কঠিন সময়ের জরুরি দায়

এ দেশের ছাত্র-জনতা বারবার তাদের শক্তি ও সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে। এর প্রথম প্রকাশ ঘটে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। সেদিন ছাত্র-তরুণেরা বাঙালির ন্যায্য দাবি তুলে ধরতে গিয়ে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে তখনো জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা খোদ পাকিস্তানের ¯স্রষ্টা ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মুখের ওপর তাঁর রাষ্ট্রভাষার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল। শেষ পর্যন্ত তারাই বিজয়ী হয়েছিল, পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। 

পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ছাত্র-তরুণদের গণতান্ত্রিক আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ পায় উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে। এর ফলে পাকিস্তানের লৌহমানবখ্যাত শাসক আইয়ুব খানের পতন হয় ও পরবর্তী শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া গণতান্ত্রিক নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

সত্তরের নির্বাচন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ছাত্র-জনতার বিজয়াভিযানের কাল চলেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরাচারের পতনের লক্ষ্যে পরিচালিত নব্বইয়ের গণ-আন্দোলন ছিল ছাত্র-তরুণদের আরেক বিজয়। সেদিনও এরশাদের পতনের পরে অনেকেরই মনে হয়েছিল দেশ পুনরায় স্বাধীনতা লাভ করেছে।

এবারও (২০২৪ সালে) একটি কর্তৃত্ববাদী দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের পতনের পরে একে অনেকেই আরেকটি স্বাধীনতা হিসেবে অভিহিত করছেন। বায়ান্ন থেকে এযাবৎ ছাত্র-তরুণ-জনতার এই ধারাবাহিক সাফল্যের ভিত্তিতে বলা যায়, এ দেশে গণমানুষের অভিপ্রায়ের বাইরে যেকোনো স্বৈর বা একনায়কি শাসন টিকতে পারেনি।

জিন্নাহ থেকে আরম্ভ করে আজতক বহু জনপ্রিয় নেতাকে বিপর্যস্ত হতে দেখেছি আমরা। এর মাধ্যমে হয়তো সমাজের তারুণ্য ও প্রাণশক্তির পরিচয় মেলে কিন্তু প্রজ্ঞা ও পরিপক্বতা পরিচয়ে ঘাটতি দেখা গেছে বারবার। পেছনে তাকালে দেখা যাবে, এ দেশে এ ধরনের অস্থিরতার ইতিহাস সুদীর্ঘ। 

মোগল আমলে বাংলাকে বাগে আনতে না পেরে একপর্যায়ে দিল্লির দরবারে এ কথা চালু হয় যে বাংলার আবহাওয়ায় বিদ্রোহের বীজ পুষ্টি পায়। প্রাচীন ইতিহাসেও দেখা যায়, রাষ্ট্রক্ষমতায় অস্থিরতা যেন এই জনপদের প্রতীক হয়ে উঠেছিল।

প্রাচীন বাংলায় প্রথম সফল রাজত্বের ইতিহাস গড়েছিল পাল বংশ। তাদের প্রায় চার শ বছরের রাজত্বের (৭৫০-১১৫০ খ্রিষ্টাব্দ) আগে এ অঞ্চলে চলেছিল শত বছরের মাৎস্যন্যায় অর্থাৎ অরাজক অবস্থা। আবার বখতিয়ারের বিজয়ের পরে স্বাধীন সুলতানদের ক্ষমতা গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত (১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দ) প্রায় দেড় শ বছর ধরে অরাজক অবস্থা চলেছিল।

সুলতানি শাসনের পরে (১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দ) মোগল বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত আবারও প্রায় অর্ধশতকের অরাজকতা দেখা দিয়েছিল। মোগলদের সুবেদারি শাসন থেকে ইংরেজ আমল হয়ে পাকিস্তান পর্ব পর্যন্ত চলেছে একধরনের ঔপনিবেশিক শাসন। 

২. 

পুরোনো ইতিহাস বেশি ঘাঁটার প্রয়োজন নেই। কারণ, তখনকার অরাজক অবস্থার দায় স্থানীয় জনগণের ওপর পড়ে না। সে ছিল ‘বীরভোগ্যা বসুন্ধরার’ কাল। পৃথিবীর সর্বত্র উচ্চাভিলাষী ভাগ্যান্বেষীদের এমন হানাহানি ছিল কমবেশি স্বাভাবিক ঘটনা।

আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো সাম্প্রতিক কালের ঘটনাবলি। আমি অনেক সময় ভাবি, কখনো লিখেছি, বলেছি, আমরা আন্দোলন-সংগ্রাম অর্থাৎ রাজনীতির ইনফরমাল তথা অনানুষ্ঠানিক খাতে খুবই সফল। আমাদের মুখে ‘মানি না মানব না, আগুন জ্বালো একসাথে’ ইত্যাকার বিদ্রোহী স্লোগানের যেন বিরাম নেই।

কিন্তু এমন ভূমিকা ছাত্র-তরুণদের বারবার কেন নিতে হচ্ছে? কারণ, আন্দোলনের সাফল্যের পরে সমাজ ও রাষ্ট্র সংস্কারের ও গড়ে তোলার যে দায় এসে পড়ে, তার উপযোগী তথা রাজনীতির আনুষ্ঠানিক খাতে আমরা সক্ষমতা দেখাতে পারছি না। এ কাজে বারবার ব্যর্থ হয়েছি। 

বায়ান্নর বিজয়-পরবর্তী প্রাদেশিক নির্বাচনে যা চুয়ান্নর ঐতিহাসিক নির্বাচনী বিজয় হিসেবে পরিচিত হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট এ দেশে মুসলিম লীগের অস্তিত্ব মুছে দিয়ে ভূমিধস বিজয় অর্জন করেছিল। এই বিজয় পর্যন্ত অর্জনকে বলা যায় রাজনীতির অনানুষ্ঠানিক খাতের বিজয়।

তারপরে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে সেই সরকারের পতনের পেছনে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের চক্রান্ত ছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু সেই চক্রান্তের সাফল্যের জন্য যে কতিপয় বাঙালি রাজনীতিকই দায়ী, তা অস্বীকার করা যাবে না। কারও সুবিধাবাদ, কারও আপসপ্রবণতা, কারওবা দোদুল্যমানতা ওদের চক্রান্তকে সফল করে তুলেছিল। 

পরবর্তী নির্বাচনের আগে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য কাজও অনেক। একটি অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্যভাবে সম্পাদনের জন্য সংস্কার ও পুনর্গঠনের কাজ আছে বিস্তর। অথচ যেকোনো বিপ্লবী ঘটনা তো আদতে আইন অতিক্রম করেই ঘটে থাকে। কিন্তু এই মনোভাবের রেশ দীর্ঘস্থায়ী হলে সমাজের নানা ক্ষেত্রে অস্থিরতা বাড়তে ও অন্যায় ঘটতে থাকবে।

৩. 

১৯৭১-এ গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের বিজয় এবং ১৯৯০-এর গণ-আন্দোলনে বিজয়ের পরেও আমাদের সামনে সুযোগ এসেছিল একটি গণতান্ত্রিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠন ও একটি বিকাশমান মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করার। কিন্তু তা আমরা পারিনি।

আমার বিবেচনায় প্রথম সংকটটি ঘটে মানসিকতায় বা চেতনার ক্ষেত্রে। আমরা দুবারই বিজয় অর্জন সত্ত্বেও প্রকৃত বিজয়ীর আচরণ করতে ও ভূমিকা নিতে পারিনি।

দেখা গেছে, আমরা পতিত পক্ষের বিরুদ্ধে ঘৃণা-প্রতিহিংসাচর্চা ও তা চরিতার্থে যত সময় ও শক্তি ব্যয় করি, ততটা করি না রাষ্ট্র গঠনে প্রয়োজনীয় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং সংস্কারমূলক সময়সাপেক্ষ প্রজ্ঞানির্ভর কাজে। অথচ তাতে দেশ বা সরকার দখলে পাওয়ার মানসিকতার প্রকাশ ঘটে, বিজয় অর্জনের নয়। 

দক্ষিণ আফ্রিকার নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা কারামুক্তির পরের ভাবনা জানাতে গিয়ে লিখেছেন, ‘কক্ষ থেকে বেরিয়ে যখন আমি তোরণের দিকে মুক্তির পথে এগোচ্ছিলাম, তখনই জানতাম যদি তিক্ততা ও ঘৃণা পেছনে ফেলে না যাই, তবে আমি (মুক্তি সত্ত্বেও) কারাবন্দীই থেকে যাব।’ প্রকৃত বিজয়ীর অন্তরেরও বিজয়ের প্রয়োজন হয়। এ বিজয় ছাড়া মুক্তির স্বাদ মেলে না। ম্যান্ডেলার কণ্ঠে বারবার শোনা গেছে ক্ষমা, সমঝোতা ও মানবিক ঔদার্যের কথা। 

নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় অর্জন করে ২০০৯-এ আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে, তখনো আরেকবার সুশাসনের মাধ্যমে কল্যাণমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু আবারও দেখা গেল বিজয়ী দল প্রকৃত বিজয়ীর ভূমিকা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। দেশ তাদের দল বা দলবলের দখলে সোপর্দ হয়ে গেল। এভাবেই সর্বশেষ সংকটের সূত্রপাত হয়েছিল। 

৪. 

২০২৪ সালে আবারও একটা সুযোগ তৈরি হলো। এবারের বৈশিষ্ট্য হলো ব্যাপকভাবে সাধারণ ছাত্রদের অংশগ্রহণ, তাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সংযোগ এবং আন্দোলনের লক্ষ্যের প্রতি ব্যাপক সমর্থন।

পরবর্তী নির্বাচনের আগে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য কাজও অনেক। একটি অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্যভাবে সম্পাদনের জন্য সংস্কার ও পুনর্গঠনের কাজ আছে বিস্তর। অথচ যেকোনো বিপ্লবী ঘটনা তো আদতে আইন অতিক্রম করেই ঘটে থাকে। কিন্তু এই মনোভাবের রেশ দীর্ঘস্থায়ী হলে সমাজের নানা ক্ষেত্রে অস্থিরতা বাড়তে ও অন্যায় ঘটতে থাকবে। 

এই সূত্রে বলব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হেনস্তার ঘটনা এখনো থামেনি। এসব নিয়ে ভাবা ও এসবের প্রতিকার জরুরি। শিক্ষার স্বাভাবিক সুস্থ পরিবেশ ব্যাহত হলে আখেরে ক্ষতিগ্রস্ত হবে জাতি। সে ক্ষতি মেরামত করা হবে কঠিন। যেভাবে নির্বিচার হত্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে, তাকেও সুপরিকল্পিত পরিপক্ব চিন্তার কাজ বলা যায় না। 

ঘৃণা-প্রতিহিংসার চর্চা-চরিতার্থতা নানামাত্রিকভাবে চলতে থাকলে আইন ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে, তাতে দেশে অরাজক অবস্থা তৈরির শঙ্কা দেখা দেয়। তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে তাদের কঠিন দায়িত্ব পালনে সবারই সহযোগিতা করা দরকার। তাদেরও এই সহযোগিতার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। 

এ–ও মনে রাখতে হবে, এবারের আন্দোলনের মতো লক্ষ্য অর্জনে এত প্রাণ মুক্তিযুদ্ধ ব্যতীত আর কখনো দিতে হয়নি। শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না—এই স্লোগান আমরা পাকিস্তান আমল থেকে দিচ্ছি, শুনছি। কিন্তু পূর্ববর্তীদের ব্যর্থতায় অনেক রক্তই তো বৃথা গেছে। সেই বেদনা ও দায় অন্তরে ধারণ করে সবারই ভাবতে হবে এবারের শহীদদের রক্তের ঋণ শোধ জাতীয় দায়িত্ব। সেই সঙ্গে বলতে হবে জাতির পক্ষে এ দায় অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর বিশেষভাবে বর্তায়। 


আবুল মোমেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক