মতামত

তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ড: একটি অবিস্মরণীয় সাক্ষাৎকার

২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর শনিবার। রয়টার্স–এর আমার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। এই ছুটির সঙ্গে এক দিন ছুটি বাড়িয়ে আমার পরিবার ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয় কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে ঢাকার অদূরে যমুনা রিসোর্ট সেন্টারে অবসর কাটাতে গিয়েছিলাম।

আমরা আমাদের কক্ষে তখন সবাই খোশমেজাজে গল্প করছিলাম। সামনেই টেলিভিশন চলছিল। হঠাৎ একটা সংবাদ চ্যানেলে ‘এই মুহূর্তের খবর’ শিরোনামের দিকে সবার নজর পড়ল।

ঢাকার অদূরে আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনসের কারখানায় অগ্নিকাণ্ড। অগ্নিকাণ্ডের শুরুর দিকে কত লোকের প্রাণহানি হয়েছে, সেটি বোধগম্য ছিল না।

তবে পরের দিন সেনাবাহিনীর সহায়তায় উদ্ধারকাজ শুরু হলে লাশের স্তূপ হচ্ছিল। মৃত মানুষের সংখ্যা দেখে গোটা জাতি বিস্মিত ও শোকার্ত হয়ে ওঠে।

কমপক্ষে ১১৮ জনের মৃত্যুসংবাদ নিশ্চিত করা হয় এবং ১০০–র বেশি লোক আহত হন। বৈদ্যুতিক সংযোগের ত্রুটি থেকে এই অগ্নিকাণ্ড ঘটে বলে প্রথমে ধারণা করা হয়।

তবে জাতির ইতিহাসে এটি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাণঘাতী অগ্নিকাণ্ড। ২০০৯ সালে ১ হাজার ৬৩০ জন শ্রমিক নিয়ে তাজরীন ফ্যাশনসের যাত্রা শুরু হয়। নৈতিক বিচারে ২০১১ সালের মে মাসে ওয়ালমার্ট এই পোশাক শিল্পকারখানাকে অরেঞ্জ ধাপভুক্ত বলে চিহ্নিত করে যেসব নীতি বেঁধে দেয়, সেগুলো প্রতিপালন না করায় তাজরীন ফ্যাশনসকে ওয়ালমার্ট অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ উৎস হিসেবে গণ্য করে এভাবে অরেঞ্জ শ্রেণিভুক্ত করে।

নয়তলা ভবনের নিচতলায় বিভিন্ন দাহ্য পদার্থ স্তূপ করা ছিল এবং সেখান থেকেই এই আগুনের সূত্রপাত। এ কারণে বিভিন্ন তলায় কর্মরত কয়েক শ শ্রমিক আটকা পড়ে যান। বিভিন্ন তলায় বিপুল পরিমাণে কাপড় ও সুতা স্তূপীকৃত থাকায় দ্রুত এই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আগুন নেভাতে ১৭ ঘণ্টারও বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়। একমাত্র দ্বিতীয়তলায় অন্তত ৬৯টি লাশ উদ্ধার করা হয়।

অগ্নিকাণ্ডের দ্বিতীয় দিনে তাজরীন ফ্যাশনসের সামনে শত শত মানুষের ভিড়। এই কারখানায় কর্মরত কয়েক শ শ্রমিকের আত্মীয়স্বজনের গগনবিদারী চিৎকার, বিলাপ আর আর্তনাদে সেখানকার পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। কোনো কোনো মৃতদেহ মারাত্মকভাবে ভস্মীভূত হওয়ায় পরিচয় চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। সে কারণে ওই সব লাশের পরিবারের সদস্যদের ডিএনএ পরীক্ষার ওপর নির্ভর করতে হয়। আর এ জন্য কাউকে কাউকে ছয় মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।

তাজরীন ফ্যাশনসের এই দুর্ঘটনার পর আমি আমার ভ্রমণ বাতিল করে পরের দিন বিশেষ ব্যবস্থায় একাই ঢাকায় ফিরে আসি। অফিসে প্রবেশের পর রয়টার্স-এর ব্যুরো চিফ আনিস আহমেদ হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন।

বললেন, ফলোআপ প্রতিবেদন করতে হবে। এই চিন্তা মাথায় রেখেই আমি ঢাকায় ফিরেছি সে কথা আনিস ভাইকে বললাম। তিনি খুশি হলেন।

তাজরীন ফ্যাশনসের মালিক দেলোয়ার হোসেনকে ঘটনাক্রমে ফোনে পেয়ে গেলাম। তিনি রয়টার্সকে বললেন, এই দুর্ঘটনার কারণে তাঁর বিপুল পরিমাণ বৈষয়িক ক্ষতি হয়েছে। একই সঙ্গে তিনি তাঁর কারখানায় শ্রমিকদের জন্যও এটি অনেক বড় ক্ষতি বলে উল্লেখ করেন।

তদন্তে দেখা যায়, অগ্নিনিরাপত্তা–সংক্রান্ত প্রত্যয়নপত্রের মেয়াদ ২০১২ সালের জুন মাসে শেষ হয়েছে। দায়িত্বে অবহেলাজনিত অপরাধের জন্য ২৮ নভেম্বর কারখানার তিনজন তত্ত্বাবধায়ককে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ হলো, তাঁরা ভবনের বহির্গমন ফটক তালাবদ্ধ করে রেখেছেন এবং ভবনে অগ্নিকালের ঘটনার পরও শ্রমিকদের বাইরে যেতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন।

আনিস ভাই সরেজমিন প্রতিবেদন করার জন্য আমাকে কারখানা চত্বরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কারখানা চত্বরে দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া বেশ কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাই। এ রকম একজন শ্রমিক মোহাম্মদ রিপন। তিনি ভবনের দ্বিতীয়তলা থেকে লাফ দিয়ে জীবন রক্ষা করেন। তিনি বলেন, কারখানার ব্যবস্থাপক ভেতরের শ্রমিকদের আতঙ্কিত না হয়ে কাজে মনোনিবেশ করার উপদেশ দেন। তিনি শ্রমিকদের বলেন, ‘যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য অগ্নিসংকেত বেজেই চলছে। আপনারা যাঁর যাঁর আসনে গিয়ে কাজে মনোযোগী হন।’ রিপন বলেন, দগ্ধ শ্রমিকদের লাশের সারিতে ওই ব্যবস্থাপকেরও লাশ মিলেছে।

২৭ নভেম্বর ওয়ালমার্ট তোবা কোম্পানির সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করে। কারণ, তোবা গ্রুপ সাব-কন্ট্রাকটিংয়ের মাধ্যমে তাজরীন ফ্যাশনসের কাছ থেকে পোশাক পণ্য ক্রয় করে সেগুলো ওয়ালমার্টের কাছে তোবার নামে সরবরাহ করত।

তবে ওয়ালমার্ট অগ্নিনিরাপত্তা–ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে বাংলাদেশের পোশাক সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর সঙ্গে একযোগে কাজ করার প্রত্যয় ঘোষণা করে। তাজরীন ফ্যাশনস যেসব কোম্পানির জন্য পোশাক প্রস্তুত করত, ওই সব কোম্পানির প্রতিনিধিরা ২০১৩ সালের ১৫ মে জেনেভায় এক বৈঠকে মিলিত হন।

এই বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ছিল এই অগ্নিকাণ্ডের শিকার শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত নেওয়া। তবে অজ্ঞাত কারণে ওয়ালমার্ট ও সিয়ার্স এই বৈঠকে কোনো প্রতিনিধি পাঠাতে অস্বীকৃতি জানায়।

তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ডের পর বাংলাদেশের বিভিন্ন পোশাক শিল্পকারখানার হাজার হাজার শ্রমিক দুর্ঘটনাস্থলে সমবেত হয়ে অধিকতর নিরাপদ কর্মস্থলের দাবিতে সোচ্চার হন। তিন দিন ধরে এই প্রতিবাদ সভা চলে এবং শ্রমিকেরা প্রধান মহাসড়কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সংলগ্ন এলাকায় অন্তত ২০০ কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

এলাকার কারখানার মালিকেরা তাঁদের কারখানার অভ্যন্তরে মূল্যবান যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম সুরক্ষার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালাতে থাকেন। কারণ, ওই সময় পুরো এলাকায় চরম বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয় এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে।

শ্রমিকেরা সড়কে চলাচলরত যানবাহনের ওপর ইটপাথর নিক্ষেপ ও ভাঙচুর করেন। বিভিন্ন কারখানা লক্ষ্য করেও তাঁরা পাথর নিক্ষেপ করেন।

২০১২ সালের ২৭ নভেম্বর সরকার দেশব্যাপী জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করে এবং নিহত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়।

মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যরা তাঁদের দেশের জিএসপি সুবিধা লাভের জন্য যেসব শর্ত ও বিধান প্রতিপালন করা প্রয়োজন, বাংলাদেশের কারখানাগুলোয় তা কতটা মান্য করা হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখার জন্য মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির কার্যালয়কে আহ্বান জানান।

বাংলাদেশে এই প্রথম কারখানার কোনো মালিকের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের মৃত্যুর জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ উত্থাপিত হয়। দেলোয়ার হোসেনকে কারারুদ্ধ এবং বিচারের মুখোমুখি করার পেছনে অবশ্যই আন্তর্জাতিক চাপ ছিল বলে একজন মানবাধিকারকর্মী স্বীকার করেন। আর এর মধ্য দিয়ে এই ঘটনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।

অগ্নিকাণ্ডের ১৩ মাস পর, অর্থাৎ ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ পুলিশ তাজরীন ফ্যাশনসের মালিক এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। ঘটনার ১৪ মাস পর দেলোয়ার হোসেনকে এই দুর্ঘটনার জন্য অভিযুক্ত করা হয়। দেলোয়ার কারারুদ্ধ থাকা অবস্থায় এই বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

বাংলাদেশে এই প্রথম কারখানার কোনো মালিকের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের মৃত্যুর জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ উত্থাপিত হয়। দেলোয়ার হোসেনকে কারারুদ্ধ এবং বিচারের মুখোমুখি করার পেছনে অবশ্যই আন্তর্জাতিক চাপ ছিল বলে একজন মানবাধিকারকর্মী স্বীকার করেন। আর এর মধ্য দিয়ে এই ঘটনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।

এ সময় রয়টার্স-এর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ব্যুরোপ্রধান ছিলেন জন চালমার্স। বছরের শুরুতে জন চালমার্স দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় সফর শুরু করেন। তাঁর সফরের প্রথম দেশটি ছিল পাকিস্তান। পাকিস্তানে সফর শেষে তিনি বাংলাদেশে আসার সিদ্ধান্ত ব্যুরোপ্রধানকে অবহিত করেন। জন চালমার্সকে আমরা শুধু ‘জন’ বলে সম্বোধন করতাম।

২০১৩ সালের ১৬ জানুয়ারি বুধবার দুপুর নাগাদ জন ঢাকা অফিসে আসেন। আনিস ভাই এগিয়ে গিয়ে তাঁকে স্বাগত জানান। তিনি নির্ধারিত হোটেলের কক্ষে প্রবেশ না করে তাঁর ক্ষুদ্রায়তনের ট্রলিব্যাগসহ সরাসরি শেরাটন হোটেলের তৃতীয়তলায় অবস্থিত আমাদের অফিসে আসেন। প্রথমেই সংবাদকক্ষে ঢুকে আনিস ভাইয়ের মাধ্যমে আমাদের সঙ্গে পরিচিত হন। তিনি আমাদের সঙ্গে পেশাগত আলাপ চালিয়ে যেতে আগ্রহ দেখালে, আনিস ভাই তাঁর কক্ষে চলে যান।

মধ্য বয়সের দীর্ঘকায় ব্রিটিশ এই সাংবাদিক যে হাড়ে হাড়ে পেশাদারি মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন, তা আমরা খুব শিগগিরই অনুধাবন করতে সক্ষম হই। আমরা কে কোন বিষয়ে প্রতিবেদন করি, তিনি তা জানতে চান। তবে তিনি তৈরি পোশাকশিল্পের ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এই শিল্প খাত সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে পৃথিবীর সব খ্যাতিমান এবং শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক ক্রয় করে। প্রায় ঘণ্টাব্যাপী অনির্ধারিত আলোচনার পর আমি তাঁর সঙ্গে অন্তরঙ্গ হয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি।

জন কথা না বাড়িয়ে আনিস ভাইয়ের কক্ষে চলে যান। তাঁরা প্রায় ঘণ্টাব্যাপী রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। এরপর তিনি সোজা তাঁর কক্ষে চলে যান। আমাদের সঙ্গে আর কোনো কথা হলো না।

জন বিদায় হওয়ার পর আনিস ভাই আমাদের তাঁর কক্ষে ডেকে নিলেন। আনিস ভাইকে আমরা অনুধাবন করার চেষ্টা করলাম। কিছুই আঁচ করা গেল না; বরং আনিস ভাই আমাদের কাছ থেকে জন সম্পর্কে জানার চেষ্টা করলেন। তিনি আমাদের যেসব পরামর্শ এবং আশ্বাস দিয়েছেন, তা আনিস ভাইকে জানালাম। অন্যান্য দিন আনিস ভাই আগে চলে গেলেও এদিন পুরো সময় অফিস করলেন।

আনিস ভাই কোনো এক ফাঁকে আমাকে একা তাঁর কক্ষে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘জন তাজরীন ফ্যাশনসের মালিক দেলোয়ার হোসেনের সাক্ষাৎকার নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।’

এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা যে কত কঠিন, তা আনিস ভাইকে বললাম। কারণ, নানা কারণে মালিক গা ঢাকা দিয়েছেন। তবে আমি আনিস ভাইকে আশ্বস্ত করে বললাম, ‘আমি সর্বান্তকরণে চেষ্টা করব।’

রাতে বিজিএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিনকে ফোন করে যেভাবেই হোক দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে আমার একটা সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে দিতে বিশেষভাবে অনুরোধ করলাম। তিনি সহযোগিতার আশ্বাস দিলেও ভরসা পাচ্ছিলাম না।

কারণ, তখন তাজরীন ফ্যাশনসের মালিকের সন্ধান পাওয়া সবার জন্যই দুরূহ ছিল। পরের দিন দুপুর নাগাদ মহিউদ্দিন ভাইয়ের একান্ত সচিব মোহাম্মদ ফরহাদ ফোন করে সাক্ষাৎকারের সময় ও স্থান জানিয়ে দিলেন।

রাত ৮টায় বিজিএমইএর সভাপতির কক্ষে এই সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করা হলো। ‘এক ঢিলে দুই পাখি মারা’র লক্ষ্য নিয়ে সন্ধ্যা ৬টায় মহিউদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের বন্দোবস্ত করলাম। কারণ, জন চাচ্ছিলেন আমরা যেন বিজিএমইএর সভাপতির সঙ্গেও সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করি। নির্দিষ্ট সময়ের আধা ঘণ্টা আগে জনকে নিয়ে আমি বিজিএমইএতে উপস্থিত হলাম। মহিউদ্দিন ভাই তাঁর রুমেই ছিলেন। জন তাঁর সম্পূর্ণ পেশাদারি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মহিউদ্দিন ভাইকে প্রশ্ন করে যাচ্ছিলেন। এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া তাঁর জন্য মোটেই সুখকর ছিল না। তবে তিনি তাঁর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরে একটি ইতিবাচক উপসংহার টানছিলেন।

প্রায় এক ঘণ্টার এই সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের অভ্যন্তরে যেসব ক্ষত, অব্যবস্থাপনা, কর্মচারীদের প্রতি মালিকদের উদাসীন দৃষ্টিভঙ্গি, জীবন ধারণের তুলনায় কম মজুরি প্রদান, কর্মস্থলে প্রতিকূল ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করার জন্য বাধ্য করা, শ্রমিক ইউনিয়ন সংগঠিত করতে মালিকদের বাধা দান ও নানা কূটকৌশল গ্রহণ ইত্যাদি নানা বিষয়ে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেন।

জনের এই সাক্ষাৎকার–কৌশল থেকে আমার নিজের বেশ কিছু শিক্ষণীয় দিক ছিল। কারও সাক্ষাৎকার গ্রহণের আগে ওই ব্যক্তির ও সাক্ষাৎকারের বিষয়বস্তুর ওপর প্রচুর ধারণা বা হোমওয়ার্ক থাকা অপরিহার্য।

একই সঙ্গে বিষয়বস্তুর প্রেক্ষাপট সম্পর্কে সুস্পষ্ট অভিজ্ঞান থাকা জরুরি। সাক্ষাৎকারের পর আমি যথেষ্ট শঙ্কাবিদ্ধ হয়ে পড়ি এই ভেবে, শেষ পর্যন্ত আমাদের মূল সাক্ষাৎকার পণ্ড না হয়ে যায়। সাক্ষাৎকার শেষে আমরা তাঁর কক্ষেই অবস্থান করতে থাকি।

ইতিমধ্যে সভাপতির ব্যক্তিগত সচিব সন্তর্পণে কক্ষে ঢুকে মহিউদ্দিন ভাইকে প্রায় নিঃশব্দে কিছু একটা বার্তা দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে মহিউদ্দিন ভাইয়ের হাসিমুখ মলিন হয়ে গেল এবং তিনি ক্রোধবিদ্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘দেলোয়ারকে বলেন আমাদের সহযোগিতা না করলে বিজিএমইএ তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে বাধ্য হবে। তাঁকে এই সাক্ষাৎকার দিতেই হবে।’

এরপর মহিউদ্দিন ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তিনি তো ইংরেজিতে সাক্ষাৎকার দিতে পারবেন না।’ আমি উত্তরে বললাম, ‘আমরা তাঁর সঙ্গে বাংলায় কথা বলব এবং আমি দো-ভাষীর দায়িত্ব পালন করব।’

কিছুক্ষণ পর দু–তিনজন সহযোগী কর্তৃক বেষ্টিত হয়ে দেলোয়ার হোসেন মহিউদ্দিন ভাইয়ের কক্ষে ঢুকলেন। সেখান থেকে তাঁকে একটি গোপন কক্ষে নেওয়া হলো। সঙ্গে আমি ও জন। জানুয়ারি মাসের শীতের রাত। কিন্তু দেলোয়ার হোসেনের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বিধ্বস্ত অবয়ব। থরথর করে কাঁপছিলেন। বাংলাদেশের একজন শিল্পোদ্যোক্তার এই করুণ এবং অসহায় দৃশ্য আমাকে ব্যথাতুর করে তুলল। আমি হাত ধরে তাঁকে একটি সোফায় বসালাম। কক্ষে আমরা মাত্র তিনজন। আমি তাঁকে আশ্বস্ত করে বললাম, ‘আমরা এমন কিছু আপনার বিরুদ্ধে লিখব না, যা আপনার জন্য আরও বিপদ ডেকে আনতে পারে। আপনি প্রাণ খুলে আমাদের সঙ্গে কথা বলুন। বাংলায় স্বাচ্ছন্দ্যে কথা বলুন।’

তাঁকে স্বাভাবিক করার জন্য চা ও পানি পান করার প্রস্তাব করলাম। কিন্তু তিনি অসম্মতি জানালেন।

জন ইংরেজিতে প্রশ্ন করলেন। আমি সহজ বাংলায় তরজমা করছি। দেলোয়ার তাঁর মতো করে জবাব দিচ্ছেন। তাঁর কান্নাজড়িত কণ্ঠে জবাব। আমি তাঁর জবাব ইংরেজি করে জনকে বলছি। একই সঙ্গে নোট বইয়ে তুলছি। আমাদের প্রায় ৪০ মিনিটের সাক্ষাৎকার ফিতাবন্দী করা হয়। সাক্ষাৎকারের প্রায় শেষের দিকে হন্তদন্ত হয়ে রফিক ভাই ক্যামেরা নিয়ে প্রবেশ করেন। পুরো নাম তাঁর রফিকুর রহমান। তিনি রয়টার্স-এর ঢাকা ব্যুরোর যুগপৎ ফটোসাংবাদিক ও ক্যামেরাম্যান। তাঁর পিছু পিছু জাতীয় দৈনিকের বেশ কয়জন ফটোগ্রাফার ও সাংবাদিক ওই অপরিসর কক্ষে ঢুকে পড়েন।

ফলে সাক্ষাৎকারের পুরো পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। সাক্ষাৎকারের শুরুর দিকে জন অগ্নিকাণ্ডের এই ঘটনার জন্য সরাসরি তাঁকে দায়ী করে বলেন, তাঁর নির্দেশেই ভবনের সিঁড়ির মুখের সব ফটক তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল।

দেলোয়ার বারবার ‘না’ সূচক মাথা দুলিয়ে এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তিনি কখনোই কোনো ব্যবস্থাপককে এ ধরনের নির্দেশ দেননি। এ জন্য তিনি সরাসরি এই দায়িত্বে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে দায়ী করেন। প্রবেশপথে ভবনের নিচতলায়, সিঁড়ির মুখে বিপুল পরিমাণ কাপড় ও অন্যান্য দাহ্য সামগ্রী মজুত থাকায় এই অগ্নিকাণ্ড ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

জন এ জন্য দেলোয়ারকে দায়ী করলে তিনি তা অস্বীকার করে বলেন, এই দুর্ঘটনার দুই দিন আগে তিনি তাজরীন ফ্যাশনস পরিদর্শনে গিয়েছিলেন এবং এই অব্যবস্থাপনা তাঁর নজরে এসেছিল। তিনি তখনই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এসব সামগ্রী মজুতাগারে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে দাবি করেন।

পরবর্তীকালে আমরা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে এই দাবির সত্যতা খুঁজে পাইনি।

সাক্ষাৎকারের মাঝামাঝি সময়ে জনের সেল ফোনের পর্দায় একটি ব্রেকিং নিউজ ভেসে ওঠে। তিনি আমাকে তাঁর সেল ফোনের সেটটি তুলে দিয়ে সংবাদটি পাঠের পরামর্শ দেন। তিন–চার গুচ্ছের সংবাদ পড়ে আমরা দুজনে দৃষ্টি বিনিময় করে হেসে ফেলি।

রয়টার্স-এর প্রতিদ্বন্দ্বী একটি আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এই মর্মে সংবাদ দিয়েছে যে তাজরীন ফ্যাশনসের মালিককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তিনি এখন পুলিশি হেফাজতে।

ওই সময় ঢাকা জেলার পুলিশের সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন হাবিবুর রহমান। সাংবাদিকদের জন্য সব সময় তাঁর দরজা উন্মুক্ত। আমি জনের সামনেই হাবিবুর রহমানকে ফোন করে ওই সংবাদ নিয়ে কথা বললাম। তিনি আমাকে বললেন, দুপুরে তাঁরা তাজরীন ফ্যাশনসের মালিককে তাঁর কার্যালয়ে ডেকে ছিলেন প্রকৃত ঘটনা জানার জন্য। তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়নি কিংবা তাঁর বিরুদ্ধে কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও নেই।

সাক্ষাৎকার শেষে আমরা দুজনে সরাসরি হোটেলে ফিরলাম। জন চলে গেলেন তাঁর হোটেলের কক্ষে, আমি অফিসে। কক্ষে ফিরেই তিনি দেলোয়ারের সাক্ষাৎকারকে রয়টার্স-এর ‘এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ’ হিসেবে প্রতিবেদন করলেন। ভেতরে একাধিক স্থানে বিজিএমইএর সভাপতির উদ্ধৃতি। যুগ্ম নামে সাক্ষাৎকারভিত্তিক রয়টার্স পরিবেশিত এই প্রতিবেদন ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল, নিউইয়র্ক টাইমস এবং দ্য গার্ডিয়ানসহ বিশ্বের বহু খ্যাতনামা দৈনিকে গুরুত্বসহকারে ছাপা হয়।

পরের দিন একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের ঢাকাস্থ প্রতিবেদক আমাকে ফোন করে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘কাদির ভাই আপনি তো আমাদের চাকরি বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছেন।’ জন পরের দিন বিকেলের ফ্লাইটে দিল্লি ফিরে যান।

(স্মৃতিচারণামূলক লেখাটি ইউপিএল থেকে প্রকাশিতব্য রয়টার্সের দিনগুলো বই থেকে নেওয়া হয়েছে ও সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে।)

  • সিরাজুল ইসলাম কাদির রয়টার্স-এর সাবেক ব্যুরোপ্রধান এবং বর্তমানে অ্যামচ্যাম জার্নালের সম্পাদক