চাঁদ নয়, সূর্যের মতো অগ্নিশিখা হয়ে উঠেছেন।
পাকিস্তানের মূলধারার মিডিয়ায় তাঁকে বেশি খুঁজে পাওয়া না গেলেও ইউটিউবে তাঁর শত শত ভাষণ নিজ জাতির দুঃখ-কষ্ট-বঞ্চনার কথা বলে যাচ্ছে প্রতিদিন।
জন্ম কোয়েটার বেলুচ জনপদে হলেও মাহরাঙের দীর্ঘকাল কেটেছে সিন্ধুর করাচিতে। বয়সে এখন তিনি ত্রিশ। শিক্ষা জীবনে পড়েছেন চিকিৎসাবিদ্যা।
মাহরাঙের জীবনে সবচেয়ে বাজে বছর ২০০৯। করাচিতে ওই বছর তাঁর বাবা আব্দুল গাফফারকে অপহরণ করে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী। অভিযোগ ছিল তিনি বেলুচ লিবারেশন আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন।
অপহৃত বেলুচদের ঘিরে এ রকম অভিযোগ নতুন নয়। পাকিস্তানের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো বেলুচ অঞ্চলে সশস্ত্র স্বাধিকার আন্দোলনের জন্য প্রায় সব বেলুচকে সন্দেহের চোখে দেখে। শিক্ষিত তরুণীরাও এই সন্দেহের বাইরে নেই। মুশকিল হলো এ রকম নজরদারির নির্মম শিকার সেখানকার সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা।
অপহরণের দু’বছর পর মাহরাঙ বেলুচের পিতাকেও রাস্তায় মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। শরীরে ছিল তাঁর নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন। তখন থেকে মাহরাঙ রাস্তায়।
কেবল নিজের বাবাকে হত্যার প্রতিবাদ হিসেবে নয়—মাহরাঙ চাইছেন বেলুচদের প্রতি চলমান দমন-পীড়ন-হত্যা-গুমের অবসান। এর মাঝে ২০১৭ সালে তাঁর ভাইকেও এক দফা তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। যদিও মারা পড়েননি তিনি। এ রকম অন্যায়গুলোর বিরুদ্ধে ছাত্রাবস্থা থেকে সোচ্চার মাহরাঙ। তারই চূড়ান্ত এক দৃশ্য বেলুচদের সর্বশেষ লং মার্চ।
বেলুচিস্তানের দ্বিতীয় প্রধান শহর তুরবাত থেকে শুরু করে ডেরা গাজি খান, পাঞ্জাব ছুঁয়ে ইসলামাবাদে এসে গতকাল থামল মাহরাঙদের মিছিল। প্রায় বারো শ মাইল দূরত্ব পেরিয়েছেন তাঁরা। ৭ ডিসেম্বর থেকে তুরবাতে এটা শুরু।
প্রায় দু’সপ্তাহ পর ইসলামাবাদে এসে থামল এ মিছিল। পথে পথে বালুচরা প্রধান যে দাবি তুলে ধরেছে তা হলো গুম-খুন বন্ধ করা এবং আটক বেলুচদের মুক্তি দেয়া। তাদের স্লোগান ছিল: ‘স্টপ বেলুচ জেনোসাইড’।
বিবিসির এক প্রতিবেদন মতে (২ আগস্ট ২০২০) বেলুচিস্তানে এ পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজার জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক কর্মী নিখোঁজ হয়ে আছে। এই লংমার্চের পর কী ঘটবে তাও বলা মুশকিল। কারণ এ রকম রাজনৈতিক সমাবেশে সেখানে নিষেধাজ্ঞা আছে। উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে এফআইআরও হয়েছে।
পাকিস্তানের বিশাল এলাকা বেলুচিস্তান। প্রায় ৪৪ ভাগ। ভু-রাজনৈতিকভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ। আবার মাটির নিচে আছে বিস্তর খনিজ। ইসলামাবাদ এই খনিজ জাতীয় প্রয়োজনে ব্যবহারের পক্ষে। অন্যদিকে, এখানকার মানুষ চাইছে খনিজের উপর প্রথমে তাদের হিস্যা নিশ্চিত হোক।
তাছাড়া খনিজ সম্পদ কীভাবে উত্তোলিত ও ব্যবহৃত হবে তার জন্য চাই এ অঞ্চলের রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন। এ রকম অবস্থান থেকেই বেলুচদের সঙ্গে ইসলামাবাদের নীতিনির্ধারকদের বিরোধ চলছে।
আবার এই বিরোধের ফলে একদিকে সশস্ত্র সংগ্রামের বিস্তার, অন্যদিকে, সেই সশস্ত্রতা রোখার নামে বিচার-বহির্ভূত অপহরণ-গুম বেড়েছে। বহুকাল ধরে এ অঞ্চল সহিংসতার এই দুষ্টচক্রে পড়ে আছে। তবে চীন ও ইসলামাবাদ মিলে অর্থনৈতিক করিডর গড়ার পর থেকে বেলুচিস্তানে নিরাপত্তাহীনতার চূড়ান্ত এক কালো অধ্যায় চলছে।
চীন-পাকিস্তান উভয় দেশের শাসকদের মাঝে এ রকম ধারণাও আছে, বেলুচিস্তানে অস্থিরতা তৈরির পেছনে আন্তর্জাতিক ইন্ধন কাজ করছে। বিশেষ করে যারা চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগের বিরোধী সেসব শক্তি বেলুচদের মদদ দেয় বলে নিয়মিত অভিযোগ তোলা হয়।
মাহরাঙ বেলুচদের সর্বশেষ লংমার্চের আগে বেলুচিস্তানে আরেক দফা গণবিক্ষোভ হয় গত বছর এই সময়ে। ‘হক দো তেহরিক’ নামের ওই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন জামায়াতে ইসলামীর স্থানীয় নেতা মাওলানা হামিদুর রহমান। মাহরাঙের মতোই তিনিও তখন দেশে-বিদেশে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
এই আন্দোলনের ভরকেন্দ্র ছিল চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের কেন্দ্রবিন্দু গদার বন্দর এলাকা। ওই আন্দোলনেরও মূলশক্তি ছিলেন বেলুচ নারীরা। রক্ষণশীল একটা সমাজে একজন মাওলানার নেতৃত্বে নারীদের এভাবে হাজারে হাজারে রাস্তায় নেমে আসা ইসলামাবাদকে স্পষ্টভাবে জানাচ্ছিল বেলুচদের মাঝে অসন্তোষ কত গভীর।
‘হক দো তেহরিক’ আন্দোলন গদার বন্দর ও চীন-পাকিস্তান করিডর থেকে প্রাপ্ত আয়ে স্থানীয়দের অধিকার দাবি করছিল। প্রায় দু’মাস বেলুচ নারীদের ওই আন্দোলন চলে তখন।
উল্লেখ্য, গদার বন্দর ও অর্থনৈতিক করিডরে চীনের বিনিয়োগ ও দেশটির নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে গিয়ে এখানকার জলে-স্থলে নিরাপত্তা বাহিনীর এত টহল ও তল্লাশি বেড়েছে যে, স্থানীয় শ্রমজীবী-কর্মজীবীদের পক্ষে অতীতের স্বাভাবিক জীবনধারা বজায় রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে গেছে। গদার সন্নিহিত উপকূলে বড় বড় ট্রলারে মাছ ধরে নিয়ে যাওয়ায় স্থানীয় জেলেরা পেশা হারাচ্ছেন।
আবার একই সঙ্গে তাঁরা দেখছেন এসব এলাকা ক্রমে ইসলামাবাদ ও বেইজিংয়ের নীতিনির্ধারকদের পূর্ণ কর্তৃত্বে চলে যাচ্ছে। ‘করিডরে’ কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে সেসব বিষয়ে বেলুচদের কিছু বলার থাকছে না—তারা এসবের সুবিধাভোগীও নয়। ফলে অতীতের স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের বক্তব্য এখন বাড়তি ন্যায্যতা পেয়েছে এখানে। পাশাপাশি বেলুচিস্তানের ঐতিহাসিক অসন্তোষে গণচীনও যুক্ত হয়ে গেছে।
দেশের বিশাল একটা অঞ্চলে এ রকম পরিস্থিতি মোকাবিলায় ইসলামাবাদের ভরসা মূলত দমনমূলক কৌশলে। যার পরিণতিতে বেলুচিস্তান জুড়ে সবচেয়ে আতঙ্কিত শব্দ হলো ‘সিটিডি’ (কাউন্টার টেরোরিজম ডিপার্টমেন্ট)। সিটিডি সশস্ত্র বেলুচদের ধরতে বা থামাতে গিয়ে অনেক নিরীহ নাগরিককেও হয়রানি করছে, তুলে নিয়ে যাচ্ছে, মেরে ফেলছে।
এভাবে কেউ যখন নিহত হয় তখন হতভাগ্যদের পরিবারের পক্ষে তার বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেয়াও অতি দুরূহ—কারণ পুলিশ এসব বিষয়ে অভিযোগ গ্রহণ করে না। কেবল আদালত যখন অভিযোগ লিপিবদ্ধ করতে নির্দেশনা দেয়—সেরকম বিরল সময়ে সিটিডির বিরুদ্ধে মামলা নেয়া হয়। যদিও সেসব মামলা থেকেও ন্যায়বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে ক্ষীণ।
ইসলামাবাদের নীতিনির্ধারকেরা দেশে-বিদেশে এসবকে ‘সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ’ হিসেবে প্রচার করছেন। তাতে করে বেলুচিস্তানের সঙ্গে ইসলামাবাদের রাজনৈতিক দূরত্ব ক্রমে বাড়ছেই। সেই ব্যবধানের মাঝেই উত্থান মাহরাঙ বেলুচদের।
এটা বেশ কৌতূহল উদ্দীপক, মাহরাঙ ও তার হাজার হাজার সহযোগী যখন বেলুচিস্তানের মানুষদের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক অধিকারের জন্য ১২ শ’ কিলোমিটার পথ জুড়ে লংমার্চ করছিলেন তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী (কেয়ারটেকার) পদেও রয়েছেন বেলুচিস্তানের একজন রাজনীতিবিদ। কিন্তু নিজ প্রদেশে সশস্ত্র বাহিনীর কাজে লাগাম টেনে ধরতে প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার-উল-হক আদৌ সক্ষম কি না সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
এমনকি ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন শেষে যে দলই ক্ষমতায় আসুক—সম্ভবত তারাও মাহরাঙদের দাবি শান্তিপূর্ণ পথে মেটাতে পারবে না। মাহরাঙদের লংমার্চ ইসলামাবাদে ঢুকে প্রত্যাশামতো যে শেষ হতে পারল না সেটাও অভিজ্ঞতা হিসেবে পুরোনো। ঠিক এই কারণে ২০২৩-এর ডিসেম্বর পাকিস্তানের জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের কাছে ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস সেই পুরোনো চক্রেই ঘুরছে—যখন অতীত ভুল থেকেও সমরবাদী মানসিকতার কারণে কোনো ‘রাষ্ট্র’ কিছু শিখতে অক্ষম। মাহরাঙ বেলুচদের জন্য তাই পথটা অনেক দীর্ঘ, অনেক বন্ধুর। ‘নির্বাচন’ থাকলেও, ‘মাহরাঙ’দের জন্য গণতন্ত্র আসতে এখনও ঢের বাকি। তবে ঘটনা হিসেবে এটা অভিনব, নারীরাও বিপুলভাবে নামছেন পরিবর্তনের সংগ্রামে।
আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক