মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌
মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌

অভিমত

আ.লীগ ও বিএনপির বৈরিতার ভেতর–বাহির

মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌ রাজনীতি ছেড়ে দিলেও রাজনীতি তাঁকে ছাড়েনি। বিশেষ করে ১৯৯১-২০০৭ পর্বের রাজনীতিকে তিনি অবলোকন করেছেন কখনো প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে, কখনো অনুঘটক হিসেবে।

মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌র আমার জীবন আমার সংগ্রাম বইয়ে তাঁর ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও পেশাগত জীবনের পাশাপাশি গত ছয় দশকের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ উঠে এসেছে। উনসত্তরে ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) ও এনএসএফের একাংশকে নিয়ে। চার সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পাশাপাশি ডাকসুর সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এই আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

উনসত্তরে মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌ ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন) সাধারণ সম্পাদক। পরবর্তীকালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টি–এমএল ও ভাসানী–ন্যাপের সঙ্গেও সক্রিয় ছিলেন। ১৯৭০ সালে স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা গঠনের প্রস্তাব দেওয়ার দায়ে পাকিস্তান সরকার তাঁকে এক বছরের কারাদণ্ড দেয়। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসই তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলেন। ১৭ ডিসেম্বর মুক্তি পাওয়ার পর সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দিলেও পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপনা দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগে যোগ দেন। মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সহ–উপাচার্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

এরশাদের ‘মিয়ানমার মডেল’

আমার জীবন আমার সংগ্রাম মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌ বাঙ্গালা গবেষণা

মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌র আত্মজীবনী পাঠ করলে বোঝা যায়, রাজনীতি ছেড়ে দিলেও রাজনীতি তাঁকে ছাড়েনি। বিশেষ করে ১৯৯১–২০০৭ পর্বের রাজনীতিকে তিনি অবলোকন করেছেন কখনো প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে, কখনো অনুঘটক হিসেবে। ১৯৮২ সালে এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থান সম্পর্কে মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌র পর্যবেক্ষণ, ‘বেশ কিছুদিন ধরে এরশাদ বলে আসছিলেন, দেশ পরিচালনায় সামরিক বাহিনীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।’...দেশ পরিচালনায় এ ধরনের মডেল মিয়ানমারে চালু আছে। এর ফলে মিয়ানমারের জনগণের শান্তি ও স্বাধীনতা কার্যত হারিয়ে গেছে।

১৯৮২ সালে ক্ষমতায় আসার পর এরশাদ এক সহপাঠী সেনা কর্মকর্তাকে দিয়ে মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌কে উপদেষ্টা হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন (অবসর নেওয়ার পর যিনি পরে আওয়ামী লীগেও যোগ দিয়েছিলেন)। কিন্তু তিনি সামরিক সরকারকে সহযোগিতা করতে রাজি হননি। তাঁর মন্তব্য, ‘ক্ষমতালিপ্সু সেনাপতি বলতে যদি কেউ থাকেন, তিনি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ছয় মাসের মাথায় ক্ষমতায় আসেন এবং রাজনৈতিক শক্তিগুলোর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তিনি ৯ বছর দেশ শাসন করেছেন।’ তিনি মনে করেন, ‘এরশাদবিরোধী আন্দোলনের চেতনাই ছিল স্বৈরতন্ত্রের অবসান। আজ হয়তো সামরিক স্বৈরতন্ত্র নেই, কিন্তু টিকে আছে স্বৈরতান্ত্রিক ধ্যানধারণা।’

‘বিএনপিরই জয় হবে’

এরশাদের পতনের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে। সেই সময়ের অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতে গিয়ে মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌ লিখেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় লাউঞ্জে তখন আরও অনেক শিক্ষক ছিলেন। কথা উঠল নির্বাচন নিয়ে, কোন দল কয়টি আসন পাবে। আমরা দুজন বাদে (লেখক ও আর আই চৌধুরী) বাদে সবাই বললেন, আওয়ামী লীগ জিতবে। আমরা একমত হতে পারলাম না। আমরা বললাম, বিএনপিরই জয় হবে। সত্যি সত্যি সেই নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়েছিল।’

বিরোধী দলের সঙ্গে খালেদা জিয়ার সমঝোতা

১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা নির্দলীয় সরকারের দাবিতে পদত্যাগ করে তীব্র আন্দোলন করে—এটা সবারই জানা। কিন্তু মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌ জানাচ্ছেন অন্দরমহলের কথা। লিখেছেন, দাবি মেনে নেওয়ার বিষয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে সরকারের একটা সমঝোতা হয়েছিল। বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন কর্নেল (অব.) অলি আহমদ। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বেতার–টিভিতে ঘোষণা দেওয়ারও কথা ছিল। কিন্তু ব্যক্তিগত সচিব সাবিহউদ্দিনের নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিতে খালেদা জিয়াকে না করেন। এ অবস্থায় সরকার থেকে জানানো হলো বিরোধী দলের দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। তাদেরও হরতাল–অবরোধ করবে না বলে ঘোষণা দিতে হবে। বিরোধী দল থেকে বলা হলো ‘আমরা মুচলেকা দিয়ে রাজনীতি করি না।’

১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌ লিখেছেন, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন বয়কটের ফলে যে কয়েকটি একতরফা এবং বিতর্কিত সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে ২৮৯টি আসনে বিএনপি, ফ্রিডম পার্টি ১টি ও ১০ জন স্বতন্ত্র সদস্য নির্বাচিত হন। এই সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইন পাস করার পর ভেঙে দেওয়া হয়।

মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় আলোচনার প্রস্তাব

নির্বাচনের আগে বিএনপির পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের একজন জ্যেষ্ঠ নেতার (তোফায়েল আহমেদ) সঙ্গে আলোচনার জন্য মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌কে পাঠানো হয়েছিল। দুজনই ছিলেন উনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থানের নেতা। তাঁরা কয়েক দফা অনানুষ্ঠানিক কথাও বলেছিলেন। মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌ লিখেছেন, ‘তাঁর (খালেদা জিয়া) নির্দেশ অনুযায়ী জনাব তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে আমার বেশ কটি বৈঠক হয়েছে।’ দু–তিনটি বৈঠকের পর তোফায়েল আহমেদ প্রস্তাব করলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের তিন–চারজন করে একটি ডিনারে মিলিত হতে পারেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত আনন্দের সঙ্গে আতিথ্য করতে রাজি আছেন। তাঁদের মধ্যে যখন আলোপ–আলোচনা হবে, তখন মার্কিন রাষ্ট্রদূত উপস্থিত থাকবেন না।’ মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে বৈঠকের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া গ্রহণ করেননি।

কূটনীতিকদের অনুরোধে ফল মেনে নেন

১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪৬টি আসন পেয়ে জাতীয় পার্টি ও জাসদের (রব) সহায়তায় সরকার গঠন করে। খালেদা জিয়া প্রথমে এই ফলাফল মানতে চাননি। বিএনপির নেতারা ১১৯টি আসনে কারচুপি হয়েছে বলে অভিযোগ করলেন। কীভাবে তিনি রাজি হলেন, মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌ সেই সময়ের বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন, ‘আমরা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ৬ মইনুল রোডে অবস্থিত ম্যাডাম খালেদা জিয়ার বাসভবনে এসে হাজির হই। তখন ঘড়ির কাঁটায় ৯টা বাজছিল। দেখলাম, বিএনপির নেতৃবৃন্দ আসতে শুরু করেছেন।

কিছুক্ষণের মধ্যে ৯টি ইউরোপীয় দেশের রাষ্ট্রদূতেরাও এসে হাজির হলেন। তাঁরা সবাই একযোগে বেগম খালেদা জিয়ার সংসদীয় দায়িত্ব পালনে অনুরোধ জানালেন। বেগম জিয়া সব সময় উন্নয়ন অংশীদারদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চেয়েছেন। তিনি তাঁদের অনুরোধ ফেলতে পারেননি।’ তখন খালেদা জিয়ার তথ্য উপদেষ্টা ছিলেন আনোয়ার জাহিদ। রাতে বিএনপির পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে তিনি জানিয়ে দিলেন, নির্বাচনের ফলাফলে জনমতের সঠিক প্রতিফলন না হওয়া সত্ত্বেও বিএনপি গণতন্ত্রের স্বার্থে সংসদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান জাতির উদ্দেশে দেওয়া বিদায়ী ভাষণে বলেছিলেন, ‘রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রতি আমার একটি বিশেষ আবেদন রইল। নতুন জাতীয় সংসদকে কেন্দ্র করে আপনারা এমন রাজনৈতিক রীতি রেওয়াজ গড়ে তুলুন, যেন ভবিষ্যতে আর কোনো দিন রাজনৈতিক কোনো সমস্যা সমাধানে রাজপথের আশ্রয় নিতে না হয়। কিছুদিন সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে যে সীমাহীন অসহিষ্ণুতা দেখেছি, ভবিষ্যতে যেন আর কাউকে অসহিষ্ণুতা ও রাজনৈতিক উত্তেজনা দেখতে না হয়, তার প্রক্রিয়া সৃষ্টি করুন।’

রাজনৈতিক নেতৃত্ব যে তাঁর আহ্বানকে আমলে নেয়নি, পরবর্তী রাজনীতিই তার প্রমাণ। গত ২৭ বছরে রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে অসহিষ্ণুতা ও অসহযোগিতা আরও বেড়েছে। আগে তাঁরা সমস্যা সমাধানে লোকদেখানো হলেও কথাবার্তা বলতেন। এখন সেটিও নেই।

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের তাগিদ

মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌ তাঁর বইয়ে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নির্ধারিত নির্বাচনের আগের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ায় অন্তত কে এম হাসানকে ঠেকানো গেছে এই ভেবে ব্যাপারটাকে আওয়ামী লীগ তাদের আন্দোলনের প্রাথমিক বিজয় বলে গণ্য করতে থাকে।’ তাঁর জন্য পরিস্থিতি প্রতিকূল হয়ে উঠল, যখন নিরপেক্ষভাবে কাজ করার পরিবেশ নেই কারণ দেখিয়ে ১০ উপদেষ্টার মধ্যে চারজনই পদত্যাগ করলেন।

মাহবুব উল্লাহর লেখা থেকে আমরা আরও জানতে পারি, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলই এরশাদকে জোটে নেওয়ার চেষ্টা করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী হলেন। এরপর ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার এরশাদের কিছু পুরোনো মামলা পুনরুজ্জীবিত করলে তাঁর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যায় এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সব বিরোধী দল নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়। তিনি যোগ করেন, ‘সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে নানা কৌশল গ্রহণ করেছিলেন পশ্চিমা কূটনীতিকেরা।’ ইউএনবিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী বলেন, বৈধ ও গ্রহণযোগ্য সরকার নিশ্চিত করতে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা তাঁর এ বক্তব্যকে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ ও কূটনৈতিক শিষ্টাচারবর্জিত অভিহিত করেন।

মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌র বই থেকে আমরা আরও জানতে পারি, ১০ জানুয়ারি (২০০৭) জাতিসংঘের মহাসচিবের মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচনের জন্য তাঁরা কোনো কারিগরি সহায়তা দেবেন না। জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের জন্য ঢাকায় যে অফিস খুলেছিল, সেটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়।

সে সময় বিএনপির নেতারা যেভাবে যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিবৃতিতে উষ্মা প্রকাশ করতেন, এখন আওয়ামী লীগ নেতারাও একইভাবে উষ্মা প্রকাশ করে চলেছেন।

‘দেশের ভয়াবহ অবস্থা’

এর আগের একটি ঘটনা। তৎকালীন নবম ডিভিশনের প্রধান জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী এক বিয়ের অনুষ্ঠানে বইয়ের লেখক মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌কে একান্তে ডেকে বলেছিলেন, তিনি যেন খালেদা জিয়াকে দেশের ভয়াবহ অবস্থার কথা এবং ঘুষ–দুর্নীতি ও নিয়মনীতি ভঙ্গের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেন। উত্তরে মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌ তাঁকে জানান, ‘এটা বলার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি তিনি নন।’

 মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌ আরও লিখেছেন, ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির কয়েক দিন আগে সামরিক বাহিনী কিছু একটা করতে পারে বলে গুজব শোনা গেলে বিএনপির নেতারা তা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন।

২০০৮ সালের নির্বাচন সম্পর্কে খালেদা জিয়ার নির্বাচনী প্রচার দলের এক নারী সদস্যের বরাত দিয়ে মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌ লিখেছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন নাকি নির্বাচনের আগেই বুঝেছিলেন যে তাঁর দল ৩০টির বেশি আসন পাবে না বা দেওয়া হবে না। এরপরও বিএনপির কর্মী ও সমর্থকদের মনোবল ফিরিয়ে আনতে তিনি নির্বাচনী প্রচার চালান।

২০১৪ সালের নির্বাচনে যাওয়া না–যাওয়া বিতর্ক

২০১৪ সালের নির্বাচনে যাওয়া না–যাওয়া নিয়ে বিএনপিতে যে বিতর্ক ছিল, সেই বয়ানও তুলে ধরেন লেখক। নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়া তাঁর কার্যালয়ে বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের সঙ্গে আলোচনা করেন। মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌ নিজেও উপস্থিত ছিলেন সেখানে। তিনি লিখেছেন, ‘কারও কারও বক্তব্যে মনে হয়েছিল বিপ্লব আসন্ন এবং এই বিপ্লবে আওয়ামী লীগ ধরাশায়ী হবে।’ সেই বৈঠকে একমাত্র তালুকদার মনিরুজ্জামান বলেছিলেন, ‘বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেওয়া উচিত।’ মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌ নিজে নির্বাচন বর্জনের পক্ষে মত দিয়েছিলেন। তবে তিনি মনে করেন, বিএনপি নির্বাচনে যাওয়া না–যাওয়ার সিদ্ধান্ত আগেই নিয়েছে। বুদ্ধিজীবীদের মতামতে সেই সিদ্ধান্ত বদলাবে না।

মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌ তাঁর আত্মজীবনীতে বিএনপি আমলে বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্কের ওপরও আলোকপাত করেছেন। তিনি লিখেছেন, বিএনপির ২০০১–২০০৬ আমলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি ঘটলেও ২০১২ সালে খালেদা জিয়ার দিল্লি সফরে সেটা বদলে যায়। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ভারতের কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড দখল করতে দেবে না এবং অতীত দূরে রেখে ভারতের সঙ্গে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নতুনভাবে গড়ে তোলার কথা বলেছিলেন তিনি।

প্রত্যুত্তরে ভারতও বিএনপি নেতৃত্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার আশ্বাস দেন। কিন্তু ২০১৩ সালের ৩ মার্চ ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সফরের সময় খালেদা জিয়া পূর্বনির্ধারিত বৈঠক বাতিল করায় ভুল–বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। এ থেকে ভারত সিদ্ধান্তে আসে, ‘খালেদা জিয়া ও বিএনপিকে আস্থায় নেওয়া যায় না।’

সেই অনাস্থার দায় বিএনপিকে এখনো বহন করতে হচ্ছে।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি