উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী বাংলাদেশের নদী জীবন্ত সত্তা। সংবিধান অনুযায়ী নদী-খাল-বিল জনগণের সম্পত্তি। এসবের শ্রেণি পরিবর্তনের আইনগত সুযোগ নেই। ব্যক্তির নামে লিখে দেওয়া বড় অপরাধ। যদি কোনো কারণে এসব ভরাট হয় কিংবা যোগসাজশে ব্যক্তির নামে লিখিত হয়, তবু কাগজে তার শ্রেণি অপরিবর্তিত থাকবে।
১৯৪০ সালের সিএস (ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে) নকশা মোতাবেক যা নদী-খাল-বিল হিসেবে চিহ্নিত, বর্তমানের নতুন ভূমি জরিপে এর এক ইঞ্চিও কমানোর সুযোগ নেই। বরং বাড়বে। একবার নদী-খাল-বিল হিসেবে রেকর্ড হলে নতুন জরিপে তা অপরিবর্তিত থাকবে।
নতুন জরিপে অনুমোদনের সময় পুরোনো নকশা দেখা অপরিহার্য। নয়তো দেশের অধিকাংশ নদী-খাল-বিল মানচিত্র থেকেও হারিয়ে যাবে। আমরা অনেকগুলো নতুন নকশা দেখেছি, যেগুলোতে নদী-খাল-বিলের পরিমাণ কমেছে। কোনো কর্মকর্তা যদি নতুন জরিপের জন্য পাঠানো তথ্যে নদী-খাল-বিলের পরিমাণ কম দেখায়, তখন তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান থাকা প্রয়োজন।
ভূমিদস্যুরা অবৈধ উপায়ে নদী-খাল-বিল গিলে খেতে চাইবে। প্রজাতন্ত্রের একজন বেতনভোগী কর্মচারীর দায়িত্ব এসব রক্ষা করা। নতুন জরিপে অপরিবর্তনীয় জমির শ্রেণি পরিবর্তনকে যদি বড় অপরাধ গণ্য করে নির্দেশনা জারি করা হতো, তাহলে বেঁচে যেত অসংখ্য নদী-খাল-বিল।
কী পরিমাণ জমি কমছে, তার সামান্য দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। কুড়িগ্রামের রাজারহাট-উলিপুর উপজেলায় একটি নদী আছে। স্থানভেদে নাম বুড়িতিস্তা, মরাতিস্তা ও চাকিরপশার। এর একটি স্থানে নাফাডাঙা, খালিসা, সদাগড়, চাকিরপশার তালুক, চান্দামারী—পাঁচটি মৌজা বিল শ্রেণিভুক্ত। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের দেওয়া একটি চিঠির উত্তরে ২০২০ সালের মার্চ মাসে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক উল্লেখ করেছেন, ওই পাঁচটি মৌজায় ৩০৬ একর জমি সরকারের বিল শ্রেণিভুক্ত ছিল।
শুধু তা-ই নয়, যেসব নদী প্রস্থে বেড়েছে, সেগুলো বর্তমান অবস্থার আলোকে নতুন নকশা প্রণয়ন করতে হবে। কেবল নদী-খাল-বিলের ক্ষেত্রেই নয়, শ্রেণি পরিবর্তনযোগ্য নয়, এমন সব ভূমির পুরোনো অবস্থা বজায় রেখেই হতে হবে নতুন ভূমি নকশা। ব্রিটিশরা ছিল শোষক। এরা যদি এত নিরপেক্ষতার সঙ্গে ভূমি জরিপ করতে পারে, তাহলে দেশপ্রেমিক (!) স্বাধীন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা কেন পারবেন না? আমরা দেশের করা নতুন ও বস্তুনিষ্ঠ ভূমি জরিপকেই অনুসরণ করতে চাই।
সম্প্রতি রংপুর বিভাগীয় কমিশনারের একটি চিঠিতে দেখা যায় বর্তমানে সেই পরিমাণ মাত্র ৩৬ দশমিক ২৮ শতক। ২৬৯ দশমিক ৭২ শতক জমি কমেছে। অথচ ওই ৩০৬ একর এখনো প্রাকৃতিকভাবে নিম্নাঞ্চল। রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলায় খটখটিয়া নদীর একটি অংশেই সাড়ে ১৪ একর জমি ব্যক্তির নামে রেকর্ড হয়েছে। নতুন রেকর্ডে এগুলোর শ্রেণি পরিবর্তন হয়েছে। রংপুর-গাইবান্ধা দিয়ে প্রবাহিত নলেয়া নদীর অনেকাংশই ব্যক্তির নামে চলে গেছে।
এমন যদি হয় বাস্তবে নদী-খাল-বিল আছে, সিএস নকশায় উল্লেখ নেই। কিন্তু এসএ (স্টেট অ্যাকুইজিশন সার্ভে) খতিয়ানে উল্লেখ আছে, তাহলেও নতুন জরিপে নদী-খাল-বিল হিসেবে থাকবে। এমনকি বাস্তবতার নিরিখে আরএস (রিভিশনাল সার্ভে) রেকর্ডে নদী-খাল-বিল নতুন করে যুক্ত হলে তা স্বীকৃতি পাবে।
এর কারণ হিসেবে বলা যায়, নদীর জন্ম নেওয়া শেষ হয়নি। অনেক সময় নদী তার পুরোনো প্রবাহে ফিরে যায়। উদাহরণ হিসেবে তিস্তা নদীর একটি নতুন প্রবাহের কথা বলা যেতে পারে। রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার উত্তর দিকে তিস্তা তীরবর্তী বিনবিনার চর। ২০১৭ সালে সেই স্থান থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার তিস্তা নদী পুরোনো প্রবাহে প্রবাহিত হয়েছে।
এই প্রবাহটি নদী নামেই পরিচিতি পাওয়া উচিত। উন্নয়নের চাপে পড়ে নদীগুলো যে পরিমাণ হাঁসফাঁস করছে, তাতে মনে হয় অনেক নদী নতুন পথ বেছে নেবে। সেগুলোও নদী নামে পরিচিত হবে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যে ভূমি জরিপ হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে ভালো ১৯৪০ সালের সিএস জরিপ। ১৮৮৮ সাল থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত এই জরিপ কাজ চালানো হয়। এই জরিপকে ধরেই নতুন জরিপ করতে হবে।
নদী-খাল-বিল দখলদারেরা মনে করেন, একবার যদি তাঁরা খাজনা দিতে পারেন, তাহলে আর কোনো আইন তাঁদের দখল রহিত করতে পারবে না। সাধারণদের মধ্যেও অনেকেই এমনটাই মনে করেন। ফলে নদী-খাল-বিল কখনো কোনোভাবে ব্যক্তির নামে লিখিত হলেই আর কেউ কোনো প্রতিবাদও করেন না। অথচ ভূমি কর্মকর্তা চাইলে খুব সহজে এসব সম্পদ সরকারি সম্পদ হিসেবে ফেরাতে পারেন। বিশেষত, এসব ক্ষেত্রে সহকারী ভূমি কমিশনারকে (এসি ল্যান্ড) ক্ষমতা দেওয়া আছে। অবৈধ দখলদারেরা নিজেদের বৈধ মালিক হিসেবে প্রমাণ করার জন্য যদি ‘ঘাটে ঘাটে’ টাকা ব্যয় করতে হয়, তাই করেন। এই কাজে রসদ জোগায় দুর্বৃত্তরা।
দেশের সংবিধান, আইন, আদালতের রায় আমলে নিলে আগের চেয়ে নদী সংখ্যায় না বাড়লেও নদীর জমির পরিমাণ অনেক গুণ বাড়ার কথা। প্রতিবছর যে পরিমাণ জমি ভেঙে নদীগর্ভে বিলীন হয়, সেগুলোও আইনগতভাবে একটি সময় পরে নদী হয়। এর বিধান আছে। আইনানুযায়ী বড় নদী যেগুলো ক্ষীণকায় হয়েছে, সেগুলো অতীতের ম্যাপ অনুযায়ী নদীর প্রস্থ অপরিবর্তিত থাকবে।
এই হিসাব করলে বলা যায় নদীর জমির পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। সরকারিভাবে যেসব কর্মকর্তার কারণে নদী ব্যক্তির নামে রেকর্ড হচ্ছে, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। আমরা দখলদারদের নিয়ে বিস্তারিত সমালোচনা করি, কিন্তু তাঁদের যাঁরা জমি লিখে দিতে সহায়তা করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে তেমন কথাই হয় না। ব্যক্তির নামে নদী-খাল-বিল-জলাশয়ের জমি লিখে দেওয়া এবং রেকর্ড হওয়া সংবিধান এবং উচ্চ আদালতের রায়ের লঙ্ঘন। যাঁরা সংবিধান লঙ্ঘন করছেন, উচ্চ আদালতের রায়ের লঙ্ঘন করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতেই হবে।
গত কয়েক বছরে দেশের অনেক মৌজার নতুন ভূমি জরিপ (আরএস) নকশা প্রকাশিত হয়েছে। এগুলো এখন পুরোনো নকশার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে নদী-খাল-বিলের জমি কমেছে কি না।
যদি কমে থাকে, তাহলে এগুলো স্থগিত রেখে পুরোনো নকশায় কাজ চালাতে হবে। আর নতুন যে নকশা প্রকাশিত হবে, সেগুলো প্রকাশের ক্ষেত্রে নদী-খাল-বিলের জমি কমছে কি না, দেখতে হবে।
শুধু তা-ই নয়, যেসব নদী প্রস্থে বেড়েছে, সেগুলো বর্তমান অবস্থার আলোকে নতুন নকশা প্রণয়ন করতে হবে। কেবল নদী-খাল-বিলের ক্ষেত্রেই নয়, শ্রেণি পরিবর্তনযোগ্য নয়, এমন সব ভূমির পুরোনো অবস্থা বজায় রেখেই হতে হবে নতুন ভূমি নকশা। ব্রিটিশরা ছিল শোষক। এরা যদি এত নিরপেক্ষতার সঙ্গে ভূমি জরিপ করতে পারে, তাহলে দেশপ্রেমিক (!) স্বাধীন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা কেন পারবেন না? আমরা দেশের করা নতুন ও বস্তুনিষ্ঠ ভূমি জরিপকেই অনুসরণ করতে চাই।
তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক
wadudtuhin@gmail.com