অর্থনীতি ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সব সূচকের অবনতিই তার সাক্ষ্য। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির হারের সঙ্গে মজুরি বৃদ্ধি মিলছে না। দীর্ঘস্থায়ী মূল্যস্ফীতির কশাঘাতে দারিদ্র্যসীমার নিচের পরিবার শুধু নয়, নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষও পর্যুদস্ত। বৈষম্যের অভিঘাতে মানুষ জর্জরিত। নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্য-মধ্যবিত্ত অংশের সঞ্চয়, আয় ও কর্মসংস্থানে বড় ধরনের আঘাত পড়েছে। এসবের প্রভাব যুবকদের জনশক্তিতে রূপান্তর না করে অনিশ্চিত যাত্রায় ঠেলে দিচ্ছে। সমাজের মাঝখানের শ্রেণিগুলোতে ভাঙন ধরেছে।
একইভাবে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষত ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলোও মূল্যবৃদ্ধির অভিঘাতে আক্রান্ত। খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লেও তার সুফল কৃষক পান না, পান মধ্যস্বত্বভোগীরা। কৃষকের দিন আনি দিন খাই বা ঋণ করেই যাপিত জীবন চলছে। ঘরে ঘরে নগদ টাকায় টান পড়েছে।
ঋণে জর্জরিত সরকারেরও অর্থাভাব প্রকট। আয় কম বলে পাওনা পরিশোধে হিমশিম অবস্থা। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ও সরবরাহ কমে আসায় ডলারের বিপরীতে টাকার টানা পতন অর্থনীতিতে গভীর নিম্নচাপের জন্ম দিয়েছে। আইএমএফের বেলআউট প্যাকেজের আওতায় অর্থনীতি শুশ্রূষায় আছে।
এখন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ‘উন্নয়ন-বিস্ময়’ নিয়ে নীরব; বরং বিশ্বের বিভিন্ন ঋণমান পূর্বাভাসকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের ঋণমান নামিয়ে দিচ্ছে। দৃশ্যমান হাত-ক্ষমতা এবং কর্তৃত্ব-কেন্দ্রীভূত হওয়ায় বাজারের ‘অদৃশ্য হাত’ কাজ করতে পারছে না। নাগরিকেরা এই দুর্বিষহ জীবন থেকে উত্তরণের পথ খুঁজছেন। একই প্রেক্ষাপটে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে অস্থিরতা চলমান। ভূরাজনৈতিক ছায়াযুদ্ধের হুমকিও বিদ্যমান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল ম্যান্ডেট বা দায়িত্ব মূল্য স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। এ লক্ষ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মুদ্রা সরবরাহ, বৈদেশিক লেনদেন বিনিময়, সুদের হার নির্ধারণসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রা সরবরাহকে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে মানানসই না করে বড় অঙ্কের অর্থ ছাপিয়ে সরকারকে দিয়েছে। এই ছাপানো টাকা আবার মূল্যস্ফীতি বাড়িয়েছে। টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেওয়া বন্ধ করে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে টাকা ধার করায় সুদহার বেড়ে হয়েছে ১১ শতাংশ। সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি রোধ নিয়ে সন্দেহ আছে। সুদহার বৃদ্ধিতে উৎপাদন খাত ঋণ নেওয়া কমিয়ে দিলে দেশের প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হবে। ঋণ পরিশোধ করতে টাকার দরকার হবে। তখন মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। দ্বিতীয়ত, সার্বিক লেনদেন ভারসাম্যের ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে প্রথমবারর মতো ঘাটতি বেড়ে ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ছাড়িয়েছে। পুঁজি পাচার, হাওলা ও হুন্ডি–সংক্রান্ত অভিযোগ নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপও নিতে ব্যর্থ হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থাপনা লাগামহীন।
মূল্যস্ফীতির চাপ লাঘবে অর্থ মন্ত্রণালয় তথা রাজস্ব নীতির বড় ভূমিকা থাকে। মানুষ দুর্দশায় নিমজ্জিত হলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সহায়তায় জীবনযাপন চালিয়ে নেওয়ার বিধান সারা পৃথিবীতেই আছে। কিন্তু সামাজিক সুরক্ষা জাল ছিন্নভিন্ন, বিক্ষিপ্ত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক না হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে দারিদ্র্য বেড়েছে। ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি মাত্রায় সরকারি অর্থ ব্যয় হলেও দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলের কার্যকারিতাও প্রশ্নবিদ্ধ।
অযৌক্তিক প্রকল্প ব্যয় বাড়ানোয় ঋণের পরিমাণও বেশ বেড়েছে। অন্যদিকে রাজস্ব আয় বাড়েনি। বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার হার গত ১৪ বছরে বেড়েছে ৩২২ শতাংশ। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে পাওনার পাহাড় জমছে। ভর্তুকি ও প্রণোদনা পরিশোধের মতো পর্যাপ্ত অর্থ নেই। কর ও মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) অনুপাতের দিক দিয়ে বাংলাদেশের বৈশ্বিক অবস্থান একেবারে তলানির দিকে। জিডিপি যা দেখানো হয়, সে অনুযায়ী বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত এমনটা হওয়ার কথা নয়। সঞ্চয় হার কমে যাওয়ায় স্থবির হয়ে থাকা বিনিয়োগ আরও কমছে। আনুষ্ঠানিক খাতে নতুন কর্মসংস্থান না বাড়ায় অনানুষ্ঠানিক খাতে সৃষ্ট কর্মসংস্থান কখনোই টেকসই হতে পারে না; বাইরের অভিঘাত মোকাবিলা করতে পারে না।
ইতিমধ্যে দুই জেনারেশন সর্বজনীন ও গুণগত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বিশিল্পায়ন ঠেকানো, রপ্তানি বহুমুখীকরণ, উৎপাদনশীলতা ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধির কৌশল অনুপস্থিত। বর্তমানের ভোগ ব্যয়কেন্দ্রিক জিডিপি বৃদ্ধির মডেল থেকে বেরিয়ে দেশীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগকেন্দ্রিক টেকসই সবুজ প্রবৃদ্ধির কাঙ্ক্ষিত অগ্রযাত্রা অধরাই থেকে যাচ্ছে।
কোনো রাজনৈতিক দল আরেক রাজনৈতিক দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারেনি। আবার এক দলের শাসনের ধারাবাহিকতা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নয়। জনগণের কাছে জবাবদিহি নিশ্চিত না করায় রাষ্ট্রের শক্তিপ্রয়োগের ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে অলিগার্কিক মক্কেলতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ‘মানি মেকার’ এবং ‘রুল মেকার’ যোগসাজশ করে একচেটিয়া ক্ষমতার বন্দোবস্ত করছে।
বাংলাদেশ রেন্টিয়ার বা অনর্জিত আয়ভিত্তিক অর্থনীতি তথা বখরাভোগী অর্থনীতি হিসেবে গড়ে উঠছে। বখরাভোগীরা একটি উল্লেখযোগ্য সামাজিক গোষ্ঠী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। মধ্যবর্তী শ্রেণিগুলো বখরার ভাগ পাওয়ার ইঁদুরদৌড়ে ছুটতে গিয়ে দ্রুত ক্ষয়ে যাচ্ছে। মধ্যবিত্তের বুক চেতানো রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গৌরব নিঃশেষিত হতে চলেছে। এ কারণেই রাজনৈতিক আন্দোলনও দানা বাঁধে না। সহমর্মিতা ও সংবেদনশীলতার বদলে ঔদাসীন্য সমাজকে অথর্ব করে ফেলছে। রাষ্ট্রকে জবাবদিহিমূলক, সমতাভিত্তিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরের প্রচেষ্টাও দুর্বল হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্র নিরঙ্কুশ নিবর্তনমূলক রূপ পরিগ্রহ করছে।
বখরা দুই প্রকারে সংগৃহীত ও বণ্টিত হয়: অনর্জিত আয় আহরণ এবং পৃষ্ঠপোষকতা বিতরণ। বন্দোবস্তটি ক্ষমতা, মালিকানা এবং অবদানের মাত্রা হিসাব করে ভাগাভাগি নিরূপণ করে। এখানে চলছে নিরঙ্কুশ বখরা বা অ্যাবসলিউট রেন্টের দৌরাত্ম্য; আপেক্ষিক বা ডিফারেনশিয়াল রেন্টের নয়। বখরাভোগীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অপব্যবহারের মাধ্যমে সিস্টেমকে একচেটিয়াকেন্দ্রিক করে তোলে। অলিগার্করা কাঠামোগত দুর্বলতা তৈরি করে বা পণ্যকে দুর্লভ করে ভোক্তাদের কাছ থেকে বখরা আদায় করে। যেমন বিদ্যুৎ খাতে ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়ের মাধ্যমে ভোক্তাদের খরচ বাড়িয়েছে; একইভাবে রাষ্ট্র থেকেও তারা উশুল তুলছে। রাষ্ট্র ভোক্তাদের ওপর বাড়তি দাম চাপিয়ে বা কর তুলে তা পরিশোধ করছে। এ ক্ষেত্রে বখরার দুই প্রকারই—আদায় ও বণ্টন-প্রযুক্ত হচ্ছে। ভোক্তাদের কাছ থেকে এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা আকারে নিচ্ছে। আবার ‘সিন্ডিকেট’–এর মাধ্যমে অলিগার্করা পণ্যকে দুর্লভ করে বখরা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এটি আপেক্ষিক বা ডিফারেনশিয়াল রেন্ট নয় অর্থাৎ পণ্যের গুণাগুণের ওপর ভিন্ন দাম নয়। গোষ্ঠীতন্ত্র আদিম কায়দায় সম্পদ সঞ্চয়নে যতটা ব্যতিব্যস্ত, জাতি গঠন এবং উৎপাদনমুখী বিনিয়োগে ততটাই উদাসীন।
ক্ষমতার অপব্যবহার করে জোরজবরদস্তির মাধ্যমে আদিম কায়দায় সম্পদ কেন্দ্রীভবনের জন্য পৃষ্ঠপোষকতানির্ভর স্বজনতোষণ সিন্ডিকেটগুলো অপ্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এবং রাজনৈতিক একচেটিয়াপনার মাধ্যমে শাসনব্যবস্থা অব্যাহত রাখে। নিজেদের স্বার্থেই এরা স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে চায় এবং পরিবর্তনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
রাখা দরকার, সুম্পিটার যেমন বলেছেন, সব রেন্ট অর্থনৈতিক বা সামাজিকভাবে অবাঞ্ছিত নয়। গতিশীল পুঁজিবাদী অর্থনীতির অন্তর্নিহিত প্রতিযোগিতা এবং উদ্ভাবনের প্রক্রিয়াগুলোও নতুন পণ্যের জন্য অস্থায়ী একচেটিয়া বাজার তৈরি করে। উদ্ভাবন ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দাম কমেও যায়। উদ্ভাবন বা প্রযুক্তিগত রূপান্তরের জন্য রাষ্ট্র প্রণোদনা হিসেবে তথা উৎপাদনশীল রেন্ট প্রদান বাঞ্ছনীয়।
‘৩৬ বছরে...এমন অর্থনৈতিক সংকট দেখিনি’—এই উক্তি নিজেই উন্নয়নের বয়ানকে খণ্ডন করছে। উন্নয়নের গল্প গোঁজামিলে ভরপুর, বাস্তবতার সঙ্গে তথ্যের মিল নেই। যেমন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা প্রমাণ করতে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ২২৫ ডলার দরে ৫০ হাজার টন চাল শ্রীলঙ্কায় রপ্তানি করে। একই বছর গড়ে ৩০০ ডলার দামে প্রায় ১৩ লাখ টন চাল আমদানি করা হয়। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের খাদ্য উৎপাদনের মাত্রা ওঠানামা করলেও বাংলাদেশে ১৫ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি দেখানো হচ্ছে। ওদিকে এসডিজি বাস্তবায়নে নেপাল বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে। বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে উল্লাস হলেও দাম, লোডশেডিং ও ক্যাপাসিটি চার্জ বাড়ছে। খাদ্যনিরাপত্তার পাশাপাশি জ্বালানি নিরাপত্তাও হুমকিতে আছে।
কোনো রাজনৈতিক দল আরেক রাজনৈতিক দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারেনি। আবার এক দলের শাসনের ধারাবাহিকতা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নয়। জনগণের কাছে জবাবদিহি নিশ্চিত না করায় রাষ্ট্রের শক্তিপ্রয়োগের ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে অলিগার্কিক মক্কেলতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ‘মানি মেকার’ এবং ‘রুল মেকার’ যোগসাজশ করে একচেটিয়া ক্ষমতার বন্দোবস্ত করছে।
বাংলাদেশ তার নিজস্ব পদ্ধতিতেই এর সমাধান খুঁজে বের করবে। ১৯৯১-০৬ ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে ত্রুটিযুক্ত গণতান্ত্রিক নিরীক্ষা হয়েছিল। ওই মেয়াদকালে অর্থনীতির প্রতিটি ধনাত্মক (বা ঋণাত্মক) চলকেই ত্বরণ ছিল। পরবর্তী সময়ে বাড়ার বা কমার গতি কমেছে।
স্বাধীনতার অভীষ্ট লক্ষ্য-নাগরিকের রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা। আগামী দিনের অধিকার আকাঙ্ক্ষী বাংলাদেশ সংবিধান সভার মাধ্যমে রাষ্ট্রের তিন বিভাগের মধ্যে চেক অ্যান্ড ব্যালান্স, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা ও সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব উপহার দিতে পারে।
ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান।