‘দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়িয়েছে দ্বারে’

আজ বিজয়া দশমী। ১৯৯৫-এর ৫ অক্টোবর এমনই বিজয়া দশমীতে আনন্দ ও বেদনার ঢাক-বাদ্যের সমারোহে ত্বকীর জন্ম। সে এক স্বপ্নজাগানিয়া আয়োজন, উৎসব। স্বপ্নের জাল ছিন্ন করে কখন যে দুঃস্বপ্ন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, তা আমাদের হিসাবে থাকে না। সময় আমাদের মাথা ও বুকের ভেতর থরে থরে জমতে থাকা কথা ও স্বপ্নের পরতে পরতে জমিয়ে তোলে ধুলার আস্তরণ। জীবনের যে কথা স্পর্ধিত, গৌরবের, পাখা ছড়িয়ে ওড়া প্রজাপতির মতো উচ্ছ্বসিত অথবা শায়কবিদ্ধ পাখির ঝাপটানো ডানায় ছড়িয়ে দেওয়া দুঃখের, বেদনার—সব ঢাকা পড়ে যায়। কখনো কখনো ধুলার সে আস্তরণ ঠেলে বেরিয়ে আসে আনন্দ অথবা দুঃখের হিরণ্ময় পাথরের স্মৃতি। ত্বকীর জন্মদিনটি আমাদের কাছে তেমনই এক পাথুরে স্মৃতি। যে দিনটি একসময় ছিল বর্ণিল এক অনাবিল উৎসব, সুবাস ছড়িয়ে দেওয়া ফুলের সমারোহ; এখন তা কেবলই হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগিয়ে তোলার অনুভব।

ত্বকীর বেড়ে ওঠা শহর নারায়ণগঞ্জ। এ শহরে ঐতিহ্য, প্রাণপ্রাচুর্যের কমতি ছিল না। শহরের পথ, ফুটপাত, অলিগলি, বৃক্ষ, বন্দর, নদী—সব চেনা। সবকিছুর সঙ্গেই রয়েছে এক নিবিড় পরিচয়। কিন্তু নিষ্ঠুরতা আর নৃশংসতা যখন রাজনীতির অনিবার্য অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে, সেখানে ঐতিহ্য আর প্রাচুর্যের অহংকার মুখ থুবড়ে পড়ে, মানুষ বিপন্ন হয়ে পড়ে, সব হারিয়ে কেবলই নিঃসহায় হতে থাকে।

ত্বকী ভালো আবৃত্তি করত, গান গাইত। রবীন্দ্রসংগীত, লালনের গান প্রিয় ছিল। বাংলা ও ইংরেজিতে কবিতা ও ছোট ছোট নিবন্ধ লিখেছে। টলস্টয়, আইনস্টাইনের প্রতি যেমন আকর্ষণ ছিল, আবার প্রাচ্যদর্শন ও সুফিবাদের প্রতিও আকর্ষণ ছিল। শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান—সবকিছুর প্রতি ছিল গভীর অনুরাগ।

সরকার বা রাষ্ট্র মুখে যা-ই বলুক না কেন, এখানে দুর্জনেরে রক্ষা ও দুর্বলেরে আঘাত হানার নিষ্ঠুর নিয়ম কঠোরভাবে প্রচলিত আছে। ত্বকীকে যে টর্চার সেলে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তা শহরের পরিচিত এক আতঙ্কঘর, জল্লাদের আস্তানা। এর আগে এখানে অসংখ্য তরুণ-যুবককে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়েছে। প্রশাসনের সবই জানা। তারপরও টর্চার সেলটি ছিল, বীরদর্পেই মাথা উঁচিয়ে ছিল। ঘাতকেরা হয়তো জানত যে তাদের বিচারের মুখোমুখি করার ক্ষমতা বা ইচ্ছা কোনোটাই সরকার বা রাষ্ট্রের নেই, কখনো হবে না।

ত্বকীর নদী ও সমুদ্রের প্রতি ছিল গভীর ভালোবাসা। বহু নদীতে ওকে নিয়ে বেড়িয়েছি। ৬ মার্চ ২০১৩ নিখোঁজ হলে আমরা এখানে-সেখানে কত-না জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেছি। কিন্তু দুই দিন পর ত্বকীর ঠিকানা নিশ্চিত হওয়া গেল শীতলক্ষ্যা নদীতে। লাশ হয়ে জেগে উঠল। বিস্ফোরিত চোখে সদর্প স্ফীত বক্ষে যেন নিজেই নিজের জবানবন্দি দিতে উদ্যত। বহুবার এ শীতলক্ষ্যা আমরা একসঙ্গে পাড়ি দিয়েছি। এ আমাদের সাত পুরুষের ঠিকানা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের বেড়ে ওঠার সাক্ষী। এখানেই জেনেছি নিজেকে, দুঃখের মুখোমুখি হয়েছি এখানেই। একাত্তরে বহুবার শীতলক্ষ্যা নদী পাড়ি দিয়েছি। নদীতে অসংখ্য লাশ। শত শত। চারদিক নিস্তব্ধ। বইঠার ঢেউ ভাঙা জলের শব্দের ফাঁকে ফাঁকে মাঝেমধ্যে ভেসে আসত কাক-শকুনের চিৎকার। নদীর অন্তর্লীন অশ্রুপাত তখন দেখেছি, শুনেছি তার অন্তর্গত কান্না। ৮ মার্চ যখন ত্বকীর ক্ষতবিক্ষত দেহ শীতলক্ষ্যার পাড়ে পেলাম; সেদিন শীতলক্ষ্যার পানিতে একাত্তরের কান্না আমি দেখেছি, দেখেছি মানুষের প্রতি নদীর তীব্র ঘৃণা।

ঘাতকের জবানবন্দিতে জেনেছি, ৬ মার্চ রাতেই ত্বকীকে হত্যা করে লাশ শীতলক্ষ্যায় ফেলে রেখে সেই টর্চার সেলে ফিরে গিয়ে তারা বিরিয়ানি খেয়ে উল্লাস করেছিল। জানান দিতে চেয়েছিল সংবিধানে লেখা বাক্যগুলো সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হয় না, পালনীয়ও নয়। সরকার বা রাষ্ট্র মুখে যা-ই বলুক না কেন, এখানে দুর্জনেরে রক্ষা ও দুর্বলেরে আঘাত হানার নিষ্ঠুর নিয়ম কঠোরভাবে প্রচলিত আছে। ত্বকীকে যে টর্চার সেলে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তা শহরের পরিচিত এক আতঙ্কঘর, জল্লাদের আস্তানা। এর আগে এখানে অসংখ্য তরুণ-যুবককে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়েছে। প্রশাসনের সবই জানা। তারপরও টর্চার সেলটি ছিল, বীরদর্পেই মাথা উঁচিয়ে ছিল। ঘাতকেরা হয়তো জানত যে তাদের বিচারের মুখোমুখি করার ক্ষমতা বা ইচ্ছা কোনোটাই সরকার বা রাষ্ট্রের নেই, কখনো হবে না।

তদন্ত সংস্থা র‌্যাবের তথ্য অনুযায়ী, নারায়ণগঞ্জের চিহ্নিত একটি ঘাতক পরিবারের ১১ জন মিলে ত্বকীকে হত্যা করেছে। প্রথমে তারা গজারির লাঠি দিয়ে পিটিয়ে তাকে নিস্তেজ করে। এরপর মাথায় আঘাতের পর আঘাত করতে থাকলে ত্বকী জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তখন ঘাতকেরা তার বুকের ওপর উঠে গলা চেপে শ্বাস রোধ করে ১৭ বছরের অপাপবিদ্ধ কিশোরের মৃত্যু নিশ্চিত করে। ঘাতকেরা তার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ থেঁতলে দেয়, একটি চোখ উপড়ে আনে। ত্বকীর সেই ঘাতকেরা থেকেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ১০ বছরেও তাদের বিচারের আওতায় আসতে হয়নি। সব তথ্যপ্রমাণ পাওয়ার পরও আনা হয়নি। তদন্ত শেষে তদন্ত সংস্থা সংবাদ সম্মেলন করে দ্রুত অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়ার যে ঘোষণা দিয়েছিল, তারা ৯ বছরেও সে রিপোর্ট আদালতে জমা দেয়নি। এ দেশে বিচার বন্ধ রাখার নজিরের অভাব নেই। কিন্তু সব তথ্যপ্রমাণ প্রকাশের পর অপরাধীদের দলীয় আনুগত্যের কারণে তা বন্ধ করে দেওয়ার নজির হয়তো খুব বেশি পাওয়া যাবে না।

আজ ত্বকীর ২৮তম জন্মদিন। তবে ত্বকীর বয়স আর বাড়ছে না। ১৭ বছর ৫ মাসে আটকে গেল একটি জীবনচক্র। কিন্তু তা না বাড়লেও প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে আমাদের রক্তে, চৈতন্যে দুঃখের বিষবৃক্ষ, প্রদোষে প্রাক্কালে কেবলই নিষ্ঠুর সান্ত্বনা। ত্বকীর জন্মদিনের বিজয়া দশমী প্রতিবার অসুর বিনাশ আর শুভশক্তির উদ্বোধনের একটি বার্তা বয়ে আনে। সে বার্তা প্রতিবছরই ঘুরে ঘুরে আসে। কিন্তু সে বার্তার টুঁটি চেপে যদি সরকারের দুর্বৃত্ত রক্ষার নির্লজ্জ আয়োজন অব্যাহত থাকে, তখন রাষ্ট্র নামক যন্ত্রটিকে ফ্রাংকেনস্টাইনের সেই দানবের মতোই মনে হয়।

ত্বকী ‘ফিরে এসো বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি কবিতায় লিখেছে, ‘যুদ্ধের সেই সব নায়করা/ ডাক দিয়ে যায়-/ জাতির জন্য, জেগে ওঠার জন্য/ ওই জাতির জন্য; যারা ধ্বংসের মধ্যেও/ নতুন জীবনের ডাক দিয়ে যায়;/ তুমি কি শুনতে পাও/ সেই সব শহীদদের কণ্ঠস্বর/ যা প্রতিধ্বনি হচ্ছে বহু দিন ধরে?’ সেই কণ্ঠস্বর হয়তো আমরা কেউ শুনতে পাই, কেউবা পাই না। কিন্তু ত্বকী তা শুনতে পেয়েছিল। আর তাই নির্ভয়ে বলতে পেরেছিল, ‘ভয় কিসের? দ্বিধা কেন মৃত্যুতে?’ কিন্তু আমরা তো এর প্রতিকার চাই। যুদ্ধের সেই সব নায়কের, শহীদের প্রতি প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন চাই। এ পাপ থেকে পরিত্রাণ চাই। নয়তো সে পাপে নীলকণ্ঠ থেকে তো উচ্চারিত হতেই থাকবে, ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান,/ অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান!/...দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়িয়েছে দ্বারে/ অভিশাপ আঁকি দিল তোমার জাতির অহংকারে।’

  • রফিউর রাব্বি তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর বাবা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব