ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি

মতামত

বিদ্রোহ থেকে পারমাণবিক অস্ত্র কি ইরানকে বাঁচাবে

সিরিয়ার পরিস্থিতির পর ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র ভীত যে তেহরান একটি পারমাণবিক বোমা তৈরি করবে। তাদের হুমকি হয়তো এমন ফলাফলের কারণ হতে পারে। পাঁচ দশকের অত্যাচারে শিকলে সীমাহীন যন্ত্রণা সহ্য করার পর সিরিয়ার জনগণ স্বাধীনতাকে বেছে নিয়েছে। পরবর্তী বিপ্লবের জন্য কে প্রস্তুত? সেটা ইরান নয় তো?

১৯৭৯ সালে শাহের পতনের পর থেকে ক্ষমতায় থাকা কঠোর ধর্মতান্ত্রিক শাসনের আকস্মিক পতন ঘটবে? এমনটা না হওয়ার দিকেই পাল্লা ভারী। কিন্তু যা ভাবা যায় না, তা–ও তো ঘটে। সিরিয়া এর প্রমাণ। আসাদ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে ইরান কীভাবে চলবে, তা নিয়ে তেহরানে তীব্র বিতর্ক চলার কথা। সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ও জ্যেষ্ঠ নেতাদের দেশের ভবিষ্যৎ পথচলা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্ত নিতেই হবে।

খামেনির পছন্দের পথকে এভাবে বলা যায়—অভ্যন্তরীণ ক্ষোভ কঠোরভাবে দমন করা, পশ্চিমকে উপেক্ষা করা এবং সম্ভবত মার্কিন–সমর্থিত ইসরায়েলি হামলা প্রতিহত করতে দ্রুত পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করা। এর বিকল্প হচ্ছে অন্য পথে হাঁটা—সংস্কারকে আলিঙ্গন করা, আঞ্চলিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা কমানো, আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক মেরামত করা। আর এসবের মাধ্যমে ঘরোয়া বিদ্রোহের সম্ভাবনা কমানো।

খামেনির বেছে নেওয়া পথ তাত্ত্বিকভাবে বিদ্যমান ছিল ১৯৮০-এর দশকে। তখন আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির প্রতিষ্ঠিত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইসরায়েল ধ্বংসে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। সেই উদ্দেশ্য নিয়ে গোপন পারমাণবিক কার্যক্রম শুরু হয়। ইরানের প্রতিরক্ষা বাহিনী ও মিত্ররা লেবানন, সিরিয়া ও গাজায় পরাজিত হয়েছে। এ কাজ এখনই সফল করতে হবে। এ বছর ইসরায়েল-ইরান সংঘাত থমকে আছে। খামেনি কি পারমাণবিক অস্ত্রকে তাঁর শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার উপায় মনে করছেন?

ইসরায়েলের যুদ্ধক্ষেত্রে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু উচ্ছ্বসিত। মধ্যপ্রাচ্যকে তিনি নিজের সুবিধামতো ঢেলে সাজানোর আশা করছেন। এ অঞ্চল এখন ইসরায়েলি বাহিনীর সামনে এক উন্মুক্ত যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়ে আছে। নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নেতানিয়াহুর পাশে আছেন। অন্তত নেতানিয়াহু তা–ই মনে করেন। ইরানকে সব সময়ই তিনি চূড়ান্ত হুমকি হিসেবে দেখিয়ে এসেছেন। বলেছেন, আগে বা পরে ইরানকে মোকাবিলা করতেই হবে ইসরায়েলের।

এই ‘আগে’ শিগগিরই আসতে পারে। ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে ট্রাম্প বলেছেন, ‘কিছুই অসম্ভব নয়।’ এক জ্যেষ্ঠ ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তা সম্প্রতি একটি ব্রিফিংয়ে বলেছেন, ‘বিমানবাহিনী ইতিমধ্যে পরবর্তী বড় দায়িত্বের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট তা পছন্দ করার কথা। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলার জন্য নতুন পরিকল্পনা করার পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনুকূল, সুযোগও বেশি।’

ইরানকে এখন পথ বেছে নিতে হবে। হয় ইরান উত্তর কোরিয়ার পথ অনুসরণ করবে, যে উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের খোলাখুলি প্রচেষ্টায় আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। অথবা তারা ইউক্রেনের মতো হবে, যারা ১৯৯৪ সালে তাদের পারমাণবিক অস্ত্র ছেড়ে দিয়েছিল পশ্চিমাদের সঙ্গে মিশে গিয়ে নিরাপত্তার নিশ্চয়তার বিনিময়ে। ইউক্রেনের কিছু মানুষ সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে অনুতপ্ত। তাঁরা বিশ্বাস করেন, ইউক্রেন পারমাণবিক অস্ত্রধারী হলে রাশিয়া আক্রমণ করত না।

এমন প্রকাশ্য হুমকি হয়তো ধোঁকা। কিন্তু খামেনির তা মেনে নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। তিনি কি পারমাণবিক অস্ত্রকেই তাঁর ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার শেষ উপায় মনে করবেন? এ মাসে জাতিসংঘের পরিদর্শক দল ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পে ‘নাটকীয় ত্বরান্বিতকরণ’-এর বিষয়টি তুলে ধরেছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি গত সপ্তাহে প্রত্যাহার করা সব নিষেধাজ্ঞা পুনরায় প্রয়োগের হুমকি দিয়েছে।

ট্রাম্প সম্প্রতি ইরানের সঙ্গে আলোচনায় ফিরে আসার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ইরান জোর দিয়ে বলছে, তারা একটি কূটনৈতিক সমাধান চায় আর পারমাণবিক অবাধ্যতার অভিযোগগুলো ‘ভিত্তিহীন’। ট্রাম্প হয়তো নেতানিয়াহুকে সংযত করতে পারেন, যাতে আরেকটি যুদ্ধের ঝুঁকি তৈরি না হয়। আবার তিনি হয়তো তা করবেন না। ট্রাম্পকে নিয়ে কোনো আগাম ধারণা করা কঠিন।

ইরানকে এখন পথ বেছে নিতে হবে। হয় ইরান উত্তর কোরিয়ার পথ অনুসরণ করবে, যে উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের খোলাখুলি প্রচেষ্টায় আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। অথবা তারা ইউক্রেনের মতো হবে, যারা ১৯৯৪ সালে তাদের পারমাণবিক অস্ত্র ছেড়ে দিয়েছিল পশ্চিমাদের সঙ্গে মিশে গিয়ে নিরাপত্তার নিশ্চয়তার বিনিময়ে। ইউক্রেনের কিছু মানুষ সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে অনুতপ্ত। তাঁরা বিশ্বাস করেন, ইউক্রেন পারমাণবিক অস্ত্রধারী হলে রাশিয়া আক্রমণ করত না।

এভাবে দেখলে, ইরানের সামনে থাকা সিদ্ধান্তটি অত্যন্ত মৌলিক। এ সিদ্ধান্ত তাদের ধর্মীয় স্বৈরতান্ত্রিক পরিচয় এবং বিশ্বে ভবিষ্যৎ অবস্থানকে গভীরভাবে প্রভাবিত করবে। ৮৫ বছর বয়সী খামেনি হয়তো এ বিষয়ে ধোঁয়াশা করার চেষ্টা করবেন। তবে তা অনির্দিষ্টকালের জন্য সম্ভব নয়। একদিকে ব্যয়বহুল বিদেশি যুদ্ধ। আরেক দিকে লজ্জাজনক সামরিক পরাজয়। এর সঙ্গে মিলেছে দেশের ভেতর অজনপ্রিয়তা, গণতান্ত্রিক বৈধতার অভাব, অর্থনৈতিক ব্যর্থতা, সহিংস দমন-পীড়ন। এগুলো সব মিলে ইরানে নতুন আন্দোলনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

বিশ্লেষক করিম সাদজাদপুর বলেছেন, নাগরিক অস্থিরতার দিক দিয়ে ইরান বিশ্বের সবচেয়ে অস্থিতিশীল সরকারগুলোর মধ্যে একটি। ‘গত ১৫ বছরে ইরানে তিনটি বড় জাতীয় অভ্যুত্থান ঘটেছে—২০০৯, ২০১৯ ও ২০২২ সালে। এগুলোতে লক্ষাধিক নাগরিক রাস্তায় নেমে এসেছিল।’

ইরানের অভিজাত শ্রেণি আসাদের পতনে হতবাক হয়েছেন। নিজেদের আর আগের মতো নিরাপদ তাঁরা ভাবতে পারবেন না। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি সিরিয়ায় আসাদের পতনের পর বলেছিলেন, ‘কেউ এটা বিশ্বাস করতে পারছিল না।’ খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতি, যুবকদের বেকারত্ব, নির্বিচার ফাঁসি ও মানবাধিকার লঙ্ঘন, সরকারি দুর্নীতি, বিদ্যুৎ–বিভ্রাট ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে জনগণের অসন্তোষ বোমার মতো হয়ে আছে। বিস্ফোরিত হতেই পারে যেকোনো সময়।

  • সাইমন টিসডাল অবজারভার–এর পররাষ্ট্রবিষয়ক ভাষ্যকার

  • দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত