পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের মন্তব্যটি ভারতের সংবাদমাধ্যম লুফে নিয়েছে। ভারতের অনেকগুলো সংবাদমাধ্যম ফলাও করে খবরটি প্রকাশ করেছে। প্রথম আলোর পাঠকেরাও ডন–এর বরাতে খবরটি পড়েছেন।
খবরটির উৎস হলো, গত বুধবার করাচিতে সিন্ধুর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে শাহবাজ শরিফের একটি মতবিনিময় সভা। তিনি দেশটির অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণে ব্যবসায়ীদের সহায়তা চান। অন্যদিকে ব্যবসায়ী নেতারা অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করার ওপর জোর দিয়েছেন। ভারতে মোদি সরকারের আমলে কাশ্মীর রাজ্যের মর্যাদা হরণ করায় ইসলামাবাদ ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়। নয়াদিল্লিও সীমান্ত দিয়ে সন্ত্রাসবাদ চালানের অভিযোগ এনে পাকিস্তানের সঙ্গে ব্যবসা–বাণিজ্য বন্ধ রেখেছে।
কয়েক বছর ধরে পাকিস্তানের অর্থনীতি নাজুক অবস্থায় আছে। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে জেরবার মানুষ। রুপির মান কমে গেছে ব্যাপকভাবে।
স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান বলছে, ২৪ এপ্রিল মার্কিন ডলারের বিপরীতে রুপির দাম ছিল ২২৮ টাকা ৮০ পয়সা। বাংলাদেশে এক ডলারের বিনিময় হার ১০৯ দশমিক ৫০ টাকা। একের পর এক ঋণের বোঝা চেপেছে পাকিস্তানের কাঁধে। এই প্রেক্ষাপটেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর মুখে বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রশংসা।
তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগের অবস্থা উল্লেখ করে বলেন, সে সময় ‘পূর্ব পাকিস্তানকে’ দেশের বোঝা মনে করা হতো। কিন্তু তারা (বাংলাদেশ) শিল্পায়নের প্রবৃদ্ধিতে বিস্ময়কর অগ্রগতি অর্জন করেছে।
শাহবাজ আরও যোগ করেন, ‘আমি তখন খুবই ছোট ছিলাম... আমাদেরকে বলা হতো যে এটা আমাদের কাঁধে একটি বোঝা। আজ আপনারা সবাই জানেন, সেই বোঝা কোথায় পৌঁছেছে (অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে) এবং এখন আমরা যখন তাদের দিকে তাকাই, তখন আমরা লজ্জা বোধ করি।’
১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশ এখন আর্থসামাজিক খাতের প্রায় সব সূচকে পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে, এটা নিঃসন্দেহে আনন্দের কথা। এর আগে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের তারিফ করেছিলেন।
ডন–এর প্রতিবেদনে বলা হয়, মতবিনিময় সভায় প্রধানমন্ত্রী শাহবাজের বক্তব্যের পর প্রশ্নোত্তরপর্ব হয়। সেখানে ব্যবসায়ীরা শাহবাজের নেতৃত্বাধীন সরকারের সাম্প্রতিক পদক্ষেপের প্রশংসা করে বেশ কিছু দাবি জানান।
আরিফ হাবিব গ্রুপের প্রধান আরিফ হাবিব প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, ‘দায়িত্ব নেওয়ার পর আপনি অনেক ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং সুফলও পেয়েছেন। আইএমএফের সঙ্গে চুক্তি এর অন্যতম। আমি সুপারিশ করব, আরও কিছু পদক্ষেপ নিন। এর একটি হলো ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করা। এতে পাকিস্তানের অর্থনীতিই লাভবান হবে। দ্বিতীয়ত, আদিয়ালা জেলের বাসিন্দার (কারাগারে আটক সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পিটিআই নেতা ইমরান খান) সঙ্গেও সমঝোতায় আসুন।’
ডন লিখেছে, পাকিস্তানের অংশ থাকাকালে পূর্ব পাকিস্তান নানা অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিল। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান বৃহত্তর রাজনৈতিক ক্ষমতার পাশাপাশি সম্পদের সিংহভাগ ভোগ করত, যা পূর্ব পাকিস্তানকে অবহেলিত ও অনুন্নত করে রেখেছিল।
মতবিনিময় সভাটিতে ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন, জ্বালানির অতি উচ্চ দাম ও অস্থিতিশীল সরকারি নীতির কারণে ব্যবসা–বাণিজ্য করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা অনুচ্চ কণ্ঠে মাঝেমধ্যে কথাগুলো বলেন। গত বছর যখন ভয়াবহ বিদ্যুৎ ঘাটতি দেখা দেয়, তখন তাঁরা বলেছিলেন, ‘আমরা ভর্তুকি চাই না। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ চাই।’ কিন্তু এবারও সেটা নিশ্চিত হবে বলে মনে হয় না।
সত্য যে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে আছে। বাংলাদেশের জিডিপি ৪৬০ বিলিয়ন ডলার, পাকিস্তানের ৩৪৬ বিলিয়ন ডলার। যদিও বাংলাদেশের চেয়ে পাকিস্তানের জনসংখ্যা প্রায় দেড় গুণ। বাংলাদেশে বার্ষিক মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৭৯৩ মার্কিন ডলার এবং পাকিস্তানে ১ হাজার ৫৪৩ ডলার।
বাংলাদেশের বার্ষিক রপ্তানি আয় ৫৫ বিলিয়ন ডলার, পাকিস্তানের ৩৯ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার, পাকিস্তানে ঘরের বাইরে কাজ করা নারীর সংখ্যা ১৪ শতাংশ, বাংলাদেশে ৩৬ শতাংশ। বাংলাদেশে প্রতি হাজারে শিশুমৃত্যু ২১ জন, পাকিস্তানে ৫৯ জন। বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার ৭৬ শতাংশ, পাকিস্তানে ৫৯ শতাংশ। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৩ বছর। পাকিস্তানে ৬৯ বছর।
এসব অগ্রগতি সত্ত্বেও সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে টেক্কা দিতে পেরেছে, এ কথা বলা যাবে না। যেমন মুক্ত সাংবাদিকতার সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৫ দশমিক ১ স্কোর নিয়ে ১৬৩। পাকিস্তানের অবস্থান ১৫০।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ আছে। ৭৭ বছর বয়সী পাকিস্তান রাষ্ট্রে কোনো প্রধানমন্ত্রী মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি। অথচ তিন সেনাশাসক দীর্ঘ মেয়াদে দেশটি শাসন করেছেন। তারপরও পাকিস্তান এমন একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা চালু করতে পেরেছে, যাতে সব দলের বা মানুষের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন সম্ভব হয়েছে।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের করা এই সূচকে ২০২২ সালে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছিল ১৬২তম স্থানে, ২০২১ সালে ১৫২তম। ২০২০ সালের সূচকে আমাদের অবস্থান ছিল ১৫১তম। এর আগে ২০১৯ সালে ১৫০তম। অর্থাৎ পাকিস্তান গত বছর যে অবস্থানে ছিল, সেটা আমরা ২০১৯ সালেই অর্জন করেছিলাম। ওরা পিছিয়ে থাকা অবস্থা থেকে সামনে এগোচ্ছে, আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি।
যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) প্রকাশ করা ২০২৩ সালের গণতন্ত্র সূচকে (ডেমোক্রেসি ইনডেক্স) ১৬৭টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৫তম। বাংলাদেশের ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র থেকে ‘হাইব্রিড গণতন্ত্রে’ অবনমন হয়েছে। পরের ধাপ পুরোপুরি কর্তৃত্ববাদী শাসন।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ আছে। ৭৭ বছর বয়সী পাকিস্তান রাষ্ট্রে কোনো প্রধানমন্ত্রী মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি। অথচ তিন সেনাশাসক দীর্ঘ মেয়াদে দেশটি শাসন করেছেন। তারপরও পাকিস্তান এমন একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা চালু করতে পেরেছে, যাতে সব দলের বা মানুষের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন সম্ভব হয়েছে।
বাংলাদেশের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের এক মাস পর ৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচনের সময় পিটিআইয়ের নেতা ইমরান খান কারাবন্দী ছিলেন। তাঁর দলের প্রতীক কেড়ে নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তারপরও সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন হয়েছে। ওই নির্বাচনে অনিয়ম ও ভোট কারচুপির দায় নিয়ে একজন পদস্থ আমলা পদত্যাগ ও আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন। আমাদের এখানে কোনো নির্বাচনে কোনো সরকারি কর্মকর্তা এই নজির তৈরি করতে পারেননি।
৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের মানুষ প্রার্থী বাছাইয়ের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানের ভাষায়, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পরই শুরু হয়েছে গণতন্ত্রের অবক্ষয়।’
বিশ্বের ৫০০ সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় পাকিস্তানের ৩টি ও ভারতের ৯টি বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম সরকারের কঠোর সমালোচনা করতে পারে। আমরা পারি না। পাকিস্তানের ব্যবসায়ীরা প্রধানমন্ত্রীকে বলতে পারেন, উন্নয়নের স্বার্থে জেলবন্দী নেতার সঙ্গে ফয়সালা করুন। বাংলাদেশের কোনো ব্যবসায়ী কি বলতে পারবেন?
যদি পারতেন, আরও অনেক বিষয়ে হয়তো পাকিস্তানকে আমরা লজ্জা দিতে পারতাম।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com