যে কারণে জিততে পারেন কমলা হ্যারিস

জো বাইডেন ‘দুর্বল’ প্রার্থী ছিলেন, তাঁর তুলনায় ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অধিক শক্তিশালী মনে হয়েছিল। কিন্তু একজন যোগ্য প্রার্থী মাঠে থাকলে হাওয়া যে বদলে যেতে পারে, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। সম্ভবত কমলা হ্যারিসই সেই যোগ্য প্রার্থী। নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে তিনি কেন জিতবেন, তা নিয়ে লিখেছেন হাসান ফেরদৌস

রাতারাতি বদলে গেছে মার্কিন নির্বাচনী রাজনীতির চালচিত্র। এক সপ্তাহ আগেও যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ মানুষ ধরে নিয়েছিলেন আগামী নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ঠেকানোর কোনো পথ নেই। ৮১ বছরের বৃদ্ধ ও ক্ষীণশক্তি জো বাইডেনের পক্ষে তাঁর সঙ্গে পাল্লা দেওয়া সম্ভব হবে না। গত রোববার নির্বাচনী লড়াই থেকে বাইডেন সরে যাওয়ার পর অবস্থা প্রায় পুরোপুরি বদলে গেছে।

ডেমোক্রেটিক পার্টি এখন কার্যত দলীয় প্রার্থী হিসেবে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের প্রার্থিতার ব্যাপারে একমত। নানা মত ও পথে এই দল বিভক্ত। এর অধিকাংশ সমর্থক মধ্যপন্থী অথবা ডানঘেঁষা, অন্যরা বামঘেঁষা। কংগ্রেসের ভেতরে প্রায় ১০০ জন সদস্য আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের ‘প্রগ্রেসিভ’ বা উদারনৈতিক হিসেবে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন।

বিচারব্যবস্থার সংস্কার, পরিবেশ সংকট, অভিবাসন, ইউক্রেন–গাজা ইত্যাদি প্রশ্নে তাঁদের মধ্যে ঠোকাঠুকি রয়েছে। বাইডেনের সরে যাওয়া উচিত কি উচিত নয়, এই প্রশ্নেও তাঁদের মধ্যে মতভেদ ছিল।

দলীয় প্রার্থী হিসেবে কমলার ব্যাপারে তাঁদের কারও কারও উদ্বেগ বা অনাস্থা ছিল না তা নয়। বাইডেন বা দলীয় নেতারা তাঁকেই পরবর্তী প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী নির্বাচন করেছেন, অতএব বিনা বাক্যে তা মেনে নিতে হবে, এ ব্যাপারে সবাই একমত নন। এমনকি সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, যিনি এখনো দলের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা, তিনি পর্যন্ত কমলাকে তাৎক্ষণিকভাবে অনুমোদন দেননি।

তিনি বলেছিলেন, কমলাকে নিজের মনোনয়ন ‘অর্জন’ করতে হবে। ‘উন্মুক্ত সম্মেলনের’ মাধ্যমে সর্বাধিক ডেলিগেটের সমর্থন যিনি পাবেন, তাঁকেই প্রার্থী করা হবে। কমলা নিজেও সে কথাই বলেছেন, ‘আমি অভিষেক নয়, নিজের প্রার্থিতা অর্জন করতে চাই।’

কার্যত তা–ই হয়েছে। দলীয় প্রার্থী হতে আগ্রহী—এমন লোকের হয়তো অভাব ছিল না। কিন্তু বাইডেন কমলার নাম অনুমোদনের পর সেসব প্রার্থীর সবাই একে একে তাঁর প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গেভিন ন্যুসাম ও মিশিগানের গভর্নর গ্রেচেন হুইটমার।

৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দলের ডেলিগেটদের প্রায় দুই হাজার কমলার প্রতি তাঁদের সমর্থন প্রকাশ করেছেন। ফলে, আইনত কমলার প্রার্থিতা ইতিমধ্যে নিশ্চিত হয়েছে। আগামী মাসে শিকাগোয় দলীয় কনভেনশনে তাঁর প্রার্থিতা আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হবে। সেখানে কেউ যদি নিজেদের প্রার্থী হিসেবে দেখতে চান, সে সুযোগ থাকবে, তবে কেউ সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করবেন, তা মনে হয় না।

নভেম্বরের নির্বাচনে কমলা জয়ী হতে পারেন, এটি তার প্রথম কারণ। একদিকে তিনি দলকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন, সঙ্গে সঙ্গে তৃণমূল পর্যায়ে বিপুল উৎসাহ সঞ্চারে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর নাম প্রস্তাবের প্রথম এক দিনের মধ্যে মাঠপর্যায়ের নিয়মিত দলীয় সমর্থকদের চাঁদা থেকে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার তোলা সম্ভব হয়েছে। ধনী দাতাদের কাছ থেকে আরও ১৫০ মিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে।

বলতে গেলে, মাত্র দুই দিনে ডেমোক্রেটিক পার্টি ট্রাম্প ও রিপাবলিকানদের সঙ্গে চাঁদা সংগ্রহের ব্যাপারে যতটুকু পিছিয়ে ছিল, তা দূর করতে সক্ষম হয়েছে।

দ্বিতীয় কারণ, জিততে হলে কমলাকে ডেমোক্রেটিক পার্টির তৃণমূল পর্যায়ের নারী, কৃষ্ণকায়, লাতিন ও তরুণ ভোটারদের মধ্যে আগ্রহ বাড়াতে হবে। সাম্প্রতিক জনমত জরিপে দেখা গেছে, বাইডেন এই চার গ্রুপের সমর্থনই হারাচ্ছেন। শুধু তা–ই নয়, এদের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভোটার হয় ট্রাম্পের দিকে ঝুঁকছেন, নয়তো ভোটের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়েছেন।

কমলার নাম ঘোষণার পর সেই অবস্থা বদলানো শুরু হয়েছে। এখনো কোনো অর্থপূর্ণ জরিপ হয়নি, তবে ছোটখাটো ঘটনা থেকে এই হাওয়াবদলের প্রমাণ মিলছে।

যেদিন বাইডেন কমলার নাম প্রস্তাব করেন, সেদিন আফ্রিকান-আমেরিকান নারীদের একাধিক সংস্থার উদ্যোগে একটি জুম বৈঠকের আয়োজন করা হয়। তাতে কত মানুষ যুক্ত হন, ভাবতে পারেন? ওয়াশিংটন পোস্ট জানাচ্ছে, রোববার রাতে তাৎক্ষণিকভাবে ডাকা সে অনলাইন বৈঠকে ৪৪ হাজার নারী অংশ নেন।

মেয়েদের ডাকা এই বৈঠকের কথা জানতে পেরে কৃষ্ণকায় পুরুষেরাও একটি অনুরূপ অনলাইন বৈঠক ডাকেন, তাতে ৩০ হাজারের বেশি
মানুষ অংশ নেন। একদম তৃণমূল পর্যায়ের এই দুই বৈঠক থেকে প্রায় আড়াই মিলিয়ন ডলার চাঁদা তোলা সম্ভব হয়।

কমলার সম্ভাব্য জয়ের আরেক কারণ, গাজা প্রশ্নে তাঁর গুণগত ভিন্ন অবস্থান। আমরা জানি, ব্যাটলগ্রাউন্ড হিসেবে পরিচিত কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে গাজা প্রশ্নে আরব, মুসলিম ও তরুণদের বিরোধিতার কারণে বাইডেন বেকায়দায় ছিলেন। এর প্রধান কারণ তাঁর ইসরায়েল-তোষণ নীতি। কমলা সরাসরি ইসরায়েলের বিরোধিতা করেননি, তেমন বিরোধিতা করে যুক্তরাষ্ট্রে কারও পক্ষে নির্বাচনী রাজনীতি করা অসম্ভব।

প্রার্থী হিসেবে কমলার শক্তি তিনি নারী ও কৃষ্ণকায় তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু তাঁর প্রকৃত শক্তি প্রার্থী হিসেবে তাঁর নিজস্বতা। তিনি একজন সাবেক ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি (বা নির্বাচিত কৌঁসুলি), ক্যালিফোর্নিয়ার সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এবং বাইডেনের ভাইস প্রেসিডেন্ট। অভিজ্ঞতার কোনো কমতি তাঁর নেই। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে প্রার্থী হিসেবে তাঁর তুলনাটি বিবেচনা করুন। এটি যদি একটি বক্সিং ম্যাচ হয়, তাহলে রিংয়ের দিকে একজন দাগি আসামি, যার অপরাধের মধ্যে রয়েছে ধর্ষণ ও আর্থিক অনিয়ম।

অন্যদিকে একজন পাবলিক প্রসিকিউটর, যিনি এ–জাতীয় অনেক অপরাধীকে জেলের ঘানি টানতে পাঠিয়েছেন। দুই দিন আগে উইসকনসিনে এক নির্বাচনী সভায় কমলা কিছুটা পরিহাসের সঙ্গেই বলেন, ‘ট্রাম্পের মতো লোকদের আমার ভালো করে চেনা আছে।’

কমলার সম্ভাব্য জয়ের আরেক কারণ, গাজা প্রশ্নে তাঁর গুণগত ভিন্ন অবস্থান। আমরা জানি, ব্যাটলগ্রাউন্ড হিসেবে পরিচিত কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে গাজা প্রশ্নে আরব, মুসলিম ও তরুণদের বিরোধিতার কারণে বাইডেন বেকায়দায় ছিলেন। এর প্রধান কারণ তাঁর ইসরায়েল-তোষণ নীতি।

কমলা সরাসরি ইসরায়েলের বিরোধিতা করেননি, তেমন বিরোধিতা করে যুক্তরাষ্ট্রে কারও পক্ষে নির্বাচনী রাজনীতি করা অসম্ভব। এর ভালো প্রমাণ নিউ ইয়র্কের জনপ্রিয় ডেমোক্রেটিক কংগ্রেস সদস্য জামাল বাওম্যান। গত মাসে দলের বাছাই পর্যায়ের নির্বাচনে বাওম্যান ব্যাপক ভোটে পরাস্ত হন শুধু ইসরায়েল-লবির প্রতিরোধের কারণে। বাওম্যানকে হারাতে এই নির্বাচনে প্রায় ২৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হয়, যার অধিকাংশই আসে ইহুদি লবি থেকে।

সেই বিবেচনা মাথায় রেখে সাবধানে পা ফেলতে বাধ্য কমলা। তিনি ইসরায়েলের পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণের বদলে গাজা যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের ওপর অব্যাহত গণহত্যার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। গত ডিসেম্বরে দুবাইতে অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক বৈঠকে তিনি ইসরায়েলি হামলায় অস্বাভাবিক বেসামরিক মানুষ, বিশেষত শিশুহত্যার নিন্দা করেন। এ বছর মার্চে তিনি গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবি তোলেন, তা সে সময় বাইডেন প্রশাসনের অনুসৃত নীতির বিপরীত।

ইসরায়েল প্রশ্নে কমলার অবস্থা নাটকীয়ভাবে খুব ভিন্ন না হলেও তার গুণগত পার্থক্য রয়েছে, সে কথা উল্লেখ করে ইসরায়েলের সমালোচক হিসেবে পরিচিত ওয়েব জার্নাল দ্য কনভারসেশন মন্তব্য করেছে, গাজা প্রশ্নে কমলার অবস্থান জো বাইডেন থেকে ভিন্ন, নভেম্বরের নির্বাচনে এই অবস্থান তাঁকে জিততে সাহায্য করতে পারে।

গাজা প্রশ্নে নিজের স্বতন্ত্র অবস্থান প্রমাণের জন্য কমলা বুধবার মার্কিন কংগ্রেসে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ভাষণে অনুপস্থিত ছিলেন। কংগ্রেসের এই অধিবেশনে প্রথামাফিক তাঁর সভাপতিত্ব করার কথা, কিন্তু পূর্বনির্ধারিত বৈঠকের কথা বলে তিনি তা এড়িয়ে যান।

প্রধান যে কারণে কমলা হ্যারিস আগামী নভেম্বরে জয়লাভ করতে পারেন, তা হলো যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের ট্রাম্পের প্রতি বিরাগ। প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের জন্য একটি হুমকি। কোনো সন্দেহ নেই ট্রাম্পের একটি অতি অনুগত সমর্থক বাহিনী রয়েছে, যারা সম্ভবত মোট ভোটারের ৪০ শতাংশ। কিন্তু দেশের অধিকাংশ মানুষ তাঁকে চান না। বাইডেন দুর্বল প্রার্থী ছিলেন, তাঁর তুলনায় ট্রাম্পকে অধিক শক্তিশালী মনে হয়েছিল। কিন্তু একজন যোগ্য প্রার্থী মাঠে থাকলে হাওয়া যে বদলে যেতে পারে, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই।

সম্ভবত কমলা হ্যারিসই সেই যোগ্য প্রার্থী। আশাবাদীরা বলছেন, নভেম্বরে তিনি শুধু জিতবেন তা–ই নয়, জিতবেন বড় ব্যবধানে।

  • হাসান ফেরদৌস লেখক ও প্রাবন্ধিক