হুদা–রকিব পারেননি, আউয়াল কি পারবেন

আমাদের জাতীয় সংসদ ৫০ বছর পার করেছে। প্রথম জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসেছিল ১৯৭৩ সালের ৭ এপ্রিল। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে ১১টি সংসদের নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম চারটি ও ষষ্ঠ সংসদ মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম, নবম সংসদে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ পালা করে সরকারি কিংবা বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করেছে। দশম সংসদে বিএনপি ছিল না।

দ্বাদশ সংসদের নির্বাচন নিয়ে আবার সরকারি ও বিরোধী দল মুখোমুখি অবস্থানে। আমরা যখন জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছি, তখন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সংসদের বাইরে। গত ডিসেম্বরে আন্দোলনের অংশ হিসেবে তাদের সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ করেন। 

নির্বাচন কমিশন আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম বা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বেশ কিছু দল ইভিএমের বিরোধী ছিল। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ চেয়েছিল ৩০০ আসনেই ইভিএমে ভোট হোক। ইসি বলেছে, কোনো রাজনৈতিক দলের চাপে তারা এ সিদ্ধান্ত নেয়নি।

ইসির সর্বশেষ সিদ্ধান্তে ইভিএম বিতর্কের অবসান হলেও নির্বাচনী বিতর্ক শেষ হচ্ছে না। যেমনটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ভোট ইভিএম বা ব্যালট পেপারে করা মোটেই বড় চ্যালেঞ্জ নয়। বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রধান দলগুলো আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কি না।

এ বিষয়ে কমিশনের বেশি কিছু করার নেই উল্লেখ করে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকেই নিজেদের মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করার তাগিদ দিয়েছেন। সিইসি এ-ও বলেছেন, ‘নির্বাচনে যদি বড় দলগুলো একবারেই অংশগ্রহণ করল না, নির্বাচনের লিগ্যালিটি নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না, কিন্তু লেজিটিমেসি শূন্যের কোঠায় চলে যেতে পারে।’ (প্রথম আলো, ৭ এপ্রিল ২০২৩)

এ মুহূর্তে সূক্ষ্ম সুতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও তাদের জোটসঙ্গীরা এবং বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো মুখোমুখি অবস্থানে। এর সমাধান কী? উত্তম সমাধান হলো সিইসি যেমনটি বলেছেন, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর একটি সমঝোতায় আসা। তাঁরা নিজ নিজ দলের নীতি ও আদর্শ নিয়ে জনগণের কাছে যাবেন। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরবেন। কিন্তু একটি বিষয়ে একমত হবেন যে কেউ কারও ভোটাধিকার হরণ করবেন না।

আসল প্রশ্নটা এখানেই। ইসি নিয়ম রক্ষার একটি নির্বাচন করবে, না সব দলের অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করবে? সিইসির বক্তব্যে অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হলে সেটা কীভাবে সম্ভব হবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে ইসি কিছু করতে না পারলেও নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে কিছু সাহসী পদক্ষেপ নিতে পারে।

তারা রাজনৈতিক দলসহ নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলেছে। কিন্তু তাদের বেশি কথা বলতে হবে সরকারের সঙ্গে। সংবিধান তাদের হাতে ‘অগাধ ক্ষমতা’ দিয়েছে। কিন্তু বিষয়টি এমন নয় যে তারা  ‘হও’ বললেই নির্বাচন হয়ে যাবে। নির্বাচন করতে যে বিশাল জনবল প্রয়োজন, তার জোগান কে দেবে? শান্তিরক্ষায় যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দরকার, সেটাই–বা আসবে কোথা থেকে? সরকারকেই করতে হবে। 

সংবিধানে আছে, ‘নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনের জন্য যেরূপ কর্মচারীর প্রয়োজন হবে, নির্বাচন কমিশন অনুরোধ করলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনকে সেই রূপ কর্মচারী প্রদানের ব্যবস্থা করবেন।’ সংবিধানে ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা আছে। কিন্তু না করলে নির্বাচন কমিশন কোনো আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবে কি না, সে কথা বলা হয়নি।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় ইসি সেনাবাহিনী মোতায়েনের জন্য সরকারকে অনুরোধ করেছিল, তারা রাজি হয়নি। দ্বিতীয়ত, প্রজাতন্ত্রের যে কর্মচারীরা নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়োজিত হবেন, তাঁরা যে নিরপেক্ষভাবে কাজ করবেন, সেই নিশ্চয়তা কে দেবে? অতীতে রউফ কিংবা নূরুল হুদা কিংবা রকিব কমিশন সেই নিশ্চয়তা আদায় করতে পারেনি। কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন কতটা পারবে, সেটাই দেখার বিষয়। এটা সততার বিষয়।

আইন দিয়ে সবকিছু কার্যকর করা যায় না। যাঁদের নির্বাচনী দায়িত্ব দেওয়া হবে, তাঁরা কোনো দল বা প্রার্থীর প্রতি পক্ষপাত দেখাবেন না, ইসিকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে আইন সংশোধন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমে সব পক্ষের খবর প্রচার করতে হবে। তৃতীয়ত, সব দলকে অবাধে সভা-সমাবেশ করতে দিতে হবে। চতুর্থত, ফৌজদারি মামলার নামে বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন বন্ধ করতে হবে।

পৃথিবীর আর কোনো দেশে নির্বাচন নিয়ে এত কথা হয় না, বিতর্ক হয় না। রাজনীতিকেরা সেই বিতর্ক করেন। নিজের পক্ষে যুক্তির চেয়ে প্রতিপক্ষের মুখ ম্লান করতে তাঁরা বেশি সচেষ্ট থাকেন। তঁারা জনস্বার্থের দোহাই দিয়ে যে আইন করেন, সেই আইন বাতিলও করেন জনস্বার্থের কথা বলে। আইন করার সময় তাঁরা এক যুক্তি দাঁড় করেন। আইন বাতিল করার সময় আরেক যুক্তি দেন। রাজনীতিকেরা এই স্ববিরোধিতা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে দেশে কখনোই সুষ্ঠু নির্বাচন ও ন্যূনতম গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারাও বক্তৃতা–বিবৃতিতে বলেন, তাঁরা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চান। বিরোধী দলের নেতারাও বলেন, তঁারা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছেন। তাহলে নির্বাচনটি সুষ্ঠু হচ্ছে না কেন?  

 যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতার বাইরে থাকতে সর্বাত্মক আন্দোলন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে, সেই দলই ক্ষমতায় গিয়ে তত্ত্বাবধায়কের নাম শুনতে পারে না। আবার যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানতে রাজি ছিল না, বিরোধী দলে গিয়ে তারাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য সংগ্রাম করছে। 

যে দেশে গণতন্ত্র ঠিকঠাকমতো কাজ করে, সে দেশে নির্বাচনের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখার দরকার হয় না। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আমরা একবার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারের পতন ঘটাই। একবার দেশের প্রধান বিচারপতিকে ত্রাতা হিসেবে ডেকে আনি। আবার প্রয়োজন ফুরালে তাঁকে পরিত্যাগ করতেও দ্বিধা করি না। 

এত কিছুর পরও আমাদের দেশে গণতন্ত্রের যে সমস্যা, তা সমাধানের চেষ্টা করি না। ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিকেরা যে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা বদলে দিতে চেষ্টা করেন, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিরোধী দলে থাকতে আমাদের রাজনীতিকেরা গণমাধ্যমের পরম বন্ধু হন। আবার তাঁরাই সরকারে গেলে গণমাধ্যমকে শত্রু ভাবেন।

এ মুহূর্তে সূক্ষ্ম সুতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও তাদের জোটসঙ্গীরা এবং বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো মুখোমুখি অবস্থানে। এর সমাধান কী? উত্তম সমাধান হলো সিইসি যেমনটি বলেছেন, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর একটি সমঝোতায় আসা। তাঁরা নিজ নিজ দলের নীতি ও আদর্শ নিয়ে জনগণের কাছে যাবেন।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরবেন। কিন্তু একটি বিষয়ে একমত হবেন যে কেউ কারও ভোটাধিকার হরণ করবেন না। প্রত্যেক নাগরিক নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়ে নিরাপদে ঘরে ফিরে আসতে পারবেন। কেউ দিনের ভোট রাতে দেবেন না কিংবা ভোটের আগের দিন গিয়ে কোনো প্রার্থী বা তাঁর লোকজন কোনো এলাকায় গিয়ে বলবেন না যে ‘আমরাই আপনার ভোটটি দিয়ে দেব, আপনাকে আর কষ্ট করে কেন্দ্রে যেতে হবে না।’ 

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com