ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি

শশী থারুরের কলাম

মোদি–ঝড় রুখতে হলে...

জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে ভারত বছরটি শুরু করছে। নির্বাচনী লড়াইয়ের চিহ্নরেখা ইতিমধ্যে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে।

লড়াইয়ের একদিকে আছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি), অন্যদিকে আছে বেশ কয়েকটি বিরোধী দল।

এই বিরোধী দলগুলোর বেশির ভাগই গুচ্ছবদ্ধভাবে কংগ্রেস পার্টির সঙ্গে আছে। একই সঙ্গে সব বিরোধী দল মিলে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স (প্রতিটি শব্দের আদ্যক্ষর নিয়ে এই জোটের সংক্ষিপ্ত নাম দেওয়া হয়েছে ‘ইন্ডিয়া’) নামের একটি জোট গড়েছে।

টানা এক দশক ক্ষমতায় থাকার সুবাদে বিজেপির নীতিসংক্রান্ত ভাষ্য বা বয়ানে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। ২০১৪ সালে নির্বাচনী প্রচারে বিজেপির স্লোগান ছিল, ‘আচ্ছে দিন আনে ওয়ালে হ্যায়’ (সুদিন আসছে)।

২০০১ সাল থেকে গুজরাটের সফল মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠা নরেন্দ্র মোদিকে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় অর্থনৈতিক উন্নয়নের অবতার হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল।

২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপির বয়ান ছিল, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদি ভারতীয় অর্থনীতির খোলনলচে বদলে দেবেন এবং ফি বছর দুই কোটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি সবার জন্য সমৃদ্ধি নিশ্চিত করবেন।

কিন্তু সবার জন্য সমৃদ্ধি আনা তো দূরের কথা, তিনি প্রথম মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার পর ব্যাংক নোট (এক হাজার রুপির নোট) বাতিলের এমন একটি বিপর্যয়কর ঘোষণা দেন, যার ফলে রাতারাতি ৮৬ শতাংশ ভারতীয় মুদ্রা অচল হয়ে যায়।

নোট বাতিলের অভিঘাতে জনদুর্ভোগ নেমে আসে ও ব্যাপক বেকারত্ব দেখা দেয়। এতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের বয়ান মার খেয়ে যায়। এ কারণে ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিজেপির নতুন একটি বয়ানের দরকার পড়ে।

২০১৯ সালে জাতীয় নির্বাচনের মাস দুই আগে কাশ্মীরের পুলওয়ামায় পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসীদের হামলায় ৪০ ভারতীয় জওয়ান নিহত হন। ওই ঘটনার পর বিজেপি তাঁর নতুন ন্যারেটিভ বা বয়ান বা ভাষ্য পেয়ে যায়।

নতুন ভাষ্য প্রতিষ্ঠায় বিজেপি জাতীয় নির্বাচনকে ‘জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের গণভোট’ হিসেবে দেখানোর চেষ্টায় নেমে পড়ে। গুজরাট ইনকরপোরেশনের সিইও হিসেবে মোদি অনেক আগেই পরিচিতি পেয়েছিলেন। এবার তাঁকে ৫৬ ইঞ্চি বুকের ছাতিওয়ালা এমন এক পালোয়ান হিসেবে দেখানো হতে থাকল, যিনি পাকিস্তানের হামলা থেকে ভারতকে নিরাপদ রাখতে সক্ষম।

এরপর পাকিস্তানের সীমানায় একটি কথিত জঙ্গি ঘাঁটি লক্ষ্য করে একটি বহুল আলোচিত ভারতীয় বিমান হামলা মোদির নতুন পালোয়ানধর্মী ভাবমূর্তি দাঁড় করিয়ে দেয়। ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ নামের এই ভারতীয় হামলা ভোটারদের মোদির প্রতি ঝোঁক বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু যে বয়ানের জোরে মোদি দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হয়েছিলেন, দ্বিতীয় মেয়াদকালে তিনি তাঁর সেই ভাবমূর্তিও ধরে রাখতে ব্যর্থ হন।

মোদি দিনের পর দিন একধরনের অধ্যবসায়ের মধ্য দিয়ে নিজের যে লৌহকঠিন ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছেন, তা হয়তো অভ্যন্তরীণ বিরোধীদের মনে ভয় ধরাতে সহায়ক হতে পারে, কিন্তু তা চীনকে ঘাবড়ে দিতে পারেনি।

আমরা দেখেছি, চীনের সেনাবাহিনী ভারতের হিমালয় অঞ্চলের সীমান্তে একটু একটু করে ঢুকে একটু একটু করে দখল করে যাচ্ছে।

ওই অঞ্চলে অন্তত ৪৫ বছরের মধ্যে প্রথম ভয়াবহ সংঘর্ষে ২০ ভারতীয় জওয়ানের নিহত হওয়ার ঘটনা মোদির আমলেই ঘটেছে।

সীমান্তের ৬৫টি পয়েন্টে ইতিপূর্বে চীন ও ভারত উভয়ের টহল দেওয়ার সুযোগ ছিল। এর মধ্যে ২৬টি পয়েন্টে ভারতের সীমান্তরক্ষীদের চীন এখন আর ঢুকতে দিচ্ছে না। যেসব জায়গা চীনের বাহিনী দখল করেছে, মোদি তা পুনরুদ্ধার করে সেখানে স্থিতাবস্থা পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

সুতরাং ২০১৯ সালে মোদি জাতীয় নিরাপত্তার যে বয়ান দাঁড় করিয়েছিলেন, সেটিও এখন গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। ফলে ২০২৪ সালের নির্বাচনের জন্য বিজেপিকে নতুন একটি বয়ান প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাতে হচ্ছে। তার জন্য তারা এখন মোদিকে ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাট’ হিসেবে চিত্রায়িত করার চেষ্টা করছে। এর মাধ্যমে বিজেপি এখন তার মৌলিক নীতির দিকেই ফিরে যাচ্ছে।

আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি আবুধাবিতে প্রথম হিন্দুমন্দির উদ্বোধন করতে যাবেন মোদি। এটিও মোদির হিন্দুত্ববাদী ভাবমূর্তিকে শক্তিশালী করবে। এর পরপরই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হতে পারে। এর মাধ্যমে পরিষ্কার বার্তা দেওয়া হবে, বিজেপি একজন হিন্দু বীরের জন্য তৃতীয় মেয়াদে জনগণের সমর্থন চাইছে।

বিজেপি প্রথম থেকেই হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল হিসেবে পরিচিত এবং মোদি নিজে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে একটি কুখ্যাত মুসলিম নিধনকাণ্ডে জড়িত ছিলেন।

ওই ঘটনায় গুজরাটে প্রায় দুই হাজার লোক নিহত হয়েছিলেন, যাঁদের অধিকাংশই ছিলেন মুসলিম। ওই দুষ্কর্মের দায় কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলার জন্য বিজেপি ২০১৪ সালে মোদিকে অর্থনৈতিক নায়ক হিসেবে তুলে ধরছিল।

এক দশকের শাসনকালে মোদি ক্রমবর্ধমানভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের (মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশ) আধিপত্য জোরদার করেছেন। স্বাধীনতা লাভের ছয় দশকের বেশি সময় ধরে নানা ধর্ম-বর্ণের সহাবস্থান ধরে রাখা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতাকে উড়িয়ে দিতে মোদির সরকার একের পর এক উদ্যোগ নিয়েছে।

এখন বিজেপি একজন ‘সত্যিকারের হিন্দু’ এবং ‘জনগণের’ প্রকৃত প্রতিনিধি হিসেবে মোদিকে চিত্রায়িত করার চেষ্টাকে দ্বিগুণ করছে।

অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ভেঙে সেখানে প্রতিষ্ঠিত রামমন্দির ২২ জানুয়ারি মোদি যখন উদ্বোধন করবেন, তখন বিজেপির সেই প্রয়াসটি চূড়ান্ত রূপ পাবে।

রামমন্দির স্থাপন বিজেপির দীর্ঘদিনের প্রতিশ্রুতি ছিল এবং তারা সে প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছে। ফলে রামমন্দিরের উদ্বোধন ভারতজুড়ে, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় বিজেপির ভক্তসংখ্যা বাড়াবে। এটি বিজেপির হিন্দুত্ববাদকে আরও জনপ্রিয় করে তুলবে।

এ ছাড়া আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি আবুধাবিতে প্রথম হিন্দুমন্দির উদ্বোধন করতে যাবেন মোদি। এটিও মোদির হিন্দুত্ববাদী ভাবমূর্তিকে শক্তিশালী করবে। এর পরপরই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হতে পারে। এর মাধ্যমে পরিষ্কার বার্তা দেওয়া হবে, বিজেপি একজন হিন্দু বীরের জন্য তৃতীয় মেয়াদে জনগণের সমর্থন চাইছে।

এ অবস্থায় মোদির ধর্মভিত্তিক দৌড়ে ইন্ডিয়া জোটের শামিল হওয়া উচিত হবে না। বিজেপি যে হিন্দুত্ববাদের সমরাস্ত্রের সজ্জায় সজ্জিত, তার সামনে ধর্মনিরপেক্ষতার যুক্তি দাঁড়াতে পারবে না।

এ কারণে ইন্ডিয়া জোটের উচিত ১৯৯২ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন থেকে শিক্ষা নেওয়া। সে সময় বিল ক্লিনটনের প্রচারশিবির থেকে বারবার আমেরিকানদের গত সরকারের (জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশের সরকার) নাজুক অর্থনীতির কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছিল।

ইন্ডিয়া জোটকে যে প্রশ্নগুলো সামনে আনতে হবে, সেগুলো হলো, ‘আচ্ছে দিন’ এর কী হলো? ফি বছর দুই কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টির কী হলো? ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কী হলো?

  • শশী থারুর ভারতের কংগ্রেস পার্টির এমপি, যিনি ইতিপূর্বে জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল এবং ভারতের পররাষ্ট্র ও মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন

  • স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ